ভারতে মুসলিম নারীকে রাস্তায় 'বোরকা খুলে হেনস্তার' ঘটনায় যা জানা যাচ্ছে - বিবিসি [ছয়জন মুসলিম গ্রেফ্তার]

ভারতের উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগরে নারীকে হেনস্তার এই ঘটনা ঘটে, ছবির উৎস, Rajkumar
ভারতের উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগরে নারীকে হেনস্তার এই ঘটনা ঘটে, ছবির উৎস, Rajkumar


ভারতে মুসলিম নারীকে রাস্তায় 'বোরকা খুলে হেনস্তার' ঘটনায় যা জানা যাচ্ছে 


Author,শাহবাজ আনোয়ার, মুজফফরনগর থেকে, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

"আমার মেয়ে কোনো অপরাধ করেনি। কিন্তু কিছু লোক প্রকাশ্যে তাকে হেনস্তা করে," 


কথাগুলো বলছিলেন ভারতের উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগর এলাকার বাসিন্দা এক নারী। তার মেয়েকে দিন কয়েক আগে রাস্তায় হেনস্তা করা হয় এবং সেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে।

মুজফফরনগরের রাস্তায় প্রকাশ্যে ওই নারীর বোরকা খুলে নিতে এবং তাকে অপদস্থ করতে দেখা যায় ওই ভিডিওতে। তার (ওই নারীর) সঙ্গে যে ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন, তাকেও হেনস্তা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

সঙ্গে থাকা সেই ব্যক্তির নাম শচীন। তিনি ব্যাংকের একজন কর্মী।

যে নারীর সঙ্গে এই ঘটনা ঘটে তার মা বলেছেন, 

"তারা ভুল সন্দেহ করে আমার মেয়েকে মারধর করেছে এবং আমার সহকর্মীর সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করেছে। আমি তাদের কখনোই ক্ষমা করব না।"

"আমার মেয়ের মানসিক অবস্থা এখন ভালো নয়, সে কথা বলতে পারবে না। তবে আমরা দোষীদের শাস্তি চাই," বলেন তিনি।

এই ঘটনাটি ঘটেছে গত ১২ই এপ্রিল। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর স্থানীয় পুলিশ এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ভাইরাল হওয়া ভিডিও দেখে বাকি অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা হচ্ছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

হেনস্তার শিকার ওই নারীর মা নিজেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার কথা জানিয়েছেন। সংসারের আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় তাদের বাইরে গিয়ে কাজ করতে হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি বলছিলেন, তার মেয়ে অন্য সম্প্রদায়ের একজনের সঙ্গে কাজে গিয়েছিল, সেকারণে সন্দেহবশত তার বোরকা খুলে নেওয়া হয় এবং মারধর করা হয়।



ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতিমধ্যে ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, ছবির উৎস, Rajkumar
ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতিমধ্যে ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, ছবির উৎস, Rajkumar

ছয়জন গ্রেফতার


ঘটনার দিন অর্থাৎ, ১২ই এপ্রিলের ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পরে, হেনস্তার শিকার ওই নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে পুলিশ।

ভাইরাল হওয়া এই ভিডিওর ফুটেজের ওপর ভিত্তি করে সরতাজ, শাদাব, মহম্মদ উমর, আর্শ, শোয়েব ও শামি নামে ছয়জন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

নিগ্রহের শিকার ওই নারীর পরিবার যে এলাকায় বসবাস করেন, গ্রেফতারকৃতরাও একই এলাকার।

ডিএসপি রাজু কুমার সাব জানিয়েছেন, ভিডিও দেখে বাকি অভিযুক্তদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে এবং তাদেরও শিগগিরই গ্রেফতার করা হবে।

ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১১৫ (২), ৩৫২, ১৯১ (২) এবং ৭৪ নম্বর ধারায় মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। এই ধারাগুলোয় মারধর, গালিগালাজ করা, দাঙ্গা ও শ্লীলতাহানি সম্পর্কিত অপরাধ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।


ভারতে মুসলিম নারীকে রাস্তায় 'বোরকা খুলে হেনস্তার' ঘটনায় যা জানা যাচ্ছে - বিবিসি [ছয়জন মুসলিম গ্রেফ্তার]
দিন কয়েক আগে ঘটা এই ঘটনাটির ভিডিও প্রকাশ্যে আসে সম্প্রতি, ছবির উৎস,Rajkumar


আতঙ্কে রয়েছে পরিবার


ঘটনার পর থেকে ওই নারী এবং তার পরিবার আতঙ্কে রয়েছে।

তাদের বাড়িতে ওই নারীর মায়ের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। আমরা যখন তাদের বাড়িতে পৌঁছাই, তখন তার মা জানান, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে রয়েছেন তার মেয়ে। কারও সঙ্গে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই তিনি।

"আমার মেয়ের সঙ্গে কী কী হয়েছে, আপনারা নিশ্চয়ই তা ভিডিওতে দেখেছেন। ও আর কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। এখনও বিয়ে হয়নি আমার মেয়ের। ঘটনার পর থেকে খুবই আতঙ্কে রয়েছে সে," 

তার মা বলেছিলেন।

তাদের পরিবারের আর্থিক সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 

"আমার ছয় সন্তান। তাদের মধ্যে পাঁচজন মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে।"

"আমার স্বামী আট বছর আগে মারা গিয়েছেন। তাই সংসারের সব খরচ আমাদেরই চালাতে হয়।"

তিনি জানান, গত কয়েক মাস ধরে তার সঙ্গে ব্যাংকে কাজ করছেন শচীন নামে ওই ব্যক্তি। ওইদিন তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে কাজে যান শচীন। তারপরই এই ঘটনা ঘটে।

অভিযুক্তদের পরিবার কী বলছে?


এই ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্তদের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন আর্শ নামে স্থানীয় বাসিন্দা। তার মা বলেছেন, 

"মেয়েটির সঙ্গে যা ঘটেছে তা অন্যায়, কিন্তু এতে আমার ছেলের কোনো দোষ নেই।"

"ও গিয়ে ঘটনাস্থলে শুধু দাঁড়িয়েছিল। বর্তমানে লেখাপড়া করছে আমার ছেলে। ওর জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা ন্যায়বিচার চাই।"

প্রসঙ্গত, এই ঘটনায় পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করেছে, তাদের বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

ঘটনাটি যে দোকানের সামনে ঘটেছিল, সেই দোকানের মালিক নওশাদ। তিনি জানিয়েছেন, তার দুই কর্মচারীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

নওশাদের দাবি, তার দোকানে কর্মরত দুইজন হেনস্থার শিকার ওই নারীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করা হয়েছে।

তিনি বলেন, 

"কিছু লোক জোর করে আমার দোকানে ঢুকে ভিক্টিমকে (হেনস্থার শিকার নারীকে) মারধর করছিল। আমার কর্মচারীরা তাদের বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।"


স্থানীয় কাউন্সিলর নওশাদ পাহলওয়ান ঘটনাটির নিন্দা করেছেন ছবির উৎস, Rajkumar
স্থানীয় কাউন্সিলর নওশাদ পাহলওয়ান ঘটনাটির নিন্দা করেছেন ছবির উৎস, Rajkumar


স্থানীয়দের বক্তব্য


যে এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানকার কাউন্সিলর নওশাদ পাহলওয়ান বলেন, 

"মা-মেয়ে একটি স্মল ফিন্যান্স কোম্পানির ঋণ সংক্রান্ত বিষয়ে কাজের জন্য এই এলাকায় আসতেন। একজন ব্যাংক কর্মীর সঙ্গে মেয়েটিকে দেখে ভুল বোঝাবুঝির ফলে তাকে (মেয়েটিকে) মারধর করা হয়।"

শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে অভিযুক্তরা তাদের মারধর করে বলে জানান তিনি।

তার কথায়, 

"বর্তমানে ঋণ দেওয়ার একটি প্রকল্প চলছে, সেখানে ওই মা-মেয়ে কাজ করেন। ওরা যে কাজে যাচ্ছে, সেটা কেউ ভাবেনি। শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে ওই ছেলে ও মেয়েটিকে দাঁড় করিয়ে মারধর করা হয়েছে। এটি অন্যায়।"

আমরা শচীনের সঙ্গেও কথা বলেছি। তিনি ঘটনার দিন হেনস্থার শিকার ওই নারীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

শুধু বলেছেন, 

"প্রশাসনের পদক্ষেপ ন্যায়সঙ্গত। ভিডিওতে যা দেখা যাচ্ছে তাই ঘটেছে।"

এই ঘটনার বিষয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া মিলেছে। স্থানীয় এক দোকানদার জানিয়েছেন, ঘটনাটি তাড়াহুড়োর মধ্যে ঘটেছিল। তার কথায়, 

"মেয়েটির সঙ্গে যা ঘটেছে, তা অন্যায়।"

স্থানীয় বাসিন্দা মুশাহিদ আলম খান এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। মি. খান অবশ্য পুলিশ ও প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপের প্রশংসা করেন।

ওই এলাকার আরেক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, 

"আমাদের শহর শান্ত, এমন আকস্মিক ঘটনায় আমরাও দুঃখিত। কিন্তু যারা এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই বয়স কম।"

সূত্র: বিবিসি

Post a Comment

0 Comments