রামায়ণ এক মহাকাব্যঃ বৌদ্ধোত্তর নাকি বৌদ্ধপূর্ব? - ঐতিহাসিক বিচার : নিলয় চৌধুরী

রামায়ণ এক মহাকাব্যঃ বৌদ্ধোত্তর নাকি বৌদ্ধপূর্ব? - ঐতিহাসিক বিচার : নিলয় চৌধুরী
 

যুগ যুগান্তর ধরে এই উপমহাদেশের শিশুগণ পিতামহী হতে যে রামায়ণ কাহিনি শুনে এক সত্য ও আদিম কল্পের কল্পনা করে আসছিলো, তারপর হঠাৎ সুসভ্য ইংরেজগণ এলেন, দেশকে ইংরেজি শিক্ষায় সুশিক্ষিত করলেন, আর্য-আক্রমণ তত্ত্বের অবতারণা করলেন! ব্যাস! রাম হয়ে গেলেন আর্য এবং রাবণ হয়ে গেলেন অনার্যের প্রতিনিধি। ব্রিটিশ গুরুমহাশয় বললেন - রাম নামে কোন নৃপতি যে অযোধ্যার সিংহাসন অলঙ্কৃত করেছিলেন, সে বিষয়ের প্রমাণাভাব। রাম-লক্ষ্মণ প্রভৃতি চরিত্রসমূহ কবির স্বকপোল-প্রসূত। আর্যের সহিত অনার্য সংঘর্ষ অবলম্বন করে, আর্য-সভ্যতাবিস্তারের কাহিনী এতে গল্পের ছলে বিবৃত হয়েছে মাত্র! Mrs. Manning মতে রামায়ণ আর্য-সভ্যতা-বিস্তারের ঐতিহাসিক কাহিনী। দাক্ষিণাত্যে আর্য-সভ্যতা রামায়ণের কাল হতেই বদ্ধমূল হয়। অনার্যরাজ রাবণের ভ্রাতা বিভীষণকে ব্রাহ্মণ্যধৰ্মে দীক্ষিত করে রামচন্দ্র মালবারের সন্নিহিত ভূখণ্ডে আর্যসভ্যতা স্থাপন করেন। (দ্রষ্টব্যঃ Ancient fand Mediæval India Vol II. P 25)


তিনি অবশ্য রাম-চরিত্রকে কাল্পনিক বলে মনে করেন না। তবে আমাদের দেশীয় মহাত্মাগণও সেই জোয়ারেই গা ভাসিয়েছেন বটে! স্বর্গীয় রমেশচন্দ্র দত্ত মহাশয়ের অভিমত-


 "The Ramayan, then likes the Mahabharata, is utterly valueless as a narrative of historical events and incidents. As in the Mahabharata, so in the Ramayan, the heroes are myths, pure and simple" - ("Ancient India" P- 147-148)


বিধির কি বিভৎস বিধান! ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত রাম হয়ে গেলেন আর্য অথচ ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রীজপা ব্রাহ্মণ রাবণ কিনা অনার্য! যতই সাহেবদের Aryan Invasion Theory ব্রাহ্মণাদি ত্রিবর্ণের আর্যত্ব আর শূদ্রের অনার্যত্ব বিধান করুক, রাবণের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীগণ যতই তাঁর মস্তক কোলে নিয়ে "হায় আর্য" বলে ক্রন্দন করুক, হিন্দু পৌরাণিক যুদ্ধ বলে কথা! প্রয়োজনে নিজেদের প্রস্তাবিত তত্ত্বের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও নায়ককে অত্যাচারী আর্য আর খলনায়ককে নিপিড়ীত অনার্য যে প্রমাণ করাই লাগবে! অপরদিকে বৌদ্ধ শাস্ত্রবিদ রিস ডেভিডস, বেবর, জেকোবী, হন্টার প্রমুখের মতে বৈদিক দেবতাগণের ন্যায় রামায়ণ চরিতগুলোও কবির মনঃকল্পিত। বাস্তব-জগতে তাঁদের কোন অস্তিত্ব নাই। বেদে যেরূপ কৃষির উন্নতির জন্য নানা দেবতার কল্পনা করা হয়েছে, রামায়ণে বর্ণিত কাহিনীও সেইরূপ কৃষিবিষয়ক উন্নতির রূপক ব্যাখ্যা মাত্র।


হন্টার সাহেবের কথা এই - 


"The heroine of the Rama- yan, Sita, literally the field furrow. She represented the Aryan husbandry and has to be defended against the raids of the aborigines by the hero, Rama. From this abstract point of view, the Ramayan exhibits the progress of the Aryan plough- husbandry." - ("Hunter's History")


 Indian Antiquary গ্রন্থে Weber, এবং Pickford ঠিক এই কথাই বলেছেন। যাক সে কথা। রামায়ণকে কবিকল্পনা, আর্য-অনার্যের সংঘাত, কৃষি-উন্নতির রূপক প্রভৃতি বলেও সাহেবদের তৃপ্তি হলোনা। রামায়ণকে আধুনিক এবং বৌদ্ধদের নিকট হতে ধার করা - এটাও প্রমাণ করা লাগবে যে! তাই জার্মান পণ্ডিত বেবার প্রতিপন্ন করতে চাইলেন- বৌদ্ধদিগের দশরথ জাতকের মূল উপাখ্যান নিয়েই রামায়ণের উপাখ্যানাংশ পরিপুষ্ট হয়েছে। (দ্রষ্টব্যঃ Weber's Sanskrit Literature)


 অবশ্য বৌদ্ধশাস্ত্র দশরথ জাতকের সাথে রামায়ণের স্থলবিশেষে সাদৃশ্য লক্ষ্য করেই তিনি এই মত প্রচার করেছিলেন। এর প্রত্যুত্তরে আমাদের বক্তব্য এই যে- পুস্তকদ্বয়ের মধ্যে সাদৃশ্য থাকলেই বলা চলে না যে দশরথ জাতক রামায়ণের পূর্ববর্তী। কোন অনুমানের উপর নির্ভর করে এত বড় একটা যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে যাওয়া বিড়ম্বনা মাত্র। এতদ্ভিন্ন রামায়ণকে বৌদ্ধযুগের পূর্ববর্তী বলে দাবি করার পক্ষে যথেষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে বৈকি।  রামায়ণ যুগের সভ্যতা, সমাজ ও জনপদসমূহের আলোচনা করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, রামায়ণের রচনাকালে বৌদ্ধযুগ ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত ছিল। নতুবা আমরা রামায়ণের কোন স্থলে না কোন স্থলে বৌদ্ধ জনপদসমূহের উল্লেখ দেখতে পেতাম। যে সমুদায় প্রসিদ্ধ জনপদ বৌদ্ধধর্মের উত্তরকালে সৃষ্ট হয়েছিল, রামায়ণযুগে তাদের অস্তিত্ব থাকলে আদিকবি জনপদপ্রসঙ্গে নিশ্চয়ই সেগুলোর উল্লেখ করতেন। 


Sirdar Mudhao Rao V. Kebb Saheb M.A. এর অভিমত-


 "Pataliputra, the Capital of Magadh was founded about 380 B.C. is not mentioned in the Ramayana although other cities such as Kausambi and Kanyakubja are referred to in it. The name of the Capital of Kosala is invariably given in the Ramayan as Ajodhya which in Budhist time was designated as Saketa, Mithila and Visali are two separate cities while in Budha's time, they had coalesced into one."  ( Modern Review for 1910).


এরপর বলা যায় রামায়ণে বৌদ্ধধর্মের প্রকৃতি ও সভ্যতাগত সাদৃশ্যের একান্তই অভাব। শ্রী চিন্তামন বিনায়ক বৈদ্য এই প্রসঙ্গে লিখেছেন -


"The worship of Vaidic deities, the preponderance of sacrifice, the free eating of flesh by Brahmins and Kshatriyas, the latter's proficiency in the Vadas and the Vedic deities, all show a state of society, and a cıvilization, a religion, uncontaminated by feelings and ideas which nad their rise in Budhism." - (The Riddle of the Rāmāyaṇa) 


রামায়ণসমাজ ও বৌদ্ধসমাজের পার্থক্য হতেও বৌদ্ধসমাজ হতে রামায়ণকালের প্রাচীনতা নির্ধারিত হয়। 


শ্রীসুরেন্দ্রনাথ মিত্র লিখেছেন - 


"রামায়ণ পাঠে জানিতে পারা যায় যে, তৎকালে ভারতে বেদের প্রতি সাধারণের সমধিক শ্রদ্ধা ছিল। অযোধ্যা বর্ণনাপ্রসঙ্গে অযোধ্যা- বাসীর পরিচয় দিবার কালে কবি বলিয়াছেন যে, অযোধ্যাবাসী বেদপাঠ- নিরত ও সত্যবাদী। ইহার দ্বারা বুঝিতে হইবে যে, যে শক্তিমান পুরুষের আবির্ভাবে বৈদিক ক্রিয়া কৰ্ম্ম লোপ পাইয়াছিল, তখনও সেই অহিংসাবাদী বুদ্ধদেব ও তৎপ্রচারিত বৌদ্ধধৰ্ম্ম ভারতে দেখা দেয় নাই। রামায়ণে বহু স্থানে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হইতে দেখিয়া নিঃসন্দেহে বলিতে পারা যায় যে, ভারতে তখন বর্ণাশ্রম সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।"

- ("রামায়ণ যুগের ভারত" পৃঃ ২৬)


তবে রামায়ণের এক স্থলে বৌদ্ধমতের উল্লেখ পাওয়া যায় বটে। যথা রামকে ফেরত নেওয়ার আশায় তাঁকে যখন নাস্তিক জাবালি চার্বাকীয় উপদেশ দিচ্ছিলেন তখন জাবালির প্রতি রামের বচন দেখা যায়- 


"যথা হি চৌরঃ স তথাহি বুদ্ধ-

স্তথাগতং নাস্তিকমন্ত্র বিদ্ধি।

তস্মাদ্ধি যঃ শক্যতমঃ প্রজানাম্ স নাস্তিকে নাভিমূখো বুধঃ স্ন্যাৎ।" - (অযোধ্যাকাণ্ড- ১০৯/৩৪)


অর্থাৎ চোর যেরূপ দণ্ডার্হ, বুদ্ধমতানুসারী তথাগত নাস্তিক এবং আপনিও সেইরূপ দণ্ডার্হ জানবেন। প্রজাগণের বুদ্ধি পরিশুদ্ধির জন্য নাস্তিক দণ্ডিত করা রাজার কর্তব্য। পণ্ডিত ব্যক্তি নাস্তিকের সহিত আলাপ করে না।


এক্ষেত্রে আপত্তি থেকেই যায় যে রামায়ণ বুদ্ধ পূর্ববর্তী হলে রামের মুখে বুদ্ধের নাম কেন? উত্তর এই- বৌদ্ধদের অভিমত অনুসারেই শাক্যমুনির পূর্বে আরও ২৭ জন বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটেছে। বৌদ্ধমতে যিনি সমস্ত গুরুদের মধ্যে সর্বপ্রধান, যিনি জগৎগুরু, বৌদ্ধরা তাঁকে বোধিসত্ত্ব বলেন। বোধিসত্ত্ব হতে বৌদ্ধত্ব হয়। যাঁরা বৌদ্ধত্বরূপ মহা উৎসর্গ করতে প্রতিশ্রুত হয়েছেন তাঁদেরও বুদ্ধ বলা হয়। এঁরা মনুষ্য-বুদ্ধ। আর যাঁর নিকট বোধিসত্ত্ব বৌদ্ধত্ব-রূপ মহা-উৎসর্গ-ব্রত গ্রহণ করেন, যাঁকে সাক্ষী করে বোধিসত্ত্ব বুদ্ধ হবার অঙ্গীকার করেন, তাঁকে ধ্যানি-বুদ্ধ বলা হয়। আমাদের শাক্যমুনি মনুষ্যবুদ্ধ। তাঁর পূর্বসূরি হিসেবে  ক্রুকুচ্ছন্দ, কনকমুনি, কাশ্যপ সহ ২৭ জন বুদ্ধ এবং উত্তরসুরী হিসেবে মৈত্রেয় বুদ্ধ। সুতরাং রামবচনে উল্লিখিত বুদ্ধকে সিদ্ধার্থ বুদ্ধ বা শাক্যমুনিকে বিবেচনা করাটা কি খুবই যুক্তিসঙ্গত? যদি বলা হয় তবে তথাগত পদের প্রয়োগ কেন? বলবো-  বৌদ্ধশাস্ত্রেই গৌতম বুদ্ধের পূর্ববর্তী ছয়টি তথাগতের উল্লেখ আছে। যথাঃ  বিপশী বুদ্ধ , সিখী বুদ্ধ , ভেসস্ভূ বুদ্ধ , ক্রুকুচ্ছন্ধ বুদ্ধ , কোণাগমন বুদ্ধ এবং কাশ্যপ বুদ্ধ। সুতরাং রামকথিত তথাগত বুদ্ধপদেও গৌতম বুদ্ধের অনুমান হয়না। যদিও না এই একাধিক বুদ্ধ ঐতিহাসিক ব্যক্তি নন, প্রামাণ্য ইতিহাস গৌতম বুদ্ধ ছাড়া আর কোনো বুদ্ধের স্বীকৃতি দেয়না। তাই সংযোজন হিসেবে আরও উল্লেখ করবো বেদান্তরত্ন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর "বুদ্ধদেবের নাস্তিকতা" গ্রন্থে এবং শ্রীসুরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর "রামায়ণ যুগের ভারত" গ্রন্থে এই শ্লোককে প্রক্ষিপ্ত বলে উল্লেখ করেছেন। যদিও  প্রক্ষিপ্ততার প্রমাণ হিসেবে তাঁরা কিছুই উল্লেখ করেননি তাই অগত্যা নিজেকেই অনুসন্ধান করতে হলো - উপরিউক্ত শ্লোকটি Oriental Institute of Baroda হতে প্রকাশিত রামায়ণ এর ক্রিটিক্যাল এডিশনে পাওয়া যায়না। এই শ্লোকের উল্লেখ কোনো উত্তর ভারতের পাণ্ডুলিপিতে দৃষ্ট হয়না । এমনকি দক্ষিণী মালায়লাম পাণ্ডুলিপিতেও নেই। সুতরাং শ্লোকটিতে প্রক্ষিপ্ত ঘোষণা নির্দ্বিধায় করাই যায়। অতএব প্রমাণ হলো রামায়ণ বৌদ্ধযুগের বহু পূর্ববর্তী সাহিত্য বা ইতিহাস। সমসাময়িক বা পরবর্তী তো নয়ই। সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো দশরথ জাতক খুব সংক্ষিপ্ত এক উপাখ্যান মাত্র আর রামায়ণ মহাকাব্য। মহাকাব্য হতে উপাখ্যান রচনার দৃষ্টান্ত ভুরি ভুরি থাকলেও বিপরীতক্রমে উপাখ্যান হতে মহাকাব্য রচনার দৃষ্টান্ত আছে কি? বলতেই হয় রামায়ণের অনুলিপনেই জাতককার স্বীয় প্রতিভা সংযোজনে দশরথ জাতক রচনা করেছেন। এর উল্টোটা কদাপি নয়।


প্রবন্ধের অন্তে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের ঐতিহাসিকত্ব নিয়ে বক্তব্য এই - 


 "Both Rama and Krishna appear to have been tribal heroes, mythical perhaps but not products of Mythology. But as no attempt has ever been made to separate myth from history in India it is impossible to say whether Krishna the divine hero of the Mbh. ever really existed through this is probable."

- (Camb, Hist. Ind. Vol 1 pp. 258-59)


অর্থাৎ পশ্চিমা ঐতিহাসিকগণের নিকট  শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরামের সম্ভাবনা অন্তত সম্ভাব্যতা পর্যায়ে পৌঁছেছে! এই অনেক। আশায় বুক বাঁধি - প্রত্নতত্ত্ব গবেষণার ক্রমোন্নতি একদিন মর্যাদা পুরুষোত্তমের ঐতিহাসিকত্ব সমগ্র বিশ্বের নিকট তুলে ধরবে। কিন্তু সে সুদিন যত দিনে আসার আসুক, ভগবান শ্রীরাম সমগ্র ভারতবাসীর অন্তরের স্ফূলিঙ্গ। তাঁর নামেই হৃদয়ে আগুন জ্বলে, দুষ্ট তাঁর নামেই ভীত হয়, তাঁর ঐতিহাসিকত্ব যাই হোক, তিনি আছেন, এই বিশ্বাসই ভারতকে পুনরায় বিশ্বগুরু করবে।


পরিশেষে এই প্রবন্ধের সমস্ত কৃতিত্ব আমার পরমারাধ্যা দুর্গাদেবীর শ্রীচরণে উৎসর্গ করে প্রবন্ধের ইতি টানলাম।


লেখকঃ নিলয় চৌধুরী



সূত্র লিংক

Post a Comment

0 Comments