ফার্সি ও উর্দু ভাষায় রামায়ণ

ফার্সি ও উর্দু ভাষায় রামায়ণ
 

সনাতন হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ রামায়ণ। এটি শুধু ধর্মীয় গ্রন্থই নয়, বরং এটি একটি নৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিফলন। যুগের পরিবর্তনের সাথে তাই রামায়ণ একটি মাত্র ভূখণ্ডে বা একটি ভাষায় আবদ্ধ থাকেনি। রামায়ণ পৌঁছে গিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন খন্ডে, অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। সেরকমই মধ্যযুগের এক অসামান্য নিদর্শন হলো ফারসী রামায়ণ।


মুঘল সম্রাট আকবরের সময়কালে রামায়ণের ফারসী ভাষায় অনুবাদ ভারতীয় প্রাচীন ইতিহাস এবং সংস্কৃতিকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। আকবর মহাভারত ও রামায়ণ অনুবাদের ভার দেন মোল্লা বদায়ুনীর ওপর। প্রথমে ফারসীতে “রজমনামা” নামে মহাভারত অনুবাদ সম্পন্ন করে ১৫৮৫ সালে তিনি রামায়ণ অনুবাদ শুরু করেন। চার বছর পরে, ১৫৮৯ সালে তিনি পদ্যে রামায়ণের ফারসী অনুবাদ সম্পন্ন করলে আকবর চিত্রশিল্পীদের দ্বারা সেই অনুবাদকৃত রামায়ণটি সুসজ্জিত করে নিজের পুস্তকালয়ে রেখে দেন এবং সম্রাটের তৎকালীন আমীর ও সভাসদরা প্রত্যেকে সেই রামায়ণের এক এক খন্ড গ্রহণ করেন।


ফারসীতে রামায়ণের দ্বিতীয় অনুবাদের নাম- “রামায়ণ ফৈজী” । এর অনুবাদক কে, তা জানা যায়না। তবে এটি বদায়ুনীর অনুবাদ থেকে একদম পৃথক ছিল। যেখানে বদায়ুনীর অনুবাদ সম্পূর্ণ পদ্যে ছিল, সেখানে এই “রামায়ণ ফৈজী” ছিল বেশিরভাগই গদ্যে এবং আংশিক পদ্যে।


রামায়ণের তৃতীয় অনুবাদক মোল্লা মসীহ। তিনি পানিপথের নিবাসী ছিলেন এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে রামায়ণের ফারসী অনুবাদ করেন। তাঁর অনুবাদ ছিল পদ্যে, এবং নাম ছিল “রামায়ণ মসীহী”।


তবে ফারসী ভাষায় যে শুধু মুসলিমরাই রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন, এমন নয়। ফারসী রাজভাষা বা দাপ্তরিক ভাষা হওয়ার কারণে হিন্দুদেরও এই ভাষা শিখতে হত, এবং অনেক হিন্দু ব্যক্তিও ফারসীতে রামায়ণ অনুবাদ করেছেন। এমন একজন হলেন শ্রী চন্দ্রভাল বেদিল। উনাকে রামায়ণের চতুর্থ অনুবাদক হিসেবে বলা যায়। তিনি ১৬৯৩ সালে, আওরঙ্গজেবের আমলে পদ্যে রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন। তবে ভিন্নমতানুসারে, তিনি ১৬৮৫ সালে প্রথমে গদ্যে রামায়ণ অনুবাদ করেন যা পরবর্তীতে বিলুপ্ত হয়ে যায়।


রামায়ণের পঞ্চম অনুবাদক হলেন লালা অমরসিংহ। তিনি ১৭৮৩ বা মতান্তরে ১৭০৫ সালে গদ্যে রামায়ণের ফারসী অনুবাদ করেন। নাম দেন – “রামায়ণ অমর প্রকাশ”। ষষ্ঠ অনুবাদক হিসেবে পাই লালা অমানত রায়কে। নবাব আমজাদ আলী ও তার পরিবারের সহযোগিতা এবং পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি প্রথমে শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ ফারসীতে অনুবাদ করেন। সেটি যথেষ্ট সমাদৃত হলে ১৭৫৪  সালে তিনি পদ্যে রামায়ণের ফারসী অনুবাদ করেন। এই অনুবাদ এতই সুন্দর ও অনবদ্য ছিল যে একে তৎকালীন সময়ে ফিরদৌসীর মহাকাব্য “শাহনামা”-র সাথে তুলনা করা হত। এছাড়াও গোবিন্দের পুত্র গোপাল “তরজুমা-ই-রামায়ণ” নামে ১৭ শতকের প্রথমার্ধে রামায়ণ অনুবাদ করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে, শ্রীতুলসীরাম দাসের সমসাময়িক গিরিধরদাস পদ্যে রামায়ণের ফারসী অনুবাদ করেন।


রামায়ণের আরেকটি ফারসী অনুবাদ সম্পর্কে জানা যায়, যার অনুবাদক লাহোরের বিখ্যাত পন্ডিত বেলীরাম মিশ্রের পুত্র পন্ডিত রামদাস। তিনি ১৮৬৪ সালে রামায়ণের ফারসী অনুবাদ করেন, তবে সেই অনুবাদ এখনো মুদ্রিত হয়নি। এমন আরো অনেক অনেক অনুবাদের পাণ্ডুলিপি এখনো অমুদ্রিত অবস্থায় পড়ে আছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন পাঠাগারে। কোনোদিন সেগুলোকে মুদ্রণের ব্যবস্থা করা হলে বা সেগুলোর ওপর গবেষণা হলে হয়ত আমরা মধ্যযুগীয় সাহিত্যের ওপর ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রভাব ও অবদান সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে পারবো।


উর্দু ভাষায় রামায়ণ অনুবাদ বা রাম-সাহিত্য খুব একটা দেখা যায়না। অল্প কিছু সাহিত্যের মধ্যে ১৯ শতকের প্রথমার্ধে রচিত চারটি রামায়ণের কথাই উল্লেখযোগ্য।


- মুন্সী জগন্নাথ খুস্তারা রচিত – “রামায়ণ খুস্তারা” (১৮৬৪) ।

সকল উর্দু রামায়ণের মধ্যে এটিকেই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং জনপ্রিয় বলা হয়।

- মুন্সী শঙ্কর দয়াল ফরহাত রচিত – “রামায়ণ ফরহাত” ।

- বাঁকেবিহারী লাল বহার রচিত – “রামায়ণ বহার” ।

- সুরজ নারায়ণ মেহের রচিত – “রামায়ণ মেহের” ।


উক্ত রামায়ণগুলো সরাসরি অনুবাদ নয়, বরং এগুলো একক সাহিত্য এবং এগুলোতে বাল্মিকি রামায়ণ, রামচরিতমানস সহ অন্যান্য রামায়ণের প্রভাব বিদ্যমান। উর্দু রামায়ণগুলোকে রামায়ণের অনুবাদ না বলে রামায়ণ-আশ্রিত সাহিত্য বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত।


- শাস্ত্র গবেষণা কমিটি

সনাতন ফিলোসফি এন্ড স্ক্রিপচার (SPS)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ