কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সরা প্রসঙ্গে

লক্ষ্মীপুজোর সরা। সূত্র: উইকিপিডিয়া 


কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো অনেকেই সরায় করেন। আগে ১৩ রকমের সরা তৈরি হত। এখন তা ৬ রকমে ঠেকেছে। একলক্ষ্মী সরায় থাকে লক্ষ্মীর দুপাশে পদ্ম, নীচে প্যাঁচা। সে আবার উড়ছে। তিন পুতুল সরাতে লক্ষ্মীর দুপাশে দুজন সখী থাকে। এটাতেও নীচে থাকে প্যাঁচা। ঢাকাই সরা নানা রকমের হয়। কোনওটাতে জোড়া লক্ষ্মী থাকে, কোনওটাতে পাঁচ লক্ষ্মী, কোনওটাতে আবার লক্ষ্মীর সঙ্গে থাকেন চার সখী কিংবা রাধাকৃষ্ণ। দুর্গা সরাকে আড়াআড়ি দুভাগে ভাগ করা হয়। ওপরে সপরিবারে মা দুর্গা, তার ওপরে শিবের মুখ, নীচে প্যাঁচা–সহ লক্ষ্মী, আলাদা করে। এই দুর্গা সরার আর একটি রকম বা প্রকার হল গণকা বা আচার্যি সরা। সুরেশ্বরী সরায় আবার দুর্গার পরিবারের প্রত্যেকের ছবি আলাদা আলাদা করে আঁকা থাকে।


দীপঙ্কর পাড়ুই লিখছেন -


"চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ শতকের মঙ্গলকাব্যেও লক্ষ্মীপূজা ও প্রতিমার নানা প্রসঙ্গ ধরা পড়েছে। সরায় লক্ষ্মীপূজা মূলত পূর্ববঙ্গে অনুষ্ঠিত হতো কিন্তু দেশভাগ, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে পূর্ববঙ্গের বহু শিল্পী এপার বাংলায় চলে আসেন। ফলত এই বঙ্গেও সরাপট নির্মাণ ও পূজা শুরু হয়। শিল্পীরা সরাপটের ঐতিহ্য এপার বঙ্গে নিয়ে আসেন, ফলে সেইসঙ্গে এপার বঙ্গের বেশ কিছু আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ও চালচিত্রের শৈলীও সরাচিত্রে মিশে যায়। পূর্ববঙ্গে প্রধানত চাররকমের সরা নির্মিত হতো, যথা—


  • (১) ফরিদপুরী, 
  • (২) সুরেশ্বরী, 
  • (৩) আচার্যী বা গণকা ও 
  • (৪) ঢাকাই সরা। 


কিন্তু লক্ষ্মীসরা অঙ্কনের ক্ষেত্রে শিল্পীদের নিজস্ব ভাষায় কিছু ধরণ রয়েছে। যথা— একলক্ষ্মী সরা বা একপুতলা সরা, দুইপুতলি সরা বা জোড়া লক্ষ্মী সরা, তিনপুতলা বা পুতলি সরা, চারপুতলি বা যুগল সরা, পাঁচপুতলি লক্ষ্মী বা পাঁচপুতলি সরা, গজলক্ষ্মী সরা, সাতপুতলি লক্ষ্মীসরা, আটপূজারিনি-সহ লক্ষ্মী ইত্যাদি।


পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার তাহেরপুরের তিনপুতলি সরা সাদা, নীল ও লাল পার্শ্বদৃশ্যের (ব্যাকগ্রাউন্ড) ওপর উপস্থাপিত হয়, লক্ষ্মীদেবী পদ্মের ওপর সুখাসনে বসে থাকেন। মুখের আকার থ্রি-কোয়ার্টারস্ ভঙ্গিতে আঁকা হয়। দুই পাশে দুই সখীর মুখ কখনো প্রোফাইল (পার্শ্বমুখ) বা ফ্রন্টাল (সামনাসামনি) ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়। প্রোফাইল ভাবে আঁকাটিকে শিল্পীরা আদি ফর্ম বা পুরানো ধারা বলে থাকেন।


সরাকে আবার কখনো দুটি ভাগ করে নিয়ে ওপরে দুই সখীসহ লক্ষ্মীদেবী এবং নিচে লক্ষ্মীদেবীর বাহন পেঁচাকে আঁকা হয়। কলকাতার কুমারটুলিতে তিনপুতলি একটু অন্যরকম, সরার পার্শ্বদৃশ্য লাল (কখনো নীল) রঙের। উপরিভাগে চাঁদোয়া টাঙানো, মাঝে মুঘল অনুচিত্রের মতো ফুলকারী নকশা, লক্ষ্মীদেবী পদ্মফুলের ওপর ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকেন। কাপড় পরার শৈলীটি বাংলার পাড়াগাঁয়ের মহিলাদের মতো আটপৌরেভাবে অঙ্কিত।


এই সরাটি সাতপুতলি লক্ষ্মীসরা। সাতপুতুল অর্থে দুর্গা, সিংহ, মহিষাসুর, লক্ষ্মী, গণেশ, সরস্বতী ও কার্তিক। এটি দুর্গাসরা হলেও একে লক্ষ্মীসরাই বলা হয়। কারণ নীচের দিকে লক্ষ্মীদেবী অবশ্যই আঁকতে হবে। সরাটি দুর্গা ও লক্ষ্মী দুই পূজাতেই ব্যবহৃত হয়। সাতপুতলি এই সরায় দুর্গার দুই রকম প্রতিকৃতি দেখা যায়। শিল্পীদের ভাষায়— (ক) একচোখো দুর্গা, অর্থাৎ দুর্গার মুখাবয়বটি একদিকে পাশ ফেরানো, ইংরেজিতে বলে ‘প্রোফাইল' ভঙ্গিতে আঁকা। লক্ষ্মীদেবীর মুখাবয়বও এই ভঙ্গিতে আঁকা হয় অনেক সময়। (খ) দু-চোখো দুর্গা : সামনাসামনিভাবে তাকিয়ে থাকা দুর্গার প্রতিকৃতিও শিল্পীরা এঁকে থাকেন। এটিতে এক- তৃতীয়াংশভাবে দুর্গার মুখাবয়ব আঁকা থাকে। এই ভঙ্গিকে ‘সামনাসামনি' বলা যায়। যেহেতু সামনে থেকে দুটো চোখই দেখা যায়, তাই শিল্পীরা বলে থাকেন ‘দু- চোখো দুর্গা'। ইংরেজিতে বলে 'ফ্রন্টাল ফেস'। এরকম মূর্তি শিল্পীরা আঁকেন, কারণ যাঁরা সরা কিনে থাকেন তাঁদের পারিবারিক বিধান বা ঐতিহ্য রয়েছে একচোখো বা দু-চোখো পূজা করার। তাই শিল্পী তাঁদের কথা মাথায় রেখেই এমনটা এঁকে থাকেন"


এখন কথা হল, কেন এই সরায় পুজো?


সম্ভাব্য কারণ দুটো। এক, সরা গর্ভবতী নারীর প্রতীক। এর সঙ্গে উৎপাদনশীলতা আর সমৃদ্ধির যোগ আছে। দুই, সরা হল পৃথিবীর পিঠ। বসুন্ধরার পুজোই লক্ষ্মীপুজো, সেজন্যও এই আয়োজন।


উৎস-

  • ১। ধন্য কলকেতা সহর। কৌশিক মজুমদার। আখরকথা
  • ২। বাংলার লক্ষ্মীসরা- দীপংকর পাড়ুই। উদ্বোধন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ