‘পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের চোখে রবীন্দ্রনাথ’ –রানা চক্রবর্তী

‘পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের চোখে রবীন্দ্রনাথ’ –রানা চক্রবর্তী

গোড়াতেই জানিয়ে রাখি যে এটা কোন একক প্রবন্ধ নয়। এখানে আমি অতীতের একাধিক লেখকের লেখা একই বিষয়ের প্রবন্ধ থেকে তথ্য তুলে ইতিহাসের খাতিরে ব্যবহার করেছি। তাঁদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন, আহমদ ছফা, কাজী আবদুল ওদুদ ও গোলাম মুরশিদ অন্যতম। আমার জানা নেই যে, এঁদের লেখাগুলো এখন কেউ পড়েন কিনা। কিন্তু অতীতে এবিষয়ে তাঁরা যে কথাগুলো লিখে গিয়েছেন, সেগুলো এখনও চূড়ান্ত বাস্তব। তাই শুরুতেই কাজী আবদুল ওদুদের ‘শ্বাশ্বত বঙ্গ (নির্বাচিত প্রবন্ধ)’ গ্রন্থের ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান’ সমাজ শিরোনামের প্রবন্ধটির কিছুটা অংশ তুলে ধরে এই আলোচনার শুরু করা যাক—

“এই দিনে কোনো কোনো শিক্ষিত মুসলমান বাঙালির মুখেও শুনতে পাওয়া গেছে এই প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথ একজন অতি বড় কবি, মহামানব, বিশ্বপ্রেমিক, কিন্তু তার বাড়ির কাছের মুসলমানদের জন্য তিনি কি করেছেন?

এরূপ প্রশ্ন বহুবার আমাকে শুনতে হয়েছে। কিন্তু একবার একজন শ্রদ্ধেয় মুসলিম সাহিত্যিক এ প্রশ্নের উত্তরে যা বলেছিলেন তা মনে রাখবার মতো; তিনি বলেছিলেন: আকাশের সূর্য মুসলমানের জন্য বিশেষ কি করেছে? (‘আমাদের দুঃখ’ প্রণেতা আনোয়ারুল কাদীর)

রবীন্দ্রনাথের এই ধরনের সমালোচকদের উক্তির এইই হয়ত শ্রেষ্ঠ প্রত্যুত্তর। কবি আকাশের সূর্যের মতোই একজন সহজ মানব বন্ধু। অবশ্য যেহেতু কবি একজন মানুষ, এক বিশেষ পরিবেষ্টনের সৃষ্টি, সেজন্যে অত্যন্ত কাছে থেকে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে আলোকের উৎস সূর্যেও ধরা পড়ে কালো দাগ। যে গোলাপ সৌষ্ঠব আর গন্ধে অতুলনীয় তার স্পর্শ লোভাতুর লাভ করে হাতে কাটার আঘাত। কিন্তু কালো দাগ সত্ত্বেও সূর্য সূর্যই। কাঁটা সত্ত্বেও গোলাপ গোলাপই। এক বিশেষ পরিবেষ্টনে জন্ম সত্ত্বেও কবি চিরন্তন মানব—তাঁর পরিবেষ্টনের সমস্ত সীমারেখা অবলীলাক্রমের অতিক্রম করে তাতে উৎসারিত হয় মানুষের চিরন্তন সুখ, চিরন্তন দুঃখ, চিরন্তন প্রেম, চিরন্তন অভয়। যেহেতু রবীন্দ্রনাথ কবি, এবং যেহেতু মুসলমান মানুষ, সেজন্যে মুসলমান তার আজকার বিশেষ ঐতিহাসিক বিবর্তনের প্রভাবে বুঝুক আর নাই বুঝুক, রবীন্দ্রনাথ বাস্তবিকই তার পরম বন্ধু ব্যতীত আর কিছু নন।”

বিশ্বজয় করে নোবেল পুরস্কার পেলেও রবীন্দ্রনাথ কিন্তু পড়শি মুসলমানদের মন কিছুতেই জয় করতে পারেননি। বস্তুতঃ রবীন্দ্রনাথ মুসলিম সমাজে কখনো জীবিত ছিলেন না, সেখানে তিনি কার্যতঃ মৃত ছিলেন। তবে তিনি যে কখনো মুসলমানদের মন জয় করতে পারেননি, সেই অক্ষমতা যেমন তাঁর ছিল না, তেমনি সম্ভবতঃ মুসলমানদেরও ছিল না। বরং এর কারণ তৎকালীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশেই নিহিত ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেশবিভাগের পরে মৃত রবীন্দ্রনাথ যে পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজের কাছে হঠাৎই জীবন্ত হয়ে দেখা দিয়েছিলেন, সেটার কারণও সেই সময়কার সমাজ এবং রাজনীতিতেই খুঁজে পাওয়া যায়। আসলে যে কোন কারণেই হোক, বিভাগোত্তর পূর্ববাংলায় মৃত রবীন্দ্রনাথ জীবিত রবীন্দ্রনাথের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে ইতিহাসে দেখতে পাওয়া যায়।

ইতিহাস বলে যে, বিংশ শতকের গোড়ার দিকে মুসলমানদের মধ্যে শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষা নয়, সাধারণ শিক্ষার বিকাশও খুবই সামান্য ঘটেছিল। সেই সময়ে তাঁরা প্রধানতঃ গরিব কৃষিজীবী ছিলেন। তখন তৎকালীন সমাজের ওপর তলার দিকে তাকিয়ে তাঁরা সর্বত্রই হিন্দু জমিদার, হিন্দু মহাজন, হিন্দু সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি হিন্দু রাজনীতিকদের দেখতে পেয়েছিলেন। সমকালীন ইতিহাসের সাথে যাঁরা জ্ঞাত রয়েছেন, তাঁরা প্রায় সকলেই জানেন যে, সেইসব হিন্দুদের সবাই যে মুসলমানদের প্রতিবেশী বলে সোহাগ করতেন— সেটা কিন্তু নয়। বরং তাঁদের একটা বড় অংশের হাতে নিচের তলার মুসলমানরা অনেক সময়েই শোষিত এবং নিগৃহীত হয়েছিলেন। তবে এর থেকেও গুরুতর বিষয় হল যে, ছোঁওয়াছুঁয়ি নিয়ে কড়াকড়ি থাকবার জন্য সেযুগের মুসলমানরা মাঝেমধ্যে অপমানিত বোধও করেছিলেন। একারণে নিঃসন্দেহে কথা বলা যেতে পারে যে— শতাব্দীর পর শতাব্দী পাশাপাশি বাস করলেও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সেটাকে কিছুতেই ভ্ৰাতৃত্বের পরাকাষ্ঠা বলে বিবেচনা করা যায় না। তাছাড়াও, মীর মশাররফ হোসেন প্রদত্ত তথ্যানুসারে— শিক্ষার অত্যন্ত সীমিত বিকাশের ফলে সেযুগের মুসলমানদের মধ্যে নিজেদের বাঙালি বলে চিহ্নিত করবার মানসিকতাও তখনও পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। বাস্তবে নিজেদের পরিচয় নিয়ে ভাববার মত সচেতনতাও তখন তাঁদের মধ্যে দানা বেঁধেছিলো কিনা— সেবিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এবিষয়ে সমকালীন লিখিত যেসব প্রমাণ পাওয়া যায়, সেসব থেকে একথাই মনে হয় যে, খৃষ্টীয় আঠারো শতকের কবি আবদুল হাকিমের পরে আধুনিক যুগের বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেনই সম্ভবতঃ প্ৰথম ব্যক্তি ছিলেন, যিনি নিজের স্বরূপ সম্পর্কে নিজের কাছেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু তাঁর মত মুসলমান সেকালে কমই ছিলেন; উল্টো তখন তাঁরা বাংলায় কথা বললেও তাঁদের পূর্বপুরুষেরা বাংলায় কথা বলতেন কিনা এবং বাংলা আদৌ তাঁদের মাতৃভাষা কিনা— এসব নিয়ে বিংশ শতকের গোড়ার দিকেও রীতিমতো বিতর্ক করেছিলেন। বলা বাহুল্য যে, সেযুগের অমন পরিবেশে ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামধারী একজন কবিকে, অর্থাৎ— একজন হিন্দু কবিকে ভালোবাসা তো দূরে থাকুক, চিনতে পারাও কিন্তু তাঁদের পক্ষে সহজ ছিলো না। আর সেই কারণেই, তাঁদের হাতে রাখী পরিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তাঁরা যদি সেসবের তাৎপর্য যদি বুঝতে না পারেন, তাহলে তাতে আশ্চর্য হওয়ারও কিছু ছিল না। এমনকি ‘হিন্দু-মুসলমান এক হোক’ বলে রবীন্দ্রনাথ গান গাওয়া সত্ত্বেও, সেটার মর্ম তাঁরা কতটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন— সেবিষয়ে অতীতে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন।

তবে এবিষয়ে রবীন্দ্রনাথেরও সীমাবদ্ধতা ছিল। তিনি পূর্ববঙ্গের মুসলমান প্রজাদের মধ্যে দীর্ঘকাল বাস করেছিলেন, মুসলমান-প্রধান পূর্ববাংলার গ্রামগুলিতে বেশিরভাগ সময়েই বোটে চড়ে ঘুরে বেরিয়েছিলেন, কিন্তু তৎকালীন সমাজের উচ্চমঞ্চে সংকীর্ণ বাতায়নে বসে তিনি বোধহয় তাঁদের ঠিকমত বুঝতে পারেননি। যদিও তিনি মাঝেমাঝে মুসলিম পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে প্রবেশ করবার সাধ্য যেহেতু তাঁর ছিল না, সেহেতু তাঁদের সঙ্গে নিজের অন্তর মিশিয়ে তৎকালীন সমাজের নিচতলার মানুষদের অন্তরের পরিচয় তিনি যথার্থভাবে পাননি। অনেকের মতে এই কারণেই তাঁর কবিতা সর্বত্রগামী হতে পারেনি। কিন্তু জীবিত রবীন্দ্রনাথ যে কাজ করতে পারেননি, মৃত রবীন্দ্রনাথ সেই অসাধ্য সাধনই করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। আর সেকাজের জন্য তাঁকে অকৃপণভাবে ঊনিশশো সাতচল্লিশ সালের দেশবিভাগ সাহায্য করেছিল।

পরবর্তী ঘটনাক্রম গোলাম মুরশিদের ‘পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থ থেকে সরাসরি তাঁরই ভাষায় তুলে ধরা যাক—

“দেড় হাজার মেইল দূরের বিভাষাঈ এক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কেবল ধর্মের নামে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন পূর্ববাংলার মুসলমানরা। তাঁরা আশা করেছিলেন যে, পাকিস্তান হবে তাদের সাব-পেয়েছির দেশ। কিন্তু তাদের মোহমুক্তি ঘটতে দেরি হয়নি। দেশের রাজনীতি, প্রশাসন এবং অর্থনীতিতে তাদের ন্যায্য হিস্যা তারা পাননি। বরং দেশবিভাগের পর রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রতি তাদের আনুগত্যকেই বিপুলভাবে বিচলিত করেছিলো। মাতৃভাষা নিয়ে বিতর্ক শেষে মোটামুটি ১৯৩০ সাল নাগাদ যে-ভাষাকে তারা নিজেদের ভাষা বলে গ্রহণ করেছিলেন, সেই ভাষা ভুলিয়ে দিয়ে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার হুকুম যখন এলো পাকিস্তানের নেতাদের তরফ থেকে, সেটাকে তারা মেনে নিতে পারলেন না; এমন কি, দেশের ঐক্যের নামেও নয়। আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব, বাংলা ভাষায় যথেচ্ছভাবে অপ্রচলিত আরবিফারসি শব্দের আমদানি–এর কোনোটাই তাদের খুশি করেনি। কিছু সময় লেগেছিলো তাদের অসন্তোষ ধূমায়িত হতে, কিন্তু বিশাল এক বিস্ফোরণের সঙ্গে তা ছাড়া পেয়েছিলো ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি।

ভাষা আন্দোলন পূর্ববঙ্গের রাজনীতির ভিত্তি ধরে নাড়া দিয়েছিলো। সেই প্রচণ্ড ঝাঁকুনির ফলে কেবল যে মুসলিম লীগ কার্যত লুপ্ত হলো বাংলার মাটি থেকে, তাই নয়, ধর্মীয় পরিচয় ম্লান হয়ে পূর্ববাংলার মুসলমানদের কাছে বড়ো হয়ে দেখা দিলো তাদের ভাষিক এবং আঞ্চলিক পরিচয়। এতো দিন তারা আরব-ইরানের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকলেও, হঠাৎ নিজেদের বাঙালি পরিচয় নিয়ে তাঁরা গর্ব প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন। বিশেষ করে বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং সঙ্গীত তাদের এই গর্বের একটা প্রধান উপাদান বলে বিবেচিত হলো। এই সূত্রে কেবল রবীন্দ্রনাথই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেন না, বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন, শরৎচন্দ্ৰ, অতুলপ্ৰসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখ অমুসলিম নামও তাদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠলো। ১৯৪০–এর দশকে এক সময়ের ‘কাফের’ কথিত নজরুল ইসলামকে মুসলমানী লেবাস পরিয়ে গ্ৰহণ করার প্রয়াস চলেছিলো। কিন্তু পঞ্চাশ-ষাটের দশকে তারও কাফের পরিচয় পুরোপুরি ঘুচে গেলো। বরং প্রশংসিত হলো তার অসাম্প্রদায়িকতা।

বস্তুত, বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য সম্পর্কে তাদের সচেতনতা এবং গভীর ভালোবাসা খুব কম সময়ের মধ্যে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো। তাঁরা সংকল্পবদ্ধ হলেন যে, বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে সরকারী অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে হবে এবং কেউ এ ভাষার যথার্থ মর্যাদা না-দিলে তা আদায় করে নিতে হবে। অথবা এ ভাষার বিকৃতি করতে চাইলে তাও ঠেকাতে হবে। আরবি হরফে বাংলা লেখার যে-ষড়যন্ত্র করেছিলো কেন্দ্রীয় সরকার, তা এই সচেতনতার মুখেই নস্যাৎ হয়ে যায়। মাহে নও অথবা আজাদের মতো পত্রিকা জোর করে এবং কৃত্রিমভাবে যে-অসংখ্য আরবিফারসি শব্দ আমদানি করতে চেষ্টা করেছিলো, তাও ব্যর্থ হয়। তখন যারা লিখতেন, তারা খুব জোরের সঙ্গে বাংলা ভাষার পক্ষে বক্তব্য রাখতে আরম্ভ করলেন। বাংলা ভাষার দীর্ঘকালের উত্তরাধিকার তাঁরা গর্বের সঙ্গে তুলে ধরলেন।

এককথায় বলা যায়, ধর্মের ভিত্তিতে যে-দেশ গঠিত হয়েছিলো, সেই পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটা অসাম্প্রদায়িক মনোভাব গড়ে উঠলো। তবে স্বীকার করতে হবে যে, একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণমূলক শাসন এবং অন্যদিকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ফলেই এই ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালিয়ানার পরিবেশ গড়ে ওঠা সহজ হয়েছিলো। কিন্তু কারণ যাই হোক, হঠাৎ বাঙালিয়ানার যে জোয়ার এলো, তার ফলে আগের চাইতে অনেক ঘটা করে রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী, নববর্ষের অনুষ্ঠান ইত্যাদি পালিত হতে থাকলো। এমনকি, শারদোৎসব এবং বসন্তোৎসবের মতো অনুষ্ঠানও হতে লাগলো। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আগের চেয়ে অনেক বেশি রবীন্দ্রসঙ্গীত, অতুলপ্রসাদ এবং দ্বিজেন্দ্রলালের গান শোনা গেলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা ফ্যাশানে পরিণত হলো। বিদেশে লেখাপড়া শিখে যো-শিক্ষকরা দেশে ফিরে এলেন, তাদের রেকর্ডপ্লেয়ারের সঙ্গে এলো জেমস ফ্রম টেগোর, শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা, চণ্ডালিকা ইত্যাদি রবীন্দ্রসঙ্গীতের লংপ্লে রেকর্ড—এমনকি, তাদের অনেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত না-বুঝলেও। এই সময়ে অনেকে ছেলেমেয়েদের নাম রাখলেন বাংলায়, বাড়ি এবং দোকানের নামফলক লিখলেন বাংলায়, গাড়ির নম্বরও। তা ছাড়া, অফিস-আদালতেও বাংলায় অনেকে সই করতে আরম্ভ করলেন। মোট কথা, পোশাকে-আশাকে এবং চলনে-বালনে বাঙালিয়ানা একটা অনুকরণযোগ্য ফ্যাশানে পরিণত হলো।

পূর্ববাংলায় রবীন্দ্রনাথের পুনর্জন্ম হলো এই পরিবেশে। যাকে বাঙালি মুসলিম সমাজ কোনোদিন প্ৰসন্ন মনে আপনজন হিশেবে গ্রহণ করেনি, তাকেই পরিবর্তিত পরিবেশে ভালোবাসলেন তারা এবং মেনে নিলেন নিজেদের কবি বলে। কেবল তাই নয়, এ সময়ে ভাষাভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রতীক এবং অনুপ্রেরণায় পরিণত হলেন রবীন্দ্রনাথ। অপর পক্ষে, সরকার জাতীয় সংহতির শত্রু হিশেবে চিহ্নিত করে রবীন্দ্রনাথের বিকল্প হিশেবে খাড়া করতে চেয়েছিলো ইকবাল এবং নজরুলকে, আর চেয়েছিলো তাঁকে লোকচক্ষুর আড়ালে সরিয়ে দিতে।

এই পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উৎসব পালনে পাকিস্তান সরকার বাধা দিয়েছিলো। তা সত্ত্বেও সরকারের রোষ উপেক্ষা করে প্রদেশের অনেকে খুব ঘটা করে এই উৎসব পালন করেন। তারপর ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ে সরকার বেতার-টিভিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানো বন্ধ করেছিলো। পশ্চিমবাংলা থেকে রবীন্দ্রনাথ-সহ অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকের রচনা আদামানিও বন্ধ করেছিলো। এমন কি, বিশ্ববিদ্যালয়ে অমুসলমান কবিসাহিত্যিকের লেখা পড়ানো হবে কিনা, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছিলো। কিন্তু প্ৰবল জনমতের চাপে পরের বছর রবীন্দ্রজয়ন্তীর ঠিক আগে সরকার রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়। তখন যে বিপুল উৎসাহের সঙ্গে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয়, তার মধ্য দিয়ে কবির প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা যতোটা প্রকাশিত হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রকাশিত হয় রাজনৈতিক প্রতিবাদ। এ সময় থেকে ছায়ানটের রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যে হাজার হাজার লোক হাজির হতেন, তাঁরা অনেকে রবীন্দ্রসাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না, হয়তো তাঁর নামই জানতেন। কিন্তু সেই নাম তাদের কাছে প্রতিবাদের মন্ত্রে পরিণত হয়েছিলো। রবীন্দ্রনাথের এই জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও সরকার অবশ্য এখানেই থেমে থাকেনি। এর পরেও ১৯৬৭ সালে বেতার-টিভিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানো নিষিদ্ধ হয়। তারও সোচ্চার প্রতিবাদ করেন ছাত্র, শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবীরা। রাস্তায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের পক্ষে মিছিল বের হয়। প্রকৃতপক্ষে, এ ধরনের নিষেধের মধ্য দিয়ে সরকার বাঙালিয়ানার স্রোত ঠেকাতে চেষ্টা করলেও তার ফল হয়েছিলো একেবারে উল্টো। পূর্ববাংলার লোকেরা আরও বেশি করে রবীন্দ্রনাথকে নিজেদের করে নিয়েছিলেন। বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য বই পড়ে নয়, রবীন্দ্রনাথকে তাঁরা অর্জন করেছিলেন প্রতিবাদী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।

এতে তখনকার প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোও সহায়তা দিয়েছিলো। এসব দল কেবল রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনে উৎসাহ দেয়নি, বরং দলের কর্মীরাও অনুষ্ঠানের আয়ােজন করতেন। অসম অৰ্থনৈতিক বিকাশের ফলে পূর্ববাংলায় স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত কোনো রেকর্ডিং স্টুডিও গড়ে ওঠেনি। কিন্তু ষাটের দশকে যারা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন, তাঁদের গান শোনার জন্যে, তাঁদের গানের রেকর্ড প্রকাশের জন্যে একটা মহলে বিশেষ আগ্রহ জন্মেছিলো। এই পরিবেশে ১৯৬৯ সালে ছজন শিল্পীর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করা হয় করাচির স্টুডিওতে। তারপর এসব গানের রেকর্ড উপহার দেওয়া হয় জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধু মুজিব তখন ভাষণ দিয়েছিলেন এই বলে যে, জনগণ রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে চায়। কেবল তা-ই নয়, তারপর থেকে তিনি ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির কথা বারবার তার ভাষণে উল্লেখ করতে থাকেন। তার উৎসাহ রবীন্দ্ৰভক্তদের উৎসাহিত করেছিলো এবং তাদের সাহস জুগিয়েছিলো।

বস্তুত, বাংলাদেশ-আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ পরিণত হয়েছিলেন একটা প্রতীকে। শেষ পর্যন্ত তার লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি যে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিশেবে গৃহীত হয়েছিলো, তাও প্রমাণ করে তাঁর প্রতি, তথা ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তখন বাঙালিদের ভালোবাসা কী গভীরভাবে দেখা দিয়েছিলো। এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ এ জন্যে যে-বাংলাদেশের সংসদ এ গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিশেবে গ্রহণ করার অনেক আগেই জনগণ স্বতঃস্ফৰ্তভাবে একে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দিয়েছিলো। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এ গান এবং রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য দেশাত্মবোধক গান গেয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ লোকেরা গর্বে, আনন্দে, বেদনায় উচ্ছসিত হয়েছেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে অবস্থার অবশ্য পরিবর্তন ঘটে। রবীন্দ্রনাথকে কেউ তখন আর নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করলো না। বরং সরকারী উদ্যোগে রবীন্দ্রজয়ন্তী এবং রবীন্দ্ৰমৃত্যুবার্ষিকী পালিত হতে লাগলো। ফলে রবীন্দ্রনাথ ফের বই–এর পাতায় বন্দী হলেন; আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হলেন। বেল পাতা দিয়ে নমঃ নমঃ করে মানুষ তখন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের দায় সারলো। আবার, অনেকের মনে তাঁর সম্পর্কে পুরোনো দ্বিধা দেখা দিলো। রবীন্দ্রনাথের গানকে জাতীয়সঙ্গীতের মর্যাদা দিলেও তাঁর নামে একটা উল্লেখযোগ্য রাস্তার নামও হলো না। একটা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠলো না। অথচ সেপাই থেকে সিপাহসালার পর্যন্ত কতো জানা-অজানা লোকের নামে বলতে গেলে শৌচাগার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সড়ক থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত তৈরি হলো। মোট কথা, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে দিগন্ত জুড়ে দেখা দিলেও, ৭০-এর দশকের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ আবার শয্যাশায়ী হলেন। এই পটভূমিতেই যশোরের রবীন্দ্রনাথ রোড পরিণত হয় আর. এন. রোডে।

তবে এটাই শেষ কথা নয়। এই মুমূর্ষ রবীন্দ্রনাথ আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলেন ১৯৭৫ সালের অগস্ট মাসে আততায়ীর হাতে কেবল শেখ মুজিব নন, বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা নিহত হওয়ার পর। শোনা গেলো মূর্তিপূজার প্রতীক বলে বাংলাদেশের জাতীয়সঙ্গীত বদলে যাবে। এই হুমকির মুখে ধুলো-পড়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের খাতা নিয়ে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের কমীরা আরও একবার এগিয়ে এলেন। ১৯৬৩ থেকে ছায়ানট যে-বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসছিলো, তাতে নতুন উৎসাহের জোয়ার এলো। ফৌজী-রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে রাজনীতি যখন অবদমিত, ধর্মনিরপেক্ষতা যখন কার্যত মৃত, তেমন সময়ে রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে সাংস্কৃতিক কমীিরা ১৯৮০ সালে শুরু করলেন জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিযোগিতা। সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতি যে-সাড়া দেখা গেলো, তা যেমন স্বতঃস্ফূর্ত তেমনি প্রবল। একজন কবিই উৎসাহ জোগালেন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি চর্চায়।

মুজিব-হত্যার ঠিক পর-পর বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান সংশোধনের যে কাজ শুরু হয়েছিলো, এই দশকেই তার ষোলো কলা পূর্ণ হয়। দুর্বল একনায়করা গদি আঁকড়ে থাকার জন্যে ধর্মের নাম ভাঙান। তার চেয়েও মারাত্মক—একাত্তরে দেশের স্বাধীনতার যারা বিরোধিতা করেছিলো সরাসরি এবং সক্রিয়ভাবে, সেই সব লোক একেবেঁকে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। মধ্যপ্ৰাচ্য থেকে পেট্রোডলার এসে মদদ জোগায় তাদের। ধর্মনিরপেক্ষতার যে-আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিলো, ঘাতকের নির্দেশে সেই বাংলাদেশ অদ্ভুত উটের পিঠে চড়ে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে চলতে থাকে। চার দিকে ধর্মের উন্মত্ত জিগির আরম্ভ হয়। দেশের অমুসলমানরা পরিণত হন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে। এ সময়ে উপমহাদেশের অন্যত্র যে-কট্টর ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়, তাও বাংলাদেশকে প্রভাবিত করে। ভারতে বাবরি মসিজদ গুড়ো হলে বাংলাদেশে ডজনে ডজনে মন্দির ধ্বংস হয়। ভারতে গৈরিক পতাকা উড়লে বাংলাদেশে চান্দতারা পতপত করে। ভারতের মাটি মুসলমানদের খুনে রাঙা হলে শত শত মাইল দূরের বাংলাদেশও লাল হয় হিন্দুদের রক্তে। ক্রিকেট খেলায় ভারত হারলে এবং পাকিস্তান জিতলে ঢাকায় বিজয় মিছিল বের হয়। এই পরিবেশ ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের অনুকুল নয়। অথবা অনুকুল নয় রবীন্দ্রচর্চার জন্যে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ক বছর আগে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক যখন আবার জাতীয়সঙ্গীত বদলানোর প্রস্তাব করেন, তখন জনপ্রিয় প্রতিবাদের মুখে তার ছুটিতে চলে যেতে হয়। যদিও, বাংলাদেশ যখন উজান স্রোতে বহমান, সেই পরিবেশে একই অধ্যাপক তাঁর রবীন্দ্রবিরোধিতার জন্যে কয়েক বছরের মধ্যে পুরস্কৃত হন। এসব চড়াই-উৎরাই সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ আজও বাংলাদেশে টিকে আছেন বহাল তবিয়তে। প্রতিকূল পরিবেশেও ঢাকায় রবীন্দ্রচর্চার কেন্দ্ৰ স্থাপিত হয়েছে, রবীন্দ্র পঠনপাঠনের নিয়মিত সভা বসে, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে উচ্চতর গবেষণা চলে।

বস্তুত, রবীন্দ্রনাথের নাম এখনো বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক। এই দেশে কেউ নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ এবং সংস্কৃতিবান বলে দাবি করতে চাইলে তাঁকে রবীন্দ্রনাথের নাম নিতেই নয়। ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনে তার গান গাইতেই হয়। এমনকি, ক্রমবর্ধমান মাত্রায় মৌলবাদী চরিত্রের শাসন প্রবর্তিত হলেও, পাকিস্তানী আমলের সঙ্গে তুলনা করলে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের আসন আগের তুলনায় শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সে জন্যেই ধর্মীয় রাজনীতির কাছে যতোই পণবন্দী হোক, সরকার এখন আর রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারছে না। বরং একজন ফৌজী-রাষ্ট্রপতি সরকারী উদ্যোগে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। বস্তুত, রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যারোমিটারের মতো। ঘন অন্ধয়ারে ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন যতো জোরদার হয়, তাঁর নামের পারদ ততো ওপরে উঠতে থাকে। আর অনুকূল পরিবেশে দেশের প্রতিবাদী আন্দোলন যতো নিস্তেজ হয়, রবীন্দ্রনাথ ততোই পাঠ্যপুস্তকের দিকে সরে যেতে থাকেন।”

পরিশেষে এই প্রবন্ধের সেই শুরুর প্রশ্নেই ফিরে আসা যাক— ‘রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের জন্য কি করেছেন?’ আর এলেখার উপসংহার সেই প্রশ্নের উত্তরের জের টেনেই করা যাক। কাজী আবদুল ওদুদ লিখেছিলেন—

“চিরন্তন যদি সত্য হয়, যা স্থানিক ও কালিক তাও তা মিথ্যা নয়। আজকের এই বিশেষ যুগে কবি-রবীন্দ্রনাথের মুসলিম দেশ-ভ্রাতাদের মনে এই অকরুণ প্রশ্ন জেগে থাকে যে তিনি তাঁদের কোন কাজে লেগেছেন, তবে সত্য জিজ্ঞাসুকে সে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এই প্রশ্ন রবীন্দ্রনাথের মুসলমান প্রতিবেশীর মনে জেগেছে প্রধানত দুটি কারণে, প্রথমত, রবীন্দ্রনাথ শুধু বিশ্বকবি নন; বিশেষভাবে একজন ভারতীয় কবিও বটে। সেই ভারতীয়তার রূপ দান করতে গিয়ে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির বহু মনোরম চিত্রও তিনি অঙ্কিত করেছেন, তাঁর সেই সব সৃষ্টি হিন্দুকে শুধু আনন্দিতই করেনি, গর্বিতও করেছে।

দ্বিতীয়ত, মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিগত বিরূপতা না থাকলেও, এমন কি অল্পাধিক অনুরাগ সত্ত্বেও, সেই সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে তিনি প্রায় মৌনীই রয়েছেন তার সুদীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে।

খুব সহজভাবে এই ব্যাপারের এই ব্যাখ্যা দেওয়া যায় যে, শিল্পীর তুলিকার অবলম্বন হয় যে-সমস্তের সঙ্গে তার বিশেষ পরিচয় হয় সেই-সব। হয়ত তাঁর প্রতিদিনের পরিচিত মুখ তাঁর তুলিকায় ধরা পড়ে না, কিন্তু ক্ষণিকের দেখা এক আধ পরিচিত মুখ তার অন্তরে চাঞ্চল্য জাগায় দীর্ঘ দিন ও দীর্ঘ রাত্রি। শিল্পীর এই পক্ষপাতের তত্ত্ব দুরধিগম্য। কিন্তু হয়ত প্রশ্ন হবে, রবীন্দ্রনাথ তো শুধু শিল্পী নন, তিনি একজন শ্রেষ্ঠ জীবন-সমালোচক। সে-ক্ষেত্রে তাঁর দেশবাসী মুসলমান সম্পর্কে তাঁর প্রায় তুষ্ণীম্ভাব অদ্ভুত নয় কি?

এ প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথের একদল অনুরাগী এই কৈফিয়ৎ দিয়ে থাকেন, যে মুসলমান সাধারণত সমালোচক-অসহিষ্ণু। এরূপক্ষেত্রে আলোচনা বা সমালোচনার পক্ষে যে অবাঞ্ছিত কলহ অপরিহার্য রবীন্দ্রনাথের রুচি তাঁকে সে পথ থেকে প্রতিনিবৃত্ত করেছে। কিন্তু এই কৈফিয়ৎ বড় দুর্বল। রবীন্দ্রনাথ হিন্দুর সমালোচনাও কম করেননি, এবং সে-ক্ষেত্রে অপ্রীতিকর কলহ তিনি যে এড়িয়ে যেতে পেরেছেন ঠিক তা নয়। হয়ত তিনি এড়িয়ে যেতে চানও নি, চাইলে এই বাণী তার জন্য অসত্য হত।

‘যেন রসনায় মম
সত্য বাক্য বলি’ উঠে বর খড়গ সম …’

বস্তুত তার দেশবাসী মুসলমান সম্পর্কে তিনি যে কম আলোচনা করেছেন তা নয়, অন্তত, তিনি যে আলোচনা করেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমান ধর্মের প্রতি অথবা পরধর্মের প্রতি তাঁর যে শ্রদ্ধা ব্যক্ত হয়েছে তাঁর ‘সতী’ নাটিকায় তা তুলনাহীন। ভারতের মুসলমান দোষ ও গুণ দুই-ই তাঁর আলোচনার বিষয় হয়েছে। (দ্রঃ আত্মশক্তি ও আধুনিক সাহিত্য) বিশেষত ভারতীয় মুসলমানের সঙ্গে ভারতবর্ষের বাইরের মুসলমানের পার্থক্য কোথায় এবং ভারতীয় মুসলিম জীবনের সত্যকার পরিণতি কোন পথে সে-সম্বন্ধেও স্পষ্ট ভাষায় তিনি তার মতামত প্রকাশ করেছেন। (দ্রঃ আত্মপরিচয়ঃ পরিচয়) তাঁর এই সব মত স্বীকার্য কি অস্বীকার্য তার চাইতেও বড় কথা এই যে সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই তিনি এ-সব মতামত ব্যক্ত করেছেন। অবশ্য মুসলমানের ধর্ম বা ধর্ম প্রবর্তক সম্বন্ধে কোন বিস্তৃত আলোচনা তিনি করেন নি। তিনি যে কবি জগতের প্রাত্যহিক জীবনের সাহচর্য আর আত্ম অনুভূতি এই-ই যে তাঁর জীবনের রাজপথ—এবোধের সঞ্চার তাতে হয়েছিল তার প্রথম যৌবনে আর এই স্বধর্ম থেকে তিনি বিচ্যুত হন নি কখনো। একজন ব্রাহ্মনেতার সন্তান হয়ে তিনি জন্মলাভ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর সেই পিতৃধর্মও তাঁর জন্য হয়েছিল এক প্রেরণার স্থল, পরিক্রমণের স্থল নয়। এ সম্বন্ধে তাঁর এই উক্তি স্মরণীয়:

‘… ধর্ম সম্প্রদায় ব্যাপারটাকে আমরা কী চোখে দেখিব? তাহাকে এই বলিয়াই জানিতে হইবে যে, তাহা তৃষ্ণা মিটাইবার জল নহে, তাহা জল খাইবার পাত্র। সত্যকার তৃষ্ণা যাহার আছে, সে জলের জন্যই ব্যাকুল হইয়া ফিরে, সে উপযুক্ত সুযোগ পাইলে গভূষে করিয়াই পিপাসা নিবৃত্তি করে। কিন্তু যাহার পিপাসা নাই সে পাত্রটাকেই সবচেয়ে দামি বলিয়া জানে। সেই জন্যই জল কোথায় পড়িয়া থাকে, তাহার ঠিক ঠিকানা নাই, পাত্র লইয়া বিষম মারামারি বাধিয়া যায়। তখন যে-ধর্ম বিষয়বুদ্ধির ফাঁস আলগা করিবে বলিয়া আসিয়াছিল, তাহা জগতে একটা নূতনতর বৈষয়িকতার সূক্ষ্মতার জাল সৃষ্টি করিয়া বসে, সে-জাল কাটানো শক্ত।’ (দ্রঃ চারিত্র পূজা)

রবীন্দ্রনাথের নিজের ভিতরে সত্যের জন্য এই যে সহজাত তৃষ্ণা ছিল এই জন্যই হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান সব সমাজেরই সত্যকার ধর্ম জিজ্ঞাসুদের তিনি পরম বন্ধু তা তিনি সেই সমস্ত ধর্মের বিশেষ আলোচনা ও অনুশীলন করুন আর নাই করুন। যে সমস্ত মুসলমান সমালোচক এই প্রশ্নের অবতারণা করেন রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের জন্য কি করেছেন, তাঁদের নিজেদের প্রথমে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া উচিত—মুসলমান কে, এবং কি সে চায়। যদি মুসলমানীর অর্থ এই হয় যে তা বিশেষ কতকগুলি অনড় মতবাদের সমষ্টি তবে সে মুসলমানীর জন্য রবীন্দ্রনাথ কিছুই করেন নি। এই মুসলমানীর সমর্থন কোরআন, হজরত মোহাম্মদ, এবং যুগযুগান্তের মুসলিম শ্রেষ্ঠরাও করেন নি, বরং তার প্রতিবাদ করেছেন, যেমন মহামনীষী সাদী বলেছেন—

‘তরিকত ব-জূজ্‌ খেদমতে খালক নিস্‌ত
ব-তসবি ও সাজ্জাদা ও দল্‌ক নিস্‌ত।’

সৃষ্টির সেবা ভিন্ন ধর্ম আর কিছু নয়, তসবিহ জায়নামাজ ও আলখাল্লায় ধর্ম নেই। অথবা যেমন কোরআনে বলা হয়েছে—আল্লাহ ভুল ধারণার জন্য মানুষ আল্লাহর রোষে পতিত হয় না, পতিত হয় দুষ্কৃতির জন্য (১১ঃ১১৭)।

কিন্তু মুসলমানীর অর্থ যদি হয় সত্যপ্রীতি, কাণ্ডজ্ঞান-প্রীতি, মানব-প্রীতি, জগৎপ্রীতি, ন্যায়ের সমর্থন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ, তবে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় মুসলমান এ যুগে আর কেউ জন্মেছেন কি না সে কথা এই সব সমালোচকদের গভীর বিচার বিশ্লেষণের বিষয় হওয়া উচিত।

দুর্ভাগ্যক্রমে ভারতীয় মুসলমান আজও ভুগছে একটি মানসিক বিকৃতি থেকে, ইংরেজিতে তাকে বলা হয় Inferiority complex; তারা সংখ্যায় অল্প, প্রভাবে খর্ব এই চেতনা তাদের অন্তরে সঞ্চারিত করেছে একটি মানসিক অস্বস্তি। এই মানসিক অস্বস্তির চশমার সাহায্যে জগৎকে যথাযথভাবে দেখা ভারতীয় মুসলমানের পক্ষে সম্ভব নয়। এই মানসিক অস্বস্তি যেদিন তার কেটে যাবে, তার পরিবর্তন তার অন্তরে সঞ্চারিত হবে অভয় ও আশা, সেদিন সহজেই সে বুঝবে দেশে দেশান্তরে মুসলমানদের মধ্যে অমুসলমানদের মধ্যে কোথায় তার পরম মিত্রেরা বাস করেছেন। সেদিনে আজকার একশ্রেণীর দুঃখী মুসলমানের এই যে প্রশ্ন—কবি ও বিশ্বপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ তাদের জন্য কি করেছেন, এটি তার অট্টহাসির সামগ্রী হবে।”

কাজী আবদুল ওদুদের উপরোক্ত বক্তব্যকে সমর্থন করে আহমদ ছফা যথার্থই বলেছিলেন—

“রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক জীবন-সাধনার প্রতি তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টি ফেললে ক্রমশ মনে এ বিশ্বাস সঞ্চারিত হয় যে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত দূরের মানুষ। তাকে ধরি ধরি ছুঁই ছুঁই মনে করলেও তিনি সম্পূর্ণভাবে ধরাছোঁয়ার অতীতই থেকে যান এবং একই কারণে দুর্বোধ্য না হলেও রবীন্দ্রনাথকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে হলে সাধনা, নিষ্ঠা, শ্রম এবং সর্বোপরি সময়ের প্রয়োজন অপরিহার্য।” (বাঙালি মুসলমানের মন, রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি সাধনা, আহমদ ছফা)

সূত্র: ফেসবুক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ