রাধা সম্পর্কে যা জানা প্রয়োজন - কৌশিক সরকার

রাধা সম্পর্কে যা জানা প্রয়োজন - কৌশিক সরকার

আমি যখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়ি তখন আমাদের একজন বাংলা ম্যাডাম ছিলেন। উনি ক্লাসে এসে সু্যোগ পেলেই রাধা কৃষ্ণের লীলা নিয়ে কটুক্তি পুর্ণ কথা বলত এবং হিন্দু ছাত্র ছাত্রীর ধরে ধরে অপমানজনক কথা বলত। উনি উদাহরণ স্বরুপ বড়ু চন্ডিদাসের মধ্যযুগীয় সাহিত্য শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের বিভিন্ন পঙক্তি বলতো যেগুলো কুরুচিপূর্ণ এবং শ্রীকৃষ্ণকে লম্পট প্রমাণে যথেষ্ট।

এতো গেলো কলেজের কথা। সনাতনি দাদা দিদিরা এটা অস্বীকার করতে পারবে না, যে বিষয়টি নিয়ে তাদের বিধর্মী বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে এরকম চটুল আক্রমনাত্মক কথা তারা শোনেনি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা চুপ থাকি, কারণ আমাদের বিষয়গুলো অজানা। সেই বিষয়গুলো নিয়েই আজকে আলোচনা। লেখাটা বড় হয়ে যাচ্ছে তাই এটি পর্ব অনুসারে প্রকাশ করব।

রামায়ণের একটি অংশ নিয়ে মাইকেল মধূসুদন দত্ত মেঘনাদ বধ কাব্য লিখেছেন। রামায়নের রাম হিরো হলেও সেই কাব্যে সে রামকে ভিলেন বানিয়ে মেঘনাদকে হিরো বানিয়েছেন ।এখন কি হিন্দুরা মেঘনাদের পূজো করে? অবশ্যই না।

তেমনি মধ্যযুগে মহাভারত এর শ্রীকৃষ্ণ কে উপযোগ্য করে বিভিন্ন রকম সাহিত্য রচনা হয়েছে এবং এখানে শ্রীকৃষ্ণের সাথে আর একটি চরিত্র আমদানি করা হয়েছে রাধা। স্বভাবতই প্রেম বিরহ যৌনতা না আনলে সাহিত্য মার্কেট খায় না আলোচনায় আসে না। লেখকরা করেছেনও তাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে আমরা সনাতনিরা সেগুলোকে ধর্মগ্রন্থ বানিয়ে দিয়েছি সেইসাথে রাধারও পূজো দেয়া শুরু করেছি। শুধু পূজোই নয় রাধার প্রয়োজনীয়তা যেন শ্রীকৃষ্ণেরও আগে এমন একটা ভাব।

আজকে আমরা শুধুমাত্র জয়দেব- এর গীতগোবিন্দ নিয়ে আলোচনা করব যেখানে সর্বপ্রথম রাধা আমদানি হয়।

যে রাধাকে নিয়ে সারা ভারতবর্ষ মাতোয়ারা বিশেষ করে বাংলা সেই রাধার উল্লেখ মহাভারতের কোথাও আপনি পাবেন না। পাবেন না বললে ভুল হবে কর্ণের পালিত মায়ের নাম রাধা ছিলো এ জন্য তাকে রাধেও নামে ডাকা হত। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের আদিতম বিশ্বস্ত ইতিহাসে রাধা অনুপস্থিত।

এমনকি বিষ্ণুপুরান হরিবংশ বা ভাগবত পুরানেও নেই। আছে শুধু ব্রক্ষ্মবৈবর্ত পুরান ও জয়দেব এর কাব্যে। আমরা যে ব্রক্ষ্মবৈবর্ত পুরান দেখি এটার রচনাকাল আজ থেকে এক হাজার বছর আগে।

অর্থাৎ রাধা চরিত্রটি আমদানি করা হয়েছে সর্বোচ্চ একহাজার বছর আগে।

ব্রক্ষ্মবৈবর্ত পুরাণ বাংলার বৈষ্ণবদের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।

জয়দেব ব্রক্ষ্মবৈবর্ত পুরান অবলম্বন করে গীতগোবিন্দ রচনা করেন। আনুমানিক দ্বাদশ শতাব্দিতে এটি রচনা করা হয়। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ওই সময় ভারতবর্ষ ভিনদেশি অর্থাৎ আরব মুসলিমদের দখলে চলে যায় একের পর এক রাজ্য। এসব চটুল গল্প রচনার পেছনে তাদের প্রত্যাক্ষ বা পরোক্ষ মদদ রয়েছিলো কিনা তা অবশ্যই গবেষণার বিষয়।

জয়দেব তৎকালীন বড় মাপের কবি ছিলেন। তার স্ত্রী পদ্মাবতি ছিলেন সুকন্ঠির অধিকারিনী। জয়দেব পালা লিখতেন, পদ্মাবতী গাইতেন। রাধাকৃষ্ণ এক সময় তাদের জীবন জীবিকা হয়ে দাড়ায়। জীবিকার ক্ষেত্রে লোক মনোরঞ্জন খুবই গুরুত্বপুর্ন বিষয়। ফলে কবি যে মনোরঞ্জনের জন্য অতিরঞ্জনের আশ্রয় নেবেন,  সে কথা বলাই বাহুল্য। এখানে আরো উল্লেখ করা যায় জয়দেব এর বাড়ী বীরভূমে। তিনি যৌবনে কিছুকাল উড়িষ্যায় অতিবাহিত করেন এবং মন্দিরের দেবদাসী পদ্মাবতীকে বিয়ে করেন।

কবি মাত্রই রসিক সে কথা অস্বীকার করার জো নাই। বলা হয়ে থাকে জয়দেব এর ভিতরে আদিরসের প্রাবল্য কিছুটা বেশি ছিলো। তিনি রতিমঞ্জুরি নামে ক্ষুদ্র একটি কামশাস্ত্রও রচনা করেন। সুতরাং গীতগোবিন্দতে রাধাকৃষ্ণের লীলায় কামগন্ধ প্রকট হবে এতে আশ্চর্যের কিছু নাই।

জয়দেব এর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বিদ্যাপতি বড়ু চন্ডিদাস যেসব কৃষ্ণ বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন তা আধুনিক রুচিবিরুদ্ধ। এই ধর্ম অবলম্বন করেই শ্রীচৈতন্য কান্তরসাশ্রিত অভিনব ভক্তিবাদ প্রচার করেছেন। এখন সনাতনীদের কাছে কৃষ্ণউপাসনার প্রধান অনুষঙ্গ হলো রাধা। রাধা ছাড়া এখন কৃষ্ণ নাম নেই, রাধা ছাড়া কৃষ্ণের মন্দির নাই মূর্তি নাই। বৈষ্ণবদের অনেক রচনায় কৃষ্ণের চেয়ে রাধার প্রধান্য লক্ষ্য করা যায়। এখন রাধা চরিত্রটি কাল্পনিক, না অস্তিত্ব আছে সেটা বিচারের দায়িত্ব আমি সকলের প্রতি অর্পণ করলাম।

কৃষ্ণ যখন বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় যায় তখন তার বয়স দশ বছর পেরিয়েছে। কিভাবে একজন একাদশ বছরের নও কিশোর এইসব প্রেমলীলা করতো এই প্রশ্ন রেখে গেলাম পাঠকের কাছে।

এখানে আর একটি বিষয় উল্লেখ করি শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক আসামে শ্রীমন্ত শংকরদেব যে বৈষ্ণববাদ প্রচার করেন সেখানে রাধা অনুপস্থিত।

চলবে ---

Post a Comment

0 Comments