৬ই আগস্ট ১৯৭১ তারিখে সুব্রত শংকর ধর বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতের পথে অনিশ্চিত যাত্রা করেছিলেন। সেই দিনের স্মরণে লিখেছেন স্মৃতিকথা।
আজ ৬ আগস্ট। একাত্তরের এই দিন আমাদের দেশান্তর যাত্রার দিন। সব ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন- -শৈশব, প্রথম কৈশোর, বাড়ির আঙিনার বকুল গাছ, বৈশাখী গাছের আম, পিতার শেষযাত্রার পথ-- সব পিছনে ফেলে এক অনিশ্চিতের উদ্দেশে আমাদের যাত্রা। জানতাম না কবে ফিরব, আদৌ ফিরতে পারবো কি না। জানতাম না এই অনিশ্চিত যাত্রাপথে কোথায় কী অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য।
একটা রিকশাকে শাড়ি দিয়ে মুড়িয়ে তাতে মা, দিদি আর ছোটবোন লিপন (সুপ্রীতি)। আমি অখিল কাকুর সাথে সাইকেলে। প্রিয় শহর গৌরীপুরকে পিছনে রেখে আমাদের যাত্রা। ইচ্ছে হচ্ছিল ফিরে যাই, থেকে যাই।
কিন্তু থেকে যে যাবো, তারও উপায় ছিল না। বাবাকে নিয়ে গেছে পাকবাহিনী, তিনি আর ফেরেননি। ভাই চলে গেছে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে, সে খবরও আর গোপন নেই। আমাদের হাতে যা কিছু অর্থসম্বল, সেও শেষ হয়ে এসেছে। এমন একদিন আমার স্কুলের হেডমাস্টার পিতৃবন্ধু হাফিজউদ্দীন স্যার আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমার পুরো ১৩ মাসের বৃত্তির এবং বইয়ের টাকা একসাথে ৪৪০ টাকা আমার হাতে দিলেন। বুঝেছিলেন, ওই টাকাটা আমাদের খুব কাজে লাগবে। সেই টাকাও খরচ হয়ে যাচ্ছিল দ্রুত। তখন আমার মা সিদ্ধান্ত নিলেন চলে যেতে হবে।
চারদিন ধরে বৃষ্টি বাদল আর ঝড়ের মধ্যে সিলেটের বড় বড় হাওরগুলো পাড়ি দিয়ে ১১ আগস্ট আমরা মেঘালয়ের বালাট ক্যাম্পে পৌঁছেছিলাম। আমি তখনও সাগর দেখিনি। হাওরে ঝড়ের মধ্যে ঢেউ দেখে মনে হয়েছিল এখানেই বুঝি পথের শেষ। সেটিই হতো, পথে একবার নৌকা পরিবর্তন না করলে। সেই চার দিন পথে শুধু চিড়া, মুড়ি আর গুড় খেয়েছিলাম। শুধু একদিন পথে আমাদের এক সহযাত্রীর শ্বশুরবাড়িতে ঘন্টা খানেকের যাত্রা-বিরতি হয়েছিল এক গ্রামে। গ্রাম বলতে হাওরের মাঝখানে একটি ছোট্ট দ্বীপ। জলকাদায় মাখামাখি। সেখানে চাটাই পেতে বসিয়ে কলাপাতায় করে আমাদের খেতে দেয়া হয়েছিল লাল চালের ভাত, মুশুরির ডাল আর মিষ্টি কুমড়োর ভর্তা। অমৃত মনে হয়েছিল সে খাবার! সেই গ্রামের এক দঙ্গল শিশুকিশোর আমার ঝড়ভীতির কথা শুনে হেসেছিল। আমাকে শুনিয়েছিল অভয়বাণী, 'কোনো নৌকা এই মাথা থেকে ওই মাথা পর্যন্ত তিন ঢেউ পেলে সে আর ডুববে না।' ভাটির দেশের আমারই বয়েসী শিশুকিশোরদের ঝড়-বিষয়ক জ্ঞানে আমি অভিভূত! তার চেয়েও বেশি আশ্বস্ত। আমাদের নৌকোটি বড়ই ছিল।
নৌকো ছেড়ে সতের মাইল হেঁটে আমরা যখন বালাট ক্যাম্পে পৌঁছুলাম, ক্যাম্পের অবস্থাদৃষ্টে আমাদের সহযাত্রী ময়মনসিংহের তখনকার নামকরা উকিল দেবেন্দ্র দেবনাথ সিদ্ধান্ত নিলেন এই ক্যাম্পে থাকা যাবে না। চারদিকে তখন ভয়াবহ কলেরা। আরও চার মাইল হেঁটে আমরা ছোট্ট পাহাড়ি শহর বালাটে এলাম। বালাট পোস্ট অফিসের বাঙালি পোস্টমাস্টার দয়া করে আমাদের পোস্ট অফিসের বারান্দায় থাকতে দিলেন। উকিল দেবেন্দ্র দেবনাথ নিজের স্ত্রীর সাথে যতই খিটমিট করুন না কেন, তাঁর মানুষের সাথে কথা বলার স্টাইলে কিছু একটা ছিল। পোস্টমাস্টার মশাই 'না' বলতে পারেননি। কয়েকবারই দেখেছি, তিনি কথা বললে চারপাশে মানুষ জমে যেতো।
ঠাঁই একটা হলো বটে, কিন্তু খাবো কী? ক্যাম্পে না থাকা মানে নিজেদের খরচে থাকা। নৌকো ভাড়া দিয়ে যা মায়ের হাতে ছিল তা দিয়ে খুব বেশিদিন চলবে না। আত্মীয়স্বজনদের লেখা হয়েছে। তাঁরা চিঠি পেলেন কি না, আমাদের নিতে আসবেন কি না, আসলে কবে আসবেন কিছুই জানি না। এই অনিশ্চয়তায় আমরা পরস্পরের সাথেও কথা বলি না বিশেষ। সবাই কেমন চুপচাপ। মায়ের কাছ থেকে জানলাম তাঁর কাছে আর মাত্র ৪৬ টাকা আছে। ছোটবোন সাড়ে তিন বছরের লিপন দুধ খেতে না পেয়েও খুব বুঝদারের মত আচরণ করছে। কোনো বায়না ধরছে না। খেতে দিলে খায়, না খেতে পেলেও কিছু বলে না। ওকে তখন আমার বড় মানুষের মত লাগে।
আমার তখন কৈশোর। বেড়ে ওঠার সময়। শরীর জুড়ে ক্ষিদে। এর আগের পুজোয় বাবার দেয়া জীবনের প্রথম ফুলপ্যান্ট তখন গোড়ালির উপর উঠে গেছে। খাবার চাই। প্রচুর খাবার চাই। শরীর থেকে উঠে আসা এই দাবি নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াই বালাট শহরের বৃষ্টি ভেজা কাঁকর বিছানো পথে। রাস্তার মোড়ে একটা চায়ের স্টল। সেখানে একটি দারুণ সুন্দরী খাসিয়া মেয়ে পরোটা আর চা দেয় সবাইকে। হেসে হেসে। জাপানি পুতুলের মতো লাগে তাকে। কী সুন্দর ইংরেজিতে কথা বলছিল সবার সাথে! কিন্তু তার দিকে মনোযোগ ধরে রাখতে পারি না। আমি ডালডায় ভাজা পরোটার সুঘ্রাণে আহত হতে থাকি, আহত হতে ঘাকি। আমার চরাচর ভেসে যায় সেই সুঘ্রাণে। কিশোরীর সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে যায় আমার অন্য চিন্তা, বেড়ে ওঠা শরীরের চাহিদা-- খাবার। প্রচুর খাবার চাই। আমার লোভী চোখ সেই কিশোরীকে অতিক্রম করে তার হাতের ডালডায় ভাজা পরোটার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার তখন দুই আনা দিয়ে কিনে পরোটা খাওয়ার সামর্থ্য নেই। মায়ের হাতে তখন মাত্র ৪৬ টাকা আর আমাদের সামনে ভয়াবহ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
পিছন ফিরে তাকালে মনে হয়, জীবন থেকে অকস্মাৎ পিতাকে হারিয়ে ফেলা, বালাটের সেই একমাস এবং ভারতে শরণার্থী হয়ে কাটানো পুরোটা সময় আমার জীবনে স্থায়ী প্রভাব ফেলে গিয়েছে। কোনো অনিশ্চয়তাকে নিতে পারিনা। সমস্ত জীবনই মনে হয়েছে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছি। একাত্তর যে কতভাবে কত মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে! অহংকারের খড়ে মাটির আস্তর দিয়ে দিয়ে গড়ে তুলেছে মানুষ-মূর্তি।
সূত্র: সুপ্রীতি ধর
0 মন্তব্যসমূহ