দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো ছয় ভাই এখন ছবি, ফাইল ছবি: প্রথম আলো |
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় পিকআপচাপায় ছয় ভাই নিহতের ঘটনায় করা মামলায় চালক সাহিদুল ইসলাম ওরফে সাইফুলকে আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আজ রোববার দুপুর ১২টার দিকে আসামির উপস্থিতিতে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল এ রায় ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে তাঁকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
পিকআপচাপায় ছয় ভাই নিহতের ঘটনাটি ‘দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ উল্লেখ করে রায়ে আদালত বলেন,
‘পিকআপচালক প্রথমবার চাপা দেওয়ার পর দ্বিতীয়বার পেছন থেকে আহত ব্যক্তিদের চাপা দিয়ে ঘটনাস্থলে মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন। এ জন্য চালক সাহিদুলের মৃত্যুদণ্ড হওয়ার কথা। কিন্তু চালকের বয়স (২২) বিবেচনায় নিয়ে তাঁকে আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো।’
আদালতের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ফরিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন,
‘পিকআপচালক সাহিদুলকে আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে এক লাখ টাকা জরিমানার আদেশ দিয়েছেন। মামলার অন্য দুই আসামি পিকআপের মালিক মাহমুদুল করিম ও তাঁর ছেলে মো. তারেকের বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইনে বিচার হবে। আজকের রায়টি শুধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে।’
মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন,
‘এটি দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। বয়স বিবেচনায় নিয়ে আদালত সাহিদুলকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন। নইলে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হতো। এ ধরনের রায় দেশে এটাই প্রথম।’
কক্সবাজারের চকরিয়ায় পিকআপচাপায় নিহত ভাইদের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে মা মানু রানী সুশীল ও তাঁদের স্ত্রীরা, ফাইল ছবি: প্রথম আলো |
তবে মামলার রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি একসঙ্গে ছয় সন্তান হারানো মা মৃণালিনী সুশীল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পিকআপচালক ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর ছয় ছেলেকে হত্যা করেছেন। তাঁর মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত ছিল। শিগগিরই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। মামলার বাদী প্লাবন সুশীল বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থান করছেন। রায়ের বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাটের হাসিনাপাড়া এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে পিকআপের চাপায় নিহত হন সুরেশ চন্দ্র সুশীলের ছয় ছেলে অনুপম সুশীল (৪৬), নিরুপম সুশীল (৪০), দীপক সুশীল (৩৫), রক্তিম সুশীল (৩২), চম্পক সুশীল (৩০) ও স্মরণ সুশীল (২৯)। এ ঘটনার আগে ৩০ জানুয়ারি তাঁদের বাবা সুরেশ চন্দ্র সুশীল মারা যান। ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে মালুমঘাটের একটি মন্দিরে বাবার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান শেষ করে ফেরার পথে তাঁরা ঘটনার শিকার হন।
একসঙ্গে ছয় সন্তান হারানো মা মৃণালিনী সুশীল, ফাইল ছবি |
ছয় ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনায় নিহতদের ভাই প্লাবন সুশীল বাদী হয়ে চকরিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। দীর্ঘ তদন্তের পর ওই বছরের ৯ নভেম্বর তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক এনামুল হক চৌধুরী তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি চকরিয়ার জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত শুনানি শেষে অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, পিকআপের মালিক মাহমুদুল করিম অনভিজ্ঞ ও লাইসেন্সবিহীন একজন চালকের হাতে গাড়িটি চালানোর জন্য তুলে দিয়েছেন, যা সড়ক পরিবহন আইনের পরিপন্থী। এ ছাড়া দুর্ঘটনার খবর শুনেও তিনি (মাহমুদুল) আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার উদ্যোগ নেননি। এ জন্য মাহমুদুলকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ঘটনার সময় মাহমুদুলের ছেলে মো. তারেক পিকআপে চালকের পাশে বসা ছিলেন। আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার না করে উল্টো তিনি চালককে দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেন। এ জন্য তাঁকেও আসামি করা হয়েছে। চালক সাহিদুল ইচ্ছাকৃতভাবে জেনেবুঝে গাড়িটি পেছনের দিকে চালান এবং ঠান্ডা মাথায় তিনি এটা সম্পন্ন করেন। তাঁর উচিত ছিল, প্রথমবার চাপা দেওয়ার পর আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া বা পুলিশকে খবর দেওয়া। কিন্তু তিনি তা না করে আহত ব্যক্তিদের দ্বিতীয়বার চাপা দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়েছেন।
সূত্র: প্রথম আলো
0 মন্তব্যসমূহ