গত ক'দিন ধরেই কেন যেন সোশাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা গল্প। কেরালার কুখ্যাত স্তন কর নিয়ে গল্পটা।
গল্পটা এরকম-- কেরালার ট্রাভানকোরে ভয়ঙ্কর এক আইন ছিলো। প্রাচীন ভারতের 'অত্যাচারী হিন্দু রাজা' আর 'মনুবাদী ব্রাহ্মণদের' ভয়ঙ্কর সব কাণ্ডের প্রকৃষ্ট উদাহরণ বলা যেতে পারে একে। সেখানকার শুদ্র ও দলিত নারীরা প্রকাশ্যে তাদের স্তন ঢেকে চলাচল করতে পারতো না। কেউ যদি স্তন ঢাকতে চাইতো তাহলে তাকে মুলাক্কারম বা 'স্তন কর' দিতে হতো। স্তনের আকার ও প্রকারের উপরে নির্ভর করে আবার এই করের হার কম-বেশী হতো।
তো, সবাই এই বর্বর আইন মেনে নিলেও মেনে নিলো না নাঙ্গেলী নামক এক মালায়াম নারী।
সে তার স্তন ঢেকেই চলাফেরা করতো। কিন্তু একদিন বিষয়টা নজরে পড়লো স্থানীয় কর সংগ্রাহকের। তারা নাঙ্গেলীকে স্তন কর দিতে চাপ দিতে থাকলো। কিন্তু নাঙ্গেলী তো দেবেই না।
এরকম বেশ কিছুদিন চলার পরে একদিন নাঙ্গেলী তার বাড়ীতে ডাকলো রাজকর্মচারীদের। তারপর নিজের স্তন দুটো কেটে শালপাতায় মুড়ে তুলে দিলো 'কর' হিসেবে।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হলো নাঙ্গেলীর। আর তার পর নাঙ্গেলীর স্বামী কান্দাপ্পন স্থাপন করলো এক অনন্য দৃষ্টান্ত-- স্ত্রীর চিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দিলো। স্ত্রীর সাথে স্বামীর সহমরণের এটাই প্রথম এবং শেষ ঘটনা ভারতে।
এদিকে নাঙ্গেলী আর তার স্বামীর এই বলিদানের খবরে উত্তাল হয়ে উঠলো কেরালা। আন্দোলনের ঠেলায় শেষ পর্যন্ত এই বর্বর আইন রদ করতে বাধ্য হয় রাজা।
গল্পটা পড়ে তিনটা প্রশ্ন জাগলো মাথায়।
- ১. ট্রাভানকোর কোথায়?
- ২. কবেকার ঘটনা এটা?
- ৩. কর ধার্য করার পদ্ধতিটা আসলে কী ছিলো? মানে, ইঞ্চি মেপে কর ধরতো?
অল্প ঘাঁটাঘাঁটি করতেই প্রথম ও দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। দক্ষিণ মালাবারের একটি অঞ্চলের নাম ট্রাভানকোর। ঘটনার সময়কাল ১৮২০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে।
তৃতীয় প্রশ্নের কোন উত্তর তো পেলামই না, উল্টো আরেকটা প্রশ্ন দেখা দিলো-- ঘটনা কী সত্য? কারণ স্বয়ং উইকিপিডিয়া একে প্রচলিত গল্প হিসেবেই উল্লেখ করছে!
তাই এবার খোঁজ-- আসল কাহিনীর।
ইউটিউব, ব্লগ, সংবাদপত্র ইত্যাদি ঘেঁটে সবচেয়ে পুরনো যে রিপোর্টটি পাওয়া গেলো তা প্রয়াগরাজের (সাবেক এলাহাবাদ) একটি সংবাদপত্র 'দ্য পায়োনিয়ার' -এ চন্দ্রা রাধাকৃষ্ণান নামক একজন তামিল সাংবাদিকের করা। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেখানেও বলা হয়েছে-- প্রচলিত লোককথা থেকে গল্পটি নেয়া এবং নাঙ্গেলী ও কান্দাপ্পন নাম দুটি তারই দেয়া!
মূলত গল্পের সবচেয়ে প্রাচীন সূত্র মেলে ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ে; বইয়ের নাম 'ইজাভাস : দেন এ্যান্ড টুডে', লেখক এন.আর কৃষ্ণা। কৃষ্ণা তার বইয়ে যথারীতি মেয়েটির কোন নাম দেননি, শুধু সাহসী মহিলা হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।
এরপর কবি এস. পদ্মনাভ পানিকরের জীবনীতেও এর উল্লেখ আছে। কিন্তু সেখানেও দুই লাইনেও গল্প শেষ, কারো পরিচয় নেই।
আর এই দুই বইয়ের টুকরো টুকরো গল্পকে একটু রসালো করে উপস্থাপন করা হয়েছে ২০০০ সালে এস.এন সদাশিবের লেখা 'আ সোশাল হিস্টোরি অব ইন্ডিয়া' বইয়ে। কিন্তু সদাশিব তাঁর বইয়েও কথিত মেয়েটি বা তার স্বামীর পরিচয় দেননি।
কি বিপদ!
এদিকে রাধাকৃষ্ণানের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে ২০১২ সালে সিরিজ লেখা শুরু করলো বিগ ব্যাড ক্রোকোডাইল মানে বিবিসি'র প্রতিবেদক দিব্যা আরিয়া। বিবিসি থেকে কপি করে তেল-নুন-মশলা মিশিয়ে পেস্ট করা শুরু করলো টাইমস অব ইন্ডিয়া, ভ্যাগাবম্ব, দ্য হিন্দু জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। আর যেহেতু বিবিসি লিখেছে, সূত্র ধরে ছড়িয়ে পড়লো ব্লগ, ভ্লগ, ফেসবুক, টুইটার সহ নানান জায়গায়; এমনকি বিস্ময়কর হলেও সত্য, ভারতের ক্যাডার পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেও!
লেখা হয়েছে বই, ভারতীয় পর্নহাব উল্লু তৈরী করেছে ওয়েব সিরিজ।
শুধু তা-ই না, ২০১৯ সালে কথিত নাঙ্গেলীর জন্মভূমি আলাপ্পুঝানের চারথেলায় কংগ্রেস সরকারের এম.এল.এ প্রতিভা হরি ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা যৌথভাবে নাঙ্গেলীর ভাস্কর্য স্থাপন করে এবং খুব শিঘ্রী স্টাডি সেন্টার তৈরীর ঘোষণা দেয়!
কাণ্ড বোঝো! যার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই, লেখকরাও কেউ বলেনি এটা ইতিহাস, তাকেই সত্য ধরে সবার গলাবাজি! অবশ্য বিপক্ষে যদি ব্রাহ্মণ ও হিন্দুত্ব থাকে, গলা চড়াতে সমস্যা কি?
যা-ই হোক, মূলাক্কারাম আসলে কী সেটা জানা যাক।
মালায়াম ভাষায় 'মূলা' শব্দের অর্থ স্তন হলেও, মূলত এর দ্বারা সাবালিকা নারীকে বোঝানো হয়।
আমরা যে হেড ট্যাক্স বা জনকর দিই (শুদ্ধ নাম আয়কর), এটাই আদায় করা হতো দুই নামে। ছেলেদের জন্য থালাক্কারাম, মেয়েদের জন্য মূলাক্কারাম। যেহেতু ছেলেদের এক-তৃতীয়াংশ হারে কর দিতে হতো মেয়েদেরকে, তাই দুটি আলাদা নাম রাখা আরকি।
একটা মজার তথ্য দিই, থালাক্কারাম মানে কিন্তু 'গোঁফ কর'। তবে গোঁফ রাখার জন্য কর দিতে হতো তা এখনো কেন বলছে না কেউ তা-ই ভাবছি...
আরেকটা বিষয়, যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রিটিশ উপনিবেশের আগে মাতৃতান্ত্রিক আদিবাসী সমাজব্যবস্থাই প্রচলিত ছিলো মালায়াম তথা কেরালাজুড়ে। সেখানে নারী ও পুরুষের ভেদাভেদ ছিলো না। পুরুষের মতোই শুধু নিম্নাঙ্গ ঢাকতো নারীরা (শুধু শ্রমিক না, রাণী ও রাজকন্যারাও)। উপরন্তু খদ্দের আকর্ষণের পদ্ধতি ও চিহ্নিত করার উপায় হিসেবে যৌনকর্মীদের স্তন আংশিক বা পুরো ঢাকা থাকতো।
তৎকালীন বিভিন্ন বিদেশীর লেখা ও আঁকায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আছে। যেমন-- পিয়ের্তো দেল্লা ভ্যাল এবং জন হেনরি গ্রুজের লেখা ভ্রমণকথা, জোহান নিউহফের আঁকা রাজসভায় রাণী কুইলো'র ছবি।
আসলে নারীর উন্মুক্ত স্তন যে পুরুষকে পশুতে পরিণত করতে পারে --এই ধারণা ও অভ্যাস কোনটাই সেখানে ছিলো না তখন। বস্তুত, আদি ভারতে এটাই স্বাভাবিক ছিলো, বিভিন্ন প্রাচীন মন্দিরগুলোতে তো আমরা তা-ই দেখি। আমাদের দেশেও একটি আদিবাসী গোষ্ঠী আছে যারা নিজেদের সমাজে থাকাকালীন সময়ে দেহের উপরাংশ ঢাকে না।
মুসলিম উপনিবেশ খুব বেশী করায়ত্ত্ব করতে পারেনি মালায়ামদের। এমনকি ব্রিটিশরাও দাঁত বসাতে বেশ বেগ পেয়েছে। চার্চ এবং চার্চ নিয়ন্ত্রিত স্কুল-কলেজ ও হাসপাতালগুলোর মাধ্যমে মেয়েদের 'বুক ঢাকা' অভ্যাস করানো হয়েছে। তবে সেটাও অনেক পরে। ১৯ শতকের শুরুতেও একটা বড় অংশের আদিবাসী হিন্দু মেয়েরা ঊর্ধ্বাংশ খোলা রাখতো।
মোরাল অব দ্য হিস্টোরি : কোন সাংবাদিক বা লেখক বলেছে বলেই তাকে সত্য মানার কোন কারণ নেই। আগে যাচাই করুন।
সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ