📚 সিঁদুরের সংজ্ঞা হিসেবে আমরা প্রথমে শব্দকল্পদ্রুমের সহায়তা নেব। শব্দকল্পদ্রুম সংস্কৃত অভিধান। সংকলক রাজা রাধাকান্ত দেব (১৭৮৩-১৮৬৭) এবং সম্পাদক করুণাসিন্ধু বিদ্যানিধি। সুদীর্ঘ চল্লিশ বছরের পরিশ্রমে আট খন্ডে এ কোষগ্রন্থটি সংকলিত হয়। সংকলনের কাজ শুরু হয় ১৮০৩ সালে। প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয় ১৮১৯ সালে এবং সর্বশেষ অষ্টম খন্ড পরিশিষ্ট খন্ড হিসেবে প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ সালে।
এখানে বলা হয়েছে -
👉 সিন্দূর ন০ স্যন্দ--ঊরন্ সংপ্রসারণম্। স্বনামখ্যাতে রক্ত-বর্ণে ১ চূর্ণভেদে অমরঃ ২ বৃক্ষভেদে পু০ মেদি০। “সীসোপধাতুঃ সিন্দূরং গুণৈস্তৎ সীসবন্মতম্। সংয়োগ- জপভাবেন তস্যাপ্যন্যে গুণাঃ স্মৃতাঃ। সিন্দূরমুষ্ণং বীসর্পকুষ্ঠকণ্ডূবিষাপহম্। ভগ্নসন্ধানজননং ব্রণশো- ধনরোপণম্” “দুগ্ধাম্লয়োগতস্তস্য বিশুদ্ধির্গদিতো বুধৈঃ” ভাবপ্র০। ভর্তুরায়ুর্বৃদ্ধয়ে সধষয়া তদ্ধারণস্যাবশ্যকতা যষোক্তং কাশীখ০ ৪ অ০ “হরিদ্রাং কুঙ্কুমং চৈব সিন্দূরং কজ্জলং তথা। কুর্পাসকঞ্চ তাম্বূলং মাঙ্গল্যাভরণং শুভম্। কশসস্কারকবরীকরকর্ণবিভূষণম্। ভর্তুরায়ুষ্যমি - চ্ছন্তী দীরয়েচ্চ পতিব্রতা”।
এখানে ঊনবিংশ শতকের এই অভিধান আমাদের দুটি তথ্য দেয় -
- ১. সীসা দ্বারা তৈরী।
- ২. পতির আয়ু বৃদ্ধি ও পতিব্রতা নারীর চিহ্ন।
📚 তারানাথ তর্কবাচস্পতি রচিত বাচস্পত্য অভিধানে সিঁদুর না পাওয়া গেলেও সীমন্তকের উদারহণ পাওয়া যায় -
👉 সীমন্তক ন০ সীমন্তে কায়তি কৈ-ক। ১ সিন্দূরে রাজনি০
এখানে সীমন্তে মানে সিঁথিতে ব্যবহারের উল্লেখই পাওয়া যায়৷।
🔆 বলা বাহুল্য উক্ত দুটি গ্রন্থই অতি আধুনিক৷ তাই অনেকের বিশেষ রুচিকর নাও লাগতে পারে। সিঁদুরের সব থেকে প্রাচীন উল্লেখ পাওয়া যায় পঞ্চম শতকের ভর্তৃহরি বিরচিত শৃঙ্গার শতকমে -
কুকুকুমপঙ্ককল়ঙ্কিতদেহা গৌরপয়োধরকম্পিতহারা ।
নূপুরহংসরণৎপদপদ্মা কং ন বশীকুরুতে ভুবি রামা ॥ ৯ ॥
গ্রন্থকর্তাঃ ভর্তৃহরিঃ শৃঙ্গারশতকম্ 'কুঙ্কুমং ঘুসৃণম্' ইত্যভিধানরত্নমালায়াম্ - যদ্বা কুঙ্কুমেন পঙ্কেন - সিন্দূর পরনামশৃঙ্গারভূষণাখ্যদ্রবদ্রব্যবিশেষেণ চ - নি. . 'সিন্দূরং নাগসম্ভবম্। চীনপিষ্টং চ গান্ধারং পঙ্কং শৃঙ্গারভূষণম্' ইত্যমরঃ - কলঙ্কিতশ্চিহ্নিতো দেহো যস্যাস্সা - কুঙ্কমসিন্দূরাদি- রঞ্জকদ্রব্যশৃঙ্গারিতাকারেত্যর্থঃ।
🔆 সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল, সপ্তম শতকের কবি মাঘ রচিত শিশুপাল বধমেও সিঁদুরের উল্লেখ পাওয়া যায়৷। যদিও এখানে এর নাম কুঙ্কুম হিসেবে উল্লেখিত -
নবকুঙ্কুমারুণপয়োধরয়া স্বকরাবসক্তরুচিরাম্বরয়া ।
অতিসক্তিমেত্য বরুণস্য দিশা ভৃশমন্বরজ্যদতুষারকরঃ ॥ ৭ ॥
শিশুপালবধম্ (মল্লিনাথব্যাখ্যোপেতম্)
নবমঃ সর্গঃ (প্রদোষবর্ণনম্)
সমসাময়িক শতকের আরেক কবি বাণভট্টের লেখাতেও আমরা এর উল্লেখ পাই। তবে এখানে সরাসরি সিঁদুর শব্দের প্রয়োগ উল্লেখযোগ্য।
কুসুমিকে! সিঞ্চ মদিরারসেন বকুলকুসুমমালাগৃহাণি। মালতিকে! পাটলয় সিন্দূরেণুনা কামদেবগৃহদন্তবলভিকাম্।
শ্রীবাণভট্টবিরচিতা কাদম্বরী (পূর্বভাগঃ)
🚩 এরপরে এর উল্লেখ পাওয়া যায় অষ্টম শতকের আদি শঙ্করাচার্য বিরচিত সৌন্দর্যলহরীতে -
তনোতু ক্ষেমং ন-স্তব বদনসৌন্দর্য়লহরী
পরীবাহস্রোতঃ-সরণিরিব সীমন্তসরণিঃ ।
বহন্তী- সিন্দূরং প্রবলকবরী-ভার-তিমির
দ্বিষাং বৃন্দৈ-র্বন্দীকৃতমেব নবীনার্ক কেরণম।।
(সৌন্দর্য লহরী, শ্লোক ৪৪)
🏳 আয়ুর্বেদ শাস্ত্রীয় গ্রন্থেই আমরা এর উল্লেখ দেখি -
সিন্দূর উষ্ণো বীসর্পকুষ্ঠকণ্ডূবিষাপহঃ ভগ্নসন্ধানজননো ব্রণশোধনরোপণঃ
ভাবপ্রকাশসংহিতা/পূর্বখণ্ডঃ/দ্বিতীয়ঃ ভাগঃ/প্রকরণম্ ৩
আবার রসায়ন শাস্ত্র হিসেবে পরিচিত রসার্ণবে এর বিবিধ প্রকারের উৎস ও বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় -
কপর্দো বহ্নিজারশ্চ গিরিসিন্দূরহিঙ্গুলৌ ॥ রস-৩.১২৬ ॥
গিরিসিন্দূরঃ পর্বতপাষাণোদরে রক্তবর্ণঃ পদার্থবিশেষঃ ॥ রসটী-৩.১২৬;১
গিরিসিন্দূর
মহাগিরিষু চাল্পীয়ঃপাষাণান্তঃস্থিতো রসঃ ।
শুষ্কশোণঃ স নির্দিষ্টো গিরিসিন্দূরসংজ্ঞয়া ॥ রস-৩.১৪৫ ॥
হিমালয়াদিবৃহৎপর্বতান্তর্বর্তিক্ষুদ্রপাষা
রক্তবর্ণরসবিশেষঃ শুষ্কীভূতঃ গিরিসিন্দূর ইতি খ্যাতঃ ॥ রসবোধ-৩.১৪৫;২
গিরিসিন্দূর > আয়ুর্বেদীয় গুণ
ত্রিদোষশমনম্ ভেদি রসবন্ধনমগ্রিমম্ ।
দেহলোহকরং নেত্র্যং গিরিসিন্দূরমীরিতম্ ॥ রস-৩.১৪৬ ॥
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের ললিত সহস্রনাম স্তোত্রে সিঁদুরের উল্লেখ পাওয়া যায় -
শ্রুতি-সীমন্ত-সিন্দূরী-কৃত-পাদাব্জ-ধূলিকা ।
সকলাগম-সন্দোহ-শুক্তি-সম্পুট-মৌক্তিকা ॥৬৮
পুরাণের মধ্যে এক ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেই এটি উল্লেখিত -
কিঙ্কিণীজালসংয়ুক্তাং সিন্দূর বিন্দুসংয়ুতাম্ ॥
তয়া যুক্তং পুলকিতং নোত্তিষ্ঠন্তং স্মরান্বিতম্ ॥৩৯॥
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড , অধ্যায় ১৪
অনুবাদঃ... তৎপরে সেই কাননে [ নলকূবর ] কিয়ৎকাল সরোবরতীরে পুষ্পোদ্যানমকধ্যে , কিয়ৎকাল মনোহর পুষ্পবায়ু -সুরভিত বটবৃক্ষ সমীপে আলোকমালায় উদ্দীপিত, চন্দন অগুরু কস্তুরী, কুঙ্কুম [ সিঁদুর ] প্রভৃতি নির্যাসদ্বারা চর্চ্চিত...
উত্তরভারতের বহুত প্রচলিত গণেশাষ্টকম্ নামে বন্দনাতে সিঁদুরের কথা পাওয়া যায় -
ওঁ ওঁ ওঁকাররূপং ত্র্যহমিতি চ পরং যৎস্বরূপং তুরীয়ং ত্রৈগুণ্যাতীতনীলং কলয়তি মনসস্তেজ -সিন্দূর-মূর্তিম্ ।
অনেকেই রামায়ণ ও মহাভারতে সিঁদুর আছে বলে দাবি করেন। দুঃখের বিষয় এসবের কোনটাই সত্য নয়। এমনকি তারা না নিজেরা কোন প্রমাণ উপস্থাপন করেন না সভ্য আচরণ করে তার উত্তর দিয়ে থাকেন। বর্তমান সমাজে এহেন আচরণ খুবই দুঃখজনক।
প্রচলিত কিছু স্থানীয় কাহিনী অনুযায়ী হনুমানের ভক্তির পরাকাষ্ঠা হিসেবে নিজের সমগ্র দেহে সিঁদুর লেপনের কাহিনী উল্লেখ করা হয়৷। এটি সম্পূর্ণই আঞ্চলিক ও শাস্ত্রীয় ভিত্তিহীন।
এবার সবথেকে স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত । সিঁদুর বৈদিক নাকি অবৈদিক । সোজা কথায় বলতে গেলে সিঁদুর আমাদের একটি মহাভারোত্তর সংস্কৃতি। কারণ বেদ-উপনিষদ-বেদাঙ্গ-স্মৃতি কোথাও সিঁদুরের বিন্দুমাত্র উল্লেখ পাওয়া যায় না।
এখন সিঁদুর নিয়ে তাহলে সিদ্ধান্ত কি হওয়া উচিৎ? সিঁদুরকে অশাস্ত্রীয় বলা যায় না সরাসরি কারণ বেদাদিতে কোথাও উল্লেখও নেই বা পুরাণাদিতেও সিঁদুর বিধি হিসেবে বা অত্যাবশ্যক বিধি হিসেবে উল্লেখিত নয়। আবার গৃহ্যসূত্রে আমরা দেখি স্থানীয় বা লোকাচার পালনের অনুমতি পাওয়া যায় -
অথ খলূচ্চাবচা জনপদধর্মা গ্রামধর্মাশ্চ তান্বিবাহে প্রতীয়াৎ
আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১.৭.১
- বিবিধ গ্রাম ও জনপদের আচার যা প্রচলিত আছে তা বিবাহে পালব করতে হবে।
যত্তু সমানং তদ্বক্ষ্যামঃ
আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১.৭.২
- সকল জনপদে সমান বিধি উল্লেখ করা হলো।
অর্থাৎ , বিয়েতে আঞ্চলিক বিধিও পালন করা যাবে। কিন্তু গৃহ্যসূত্র সকল এলাকায় সমান ও বেদানুকূল বিধিই উল্লেখ করেছে।
💥 হিন্দু নারীর সিঁদুর পরা নিয়ে সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব ভিন্ন কথা বলে। সেই বিদ্যার বিশেষজ্ঞদের মতে, লাল বর্ণের সিঁদুর কপালে ধারণ করার অর্থ জড়িয়ে রয়েছে আদিম উর্বরাশক্তির উপাসনার মধ্যে। হিন্দু ধর্ম বলে আজ যা পরিচিত, তার উৎস এক টোটেমবাহী কৌম সমাজে। সেখানে গাছ, পাথর, মাটি ইত্যাদিকে প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীক বলে মনে করত। আর তাদের কাছে লাল রংটি ছিল সৃষ্টির প্রতীক। সেই আদিম কাল থেকেই লাল সিঁদুরকে ভারতীয়রা বেছে নেন তাদের একান্ত প্রসাধন হিসেবে। বিবাহিতা মহিলাদের ললাটে কুঙ্কুম তাদের সন্তানধারণক্ষম হিসেবেই বর্ণনা করে। তার বেশি কিছু নয়।
তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী, লাল কুঙ্কুম শক্তির প্রতীক। মানব শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন দেবতা অবস্থান করেন। ললাটে অধিষ্ঠান করেন ব্রহ্মা। লাল কুঙ্কুম ব্রহ্মাকে তুষ্ট করার জন্য ব্যবহৃত হয়। তা ছাড়া, কপালের ঠিক মধ্যভাগে সূর্যালোক পড়ার ব্যাপারটাকে আটকাতেও সিঁদুর ব্যবহৃত হয় বলে ধারণা করা যায়।
কপালে সিঁদুর প্রয়োগেরও কিছু বিধি ও ফলনির্দেশ শাস্ত্র প্রদান করে। জানা যায়, তর্জনি দিয়ে সিঁদুর পরলে শান্তি পাওয়া যায়। মধ্যমা দিয়ে ধারণ করলে আয়ু বৃদ্ধি পায়। প্রাচীন কালে হলুদ গুঁড়ো দিয়ে সিঁদুর তৈরি হত। তার পরে তাতে লাল কালি মিশিয়ে রাঙিয়ে তোলা হত। কুঙ্কুমচর্চার কেন্দ্রবিন্দুটি হল আজ্ঞাচক্র। এখানে সিঁদুর প্রয়োগে আত্মশক্তি বাড়ে। নারীকে ‘শক্তি’ হিসেবেই জ্ঞান করে হিন্দু পরম্পরা। কুঙ্কুম বা সিঁদুর তাদের আজ্ঞাচক্রে প্রদানের বিষয়টি সেই কথাটিকেই মনে করিয়ে দেয়।
💥 সিঁদুরের উৎপত্তি প্রসঙ্গে নারীবাদী বিশেষতঃ বামপন্থী গবেষকরা বলেন প্রাচীন কালে নারী যখন পিতৃতন্ত্রের হাতে পুরুষের সম্পত্তি হয়ে পড়ল তখন কোনো নারীকে অধিকার করার পর পুরুষ ধারালো পাথর বা ধাতু দিয়ে তার কপালে ক্ষত চিহ্ন এঁকে দিত। সেই রক্তাক্ত ক্ষত পরে সিঁদুরে রূপান্তরিত। এরকম ক্ষত চিহ্ন সহ কিছু কঙ্কাল পাওয়া গেছে।
এ বক্তব্য খুব জোরালো প্রতিষ্ঠিত হয় না। কঙ্কাল পাওয়া যেতেই পারে। কোনো আদিম গোষ্ঠী হয়ত অন্য গোষ্ঠীর নারীদের বিজয়ের পর এই কাজটা করত। কিন্তু তার সঙ্গে হিন্দু সিঁদুরকে সুনিশ্চিত মিলিয়ে দেয়া যায় না। কারণ তাহলে পৃথিবীর আরো বহু জায়গায় অন্য সভ্যতাতেও ঐ ধারা বাহিত হত ও নারীর এ জাতীয় বিবাহ চিহ্ন থাকত। নারী সর্বত্র পুরুষের হাতে পরাধীন ছিল। কেবল নর্ডিকদেরও যদি দায়ী করা হয় তাহলেও নর্ডিক কেবল ভারতে নেই। অন্যত্রও আছে। নর্ডিক প্রধান আরো দেশ আছে। সেখানে হল না। হল কেবল বৈদিক ভারতে ?
হিন্দু সংষ্কৃতিতে পুরুষকে কোনো বিবাহ চিহ্ন বহন করতে হয় না। হয় নারীকে। এই একপেশে প্রথা সৃষ্টির কারণ প্রথাটা প্রাচীন হলেও মহাভারতের সময়ের পরে সেটা নিশ্চিত । সে যুগে সাম্য আশা করা যায় না। সেই প্রাচীন সমাজে কেবল নারীকে বিবাহ চিহ্ন বহন করানোর সম্ভাব্য কারণ একাধিক।
বামপন্থীগণ এখানেও তাদের উর্বর মস্তিষ্ক প্রসূত তত্ত্ব দিয়ে বলেন -
সমাজ এক সময়ে ছিল মাতৃতান্ত্রিক। নারী ছিল যৌন স্বাধীন। বিবাহ প্রথা ছিল না। পরে সম্পদ সৃষ্টির পর যখন পিতৃতন্ত্র ক্ষমতা দখল করল তখন উত্তরাধিকারের স্বার্থে বিবাহ প্রথা সৃষ্টি করে নারীকে যৌন পরাধীন করা হল। কোনো এক পুরুষের নির্দিষ্ট নারী বলে চিহ্নিত করা হল। মুক্ত নারীকে সমাজের সামনে বিশেষ কারোর নির্দিষ্ট চিহ্নিত করতে চিহ্ন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। তাতে সামাজিক অনর্থ ঠেকানো যায়। এছাড়া যৌন স্বাধীন বহুগামী নারীর শরীরে চিহ্ন এঁকে তার চেতনায় প্রবেশ করিয়ে দেওয়া যে সে আর বহুগামী নয়। কোনো এক পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট। স্বামীর মঙ্গল কামনা করতে করতে রোজ সিঁদুর পরতে পরতে তার চেতনা যাতে একগামী হয়ে পড়ে।
তবে এ কারণ দুটোও খুব জোরালো হয় না। কারণ প্রতীক এঁকে না অনর্থ ঠেকানো যায়, না কাউকে একগামী করা যায়। আর সে প্রতীক মাথার বদলে কপালে লম্বা করে কাপালিকদের মতও আঁকানো যেত। তাতে আরো বেশি নজরে পড়ত। তাছাড়া পৃথিবীর অন্যত্রও এ প্রথা থাকতে পারত।
যে কারণটা সব থেকে জোরালো হয় তা হচ্ছে আধুনিক তথাকথিত ফলিত জ্যোতিষ ও ফিমেল বায়োলজি। মমধ্যযুগীয় ভারত ভীষণ ভাবে জ্যোতিষ ও ফলিত জ্যোতিষে উন্নত ও নির্ভর ছিল যার প্রভাব এখনো বিদ্যমান । ফলিত জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী লাল রঙ মঙ্গল গ্রহের প্রতীক। মঙ্গল গ্রহ একাধারে যেমন যুদ্ধ-বিগ্রহ, শৌর্য-বীর্য, সাহস, ভূ সম্পত্তির প্রতীক, তেমনই শারীরিক শক্তি, সুস্থতা, রক্তপাত, রক্তজনিত ব্যধি, অপারেশন, নারীর যৌন ক্ষমতা, উর্বরতা ক্ষমতা ইত্যাদির প্রতীক।
মেয়েদের ঋতুস্রাব থেকে সন্তান ধারণ ও প্রসব সবই করতে হয়। এ সবের সঙ্গে রক্ত বিষয়টি জড়িত। এসব কারণে রক্তাল্পতায় ভুগতে হয়। এছাড়া স্বামীকে যৌন তৃপ্তি দান থেকে সন্তান উৎপাদনের সঙ্গে সাংসারিক সুখ শান্তি জড়িত। সন্তান উৎপাদন করতে ও সংসারে শারীরিক শ্রম দিতে শক্তি ও সুস্থতা প্রয়োজন। নারীর মঙ্গল শুভ হলে সাংসারিক স্থাবর সম্পত্তি অটুট থাকারও লক্ষণ।
তাই এরকম অনেক কিছু মিলিয়ে মঙ্গলকে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে বিবাহিতা মেয়েদের মাথায় লাল সিঁদুর (মাথায় কারণ কালপুরুষের মাথা মেষ রাশি যা মঙ্গল গ্রহের ঘর) কপালে লাল কুমকুম, হাতে লাল পলা ও পায়ে লাল আলতা পরানোর রেওয়াজ তৈরি হয়। একই সঙ্গে চন্দ্র ও শনিকে শুভ করতে হাতে শঙ্খ বা শাঁখা ও লোহার নোয়া পরানো হয় যাতে ঐ তিন গ্রহের শুভত্বে মেয়েদের মতি স্থিরতা, বিবেচনা বোধ এবং রজঃ ও প্রসব শুভ হয়।
এখানে সিঁদুরকে সংস্কৃতি হিসেবে গণ্য করাই উচিৎ। এখানে ব্যক্তি স্বাধীনতার সম্মান করা উচিৎ। অনেকেই বলতে পারেন নারীদের জন্যই কেন এই চিহ্ন, পুরুষদের নয় কেন ইত্যাদি। সেটি আলাদা প্রসঙ্গ । শাস্ত্রীয়ভাবে অবিরোধী বহুকাল ধরে চলে আসা কোন বিষয়ের এভাবে প্রকাশ্য বিরোধ বিশৃঙ্খলা তৈরী করে। তাই যদি কারো আপত্তি থাকে তিনি নিজে ব্যবহার নাই-ই করতে পারেন কিন্তু কোন সংস্কৃতিকে অসম্মান করতে পারেন না। যদি তার বক্তব্য এটি উৎপাটনের পক্ষে হয় তাহলে তিনি ঐতিহাসিক বা শাস্ত্রগত আলোচনা করুন কিন্তু সংস্কৃতির সম্মান বজায় রেখে। কারণ অধিকাংশ সনাতনী বিবাহিত স্ত্রীই এটি গর্বের প্রতীক হিসেবেই নেন। তাই সকলেই একে বৈষম্য হিসেবে গ্রহণ করেন কিনা তা বিবেচ্য। আর ব্যবহার করলেও প্রাকৃতিক সিঁদুর যা কিনা আদা, লাইম বা বাল্ক পটাশিয়াম ব্যবহার করা যায়। সীসা জাতীয় পদার্থ দ্বারা নির্মিত সিঁদুর সর্বৈব ত্যাগ করাই উচিৎ।
প্রস্তুতে -
শ্রী দীপংকর সিংহ দীপ
শিক্ষা ও শাস্ত্রার্থ সমন্বয়ক
বাংলাদেশ অগ্নিবীর
0 মন্তব্যসমূহ