বাংলা সনের প্রবর্তক আকবর নয় - শ্রী অনিক কুমার সাহা

বাংলা সনের প্রবর্তক আকবর নয় - শ্রী অনিক কুমার সাহা


প্রতিবছর পয়লা বৈশাখ এলেই একটা বিতর্ক তৈরী হয় যে পয়লা বৈশাখের প্রবর্তক আসলে কে! বঙ্গে কমিউনিস্ট ও মোঘল অনুসারীদের প্রভাবে জোর করে এই মুকুটখানি আকবরের মাথায়ই পড়িয়ে দেওয়া হয়। আর এমনিতেও ভারতের বেশিরভাগ হিন্দু স্থাপনা ও সংস্কৃতির উপর মোঘলদের নেমপ্লেট বসানোর একটি প্রচলন ত বহু আগে থেকেই ছিলো।


আকবর যে বাংলা সনের প্রবর্তক ছিলেন না তার পেছনে অনেক ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও যৌক্তিক প্রমাণ দেখানো যায়। আমাদের এই লিখার উদ্দেশ্য সেটাই তুলে ধরা।

প্রথমে আমরা চেষ্টা করবো বঙ্গাব্দের আদিবিন্দু উল্লেখপূর্বক মহারাজা শশাঙ্কের পক্ষে মত উপস্থাপন করতে৷ অতঃপর অকবরের পক্ষের মত খণ্ডন করবো। 


☑️ বাংলা সনের প্রবর্তক মহারাজা শশাঙ্কঃ


মহারাজা শশাঙ্ক, তার রাজ্যাভিষেককে স্মরণীয় করে রাখার জন্য অনেক রাজা ও ধর্মগুরুদের মতো, তার জন্মেরও অনেক আগে থেকে তথা সুদূর বৈদিক যুগ থেকে প্রচলিত, রামায়ণ-মহাভারতে প্রচলিত, দিন-মাস-বছরের হিসেবকে ভিত্তি করেই বাংলা সন চালু করেছিলেন।


এই ভারত ভূমিতে দিন-মাস-বছর গণনা কত প্রাচীন সেটা মহাভারত ও রামায়ণের পাতায় পাতায় রয়েছে। তারপর সুপ্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্যভট্ট, বরাহমিহিরাদের অবদান ত আছেই। প্রচলিত বর্ষগণনার ক্ষেত্রেও ভারতীয়রা এগিয়ে। বর্তমানে চলছে বিক্রম সংবৎ ২০৭৯ (চান্দ্রবৎসর) যা খ্রীস্টীয় বর্ষগণনা থেকেও প্রাচীন। চন্দ্রকলা ও চন্দ্রের নাক্ষত্রিক অবস্থানগত  দিক  হিসাব করে এই বর্ষগণনা হয় যা শুরু হয় চৈত্রমাসের অমাবস্যার পরের দিন থেকে অর্থাৎ শুক্লাপ্রতিপদ থেকে। তাছাড়া রয়েছে শকাব্দ বা শালীবাহনাব্দ যা এখন ১৯৪৪ চলছে। এই শকাব্দ হলো সূর্যসিন্ধান্তভিত্তিক বর্ষপঞ্জী। অতঃপর রাজা শশাঙ্ক ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ই এপ্রিল চান্দ্রবৎসর ও সৌরবৎসরের সমন্বয়ের ভিত্তিতে বাংলা সনের প্রচলন শুরু করেন। অর্থাৎ বর্তমানের ভারত বাংলাদেশের বাংলা এলাকার সামন্ত শাসক ছিলেন। ষষ্ঠ শতকের শেষ দশকে, শেষ গুপ্ত সম্রাট, হীনবল হয়ে পড়লে, শশাঙ্ক, গুপ্ত অধীনতা মুক্ত হয়ে নিজেকে বাংলা তথা গৌড় রাজ্যের রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। লোডস্টার ও প্ল্যানেটারিয়াম সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করলে বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটি হয় ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ ই এপ্রিল। 

[চান্দ্রবৎসর হয় ৩৫৫ দিনে যা সৌরবৎসর (৩৬৫ দিন) থেকে ১০ দিন কম। এই কারণে হিজরি মাস প্রতিবছর ১০ দিন করে এগিয়ে যায়।]


৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল এই ব্যাপারে শ্রীসুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, "বঙ্গাব্দের উৎস কথা‍" শীর্ষক একটি পুস্তিকায় বলেছেন, 


"সৌর বিজ্ঞান ভিত্তিক গানিতিক হিসাবে ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল, সোমবার, সূর্যোদয় কালই বঙ্গাব্দের আদি বিন্দু।‍"


তাছাড়া বহু ভাষাবিদ ‘রহমতুল্লাহ বাঙ্গালী’ তাঁর ‍"বঙ্গাব্দের জন্মকথা‍" গ্রন্থেও ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গাব্দের সূচনা এবং রাজা শশাঙ্কই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক বলে মত প্রকাশ করেছেন।

এছাড়াও বাংলা বার ও মাসের নামগুলো এসেছে ভারতীয় জ্যোতিষ বিজ্ঞানের দেওয়া বিভিন্ন গ্রহ ও নক্ষত্রের নাম থেকে। রবি, সোম বা বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ-এই নামগুলো বহু প্রাচীন জ্যোতিষ শাস্ত্রেই উল্লেখ আছে। বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারে বৈশাখ বা চিত্রা নক্ষত্রের নামানুসারে চৈত্র মাস এগুলো হিন্দু পরম্পরায় জ্যোতিষ শাস্ত্রের অংশ যেগুলো আকবর নয় বরং হিন্দু রাজা শশাঙ্কের পক্ষেই বেশি যুক্তিযুক্ত। 


🟠 আকবরের বিপক্ষে যুক্তিঃ


১/ দাবী করা হয় কৃষকদের ফসল তোলার সময় সম্পর্কে জানার সুবিধার জন্য এই সাল চালু হয় বলে এর আরেক নাম নাকি আবার ফসলী সন! সমগ্র ভারতে ফসল হওয়া সত্ত্বেও এবং আকবর সমগ্র ভারতের সম্রাট হওয়ার পরেও কেনো শুধু বাংলা এলাকার জন্য সে বাংলা সন চালু করতে যাবে ? বাংলা ছাড়া অন্যান্য রাজ্যের খাজনা বা কর কি তার প্রয়োজন ছিলো না ?


২/ আরো বলা হয়, হিজরি ৯৬৩ সালের সাথে মিল রেখে, ঐ সালকেই বাংলা ৯৬৩ হিসেবে ঘোষণা ক‌'রে বাংলা সনের চালু করা হয়। কিন্তু এখন ত চলছে ১৪৪৩ হিজরি। আরেকটা হিসেব করে নেওয়া যাক আকবর সিংহাসনে আরোহন করে ১৫৫৬ খ্রিস্টাবে। অর্থাৎ আজ থেকে (২০২২-১৫৫৬) = ৪৬৬ বছর আগে৷ এই হিসেবেও ত আকবরের রাজ্যাভিষেকের সময় বঙ্গাব্দের আদিবিন্দু হতে প্রায় হাজার বছর পিছিয়ে। 


৩/ বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে সম্রাট আকবরকে তারই আমলের রচিত ইতিহাসে স্বীকৃত দেওয়া হয় নি। "আইন-ই-আকবরী" নামে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালের সময়ের একটি বিখ্যাত গ্রন্থ আছে, কিন্তু এই গ্রন্থে বাংলা সন বা ফসলী সন চালুর ব্যাপারে কোনো কথার উল্লেখ নেই। কিন্তু আকবর, ১০৭৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ইরানে প্রচলিত ‍"জেলালি সৌর পঞ্জিকা‍" অনুসরণে ভারতে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে "তারিখ-ই-ইলাহী‍" নামে একটি সৌর পঞ্জিকা চালু করেছিলো সে বিষয়ে ঠিকই উল্লেখ আছে। তবে কয়েক দশক পর এই ‍"তারিখ-ই- ইলাহী‍" পঞ্জিকার ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।


৪/ আকবরের রাজস্ব সচিব টোডরমলের ‘আসল- ই-জমা তুমার’ গ্রন্থেও আকবর কর্তৃক উল্লিখিত অব্দ বা সন প্রবর্তনের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। 


৫/ পৃথিবীর সকল সাল শুরু হয়েছে ১ থেকে এবং এটাই যুক্তিসঙ্গত। আকবর যদি বঙ্গাব্দের শুরু করেই থাকেন তবে সেটা কোন যুক্তিতেই প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ অনুযায়ী ৯৬৩ হিজরি সালকে ভিত্তি ধরে বাংলা সন চালু করলেও ১৪২৯ বঙ্গাব্দ হচ্ছে না, ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দকে ১ ধরে চালু করলেও ১৪২৯ হচ্ছে না আবার ইরানে প্রচলিত জেলালি সৌর পঞ্জিকার ১০৭৯ ধরে চালু করলেও ১৪২৯ হয় না৷ এছারা ভারতে আগে থেকেই প্রচলিত বিক্রম সংবৎ (চান্দ্রবৎসর) বা শকাব্দ (সৌরবৎসর) ধরে চালু করলেও ১৪২৯ মিলছে না। তাহলে আকবর আসলে করেছিলো কি সে হিসেব কোনভাবেই মেলানো সম্ভব নয়।


৬/ ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি আকবরের রাজ্যভিষেক হয় বলে ধরা হয়। তাহলে সেই সময় থেকে বাংলা সন চালু হলে পহেলা বৈশাখ ১৫ এপ্রিল না হয়ে তো ১৪ ফেব্রুয়ারি হওয়ার কথা কিন্তু সেটা হচ্ছে না। অন্যদিকে রাজা শশাঙ্ক প্রবর্তিত বাংলা সনের আদি বিন্দু ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল। পরে বেশ কয়েকবার পঞ্জিকা সংস্কারের কারণেই মনে হয় এই ১২ এপ্রিল, বর্তমানের ১৫ এপ্রিলে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু সম্রাট আকবরের নামে চালানো বাংলা সনের আদি বিন্দু ১৫৫৬ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি তো কিছুতেই ১৫ এপ্রিলে এসে পৌঁছতে পারে না। 


৭/ সম্রাট আকবর পূর্ববর্তী বহু স্থানেই বঙ্গব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার দিহারগ্রাম ও সোনাতপন গ্রামের হাজার বছরেরও প্রাচীন মাটির টেরাকোটা খচিত দুটি পুরাতাত্ত্বিক শিব মন্দিরে সম্রাট আকবর পূর্ববর্তী বঙ্গাব্দের উল্লেখ রয়েছে। খ্যাতিমান প্রশাসক অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘বাঁকুড়ার মন্দির' গ্রন্থে '১০২ বঙ্গাব্দ'-এর উল্লেখ আছে। 


৮/ ১৩২০ বঙ্গাব্দে বরিশাল থেকে প্রকাশিত ও বৃন্দাবনচন্দ্র পুততুণ্ড-রচিত ‘চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস' গ্রন্থে বঙ্গাব্দ ৬০৬ সাল উল্লেখ পাওয়া যায়। 


৯/ বিবিসি বাংলার সাথে আলোচনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক ইসলামের বিশেষজ্ঞ কিংশুক চ্যাটার্জির বলেন, "শশাঙ্কর আমলে তো বাংলা ভাষাটাই চালু হয়নি। কাজেই তিনি বাংলার জন্য আলাদা অব্দ বা সাল চালু করেছিলেন এটা ভাবাটা বেশ বাড়াবাড়ি।"

এটা খুবই হাস্যকর যুক্তি দিলেন তিনি কারণ সেই যুগে বাংলা চালু না হলেও 'বঙ্গ' ঠিকই চালু হয়েছিল। অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ এগুলো বহু প্রাচীন সাংস্কৃতিক নাম। শক থেকে যেমন শকাব্দ একইভাবে বঙ্গ থেকে বঙ্গাব্দ চালু হওয়াও যথাযথ। 


১০/ বাংলা বর্ষগননা যে সম্রাট আকবর চালু করেননি তার আরেকটা প্রমাণ রয়েছে দিনাজপুর জাদুঘরে। নাথধর্মের অন্যতম পীঠস্থান ছিলো তৎকালীন অবিভক্ত দিনাজপুর তথা আজকের ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল মহকুমার গুরু গোরক্ষনাথ মন্দির।প্রাচীন এ গোরক্ষনাথ মন্দিরে দুটি বেলে পাথরের উৎকীর্ণ শিলালিপি পাওয়া যায়।বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ শিলালিপির পরিচয় দিয়েছেন এভাবে,  

//প্রথম পাথরে খোদিত লিপিতে ১০ পঙক্তির নিচে একটি রেখা টানা। রেখার নিচে আছে একটি অশ্বমূর্তি ও একটি বরাহের মসত্মকদেশ। সংলগ্ন দ্বিতীয় পাথরে ছিল বরাহের দেহের অবশিষ্টাংশ ও একটি বৃষমূর্তি। অমসৃণ ও নিকৃষ্টমানের বেলে পাথরে খোদিত লিপিটি ক্ষয়প্রাপ্ত ও দুর্বোধ্য হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় পঙক্তির 'খরগাম', নবম পঙক্তির 'রমনসক' ও দশম পঙক্তির '৯২০ তারিখ( বা তারখ) ১৭ মাঘ' এই ক'টি শব্দ ছাড়া এই দুর্বোধ্য ও ক্ষয়প্রাপ্ত শিলালিপির আর কোনো পাঠ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।//

এই শিলালিপিটি এখন দিনাজপুর জাদুঘরে সংরক্ষিত।এখানে স্পষ্টত বাংলা সালের উল্লেখ পাওয়া যায় যা আকবরের সময়ের চেয়ে অনেক অনেক আগের।


১১/ আকবর যদি ৯৬৩ হিজরির সাথে সমন্বয় করে বঙ্গাব্দ শুরু করে থাকেন তবে বঙ্গাব্দের প্রচলন শুরু হয়েছে (১৪৪৩-৯৬৩) ৪৮০ বছর আগে অর্থাৎ (২০২২-৪৮০) ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে। আকবরের জন্মসাল ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে তাহলে কি আকবর জন্মই নিয়েই বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করেন? 


১২/ আকবর যদি ১৯৫৬ সালেও বঙ্গাব্দের শুরু করে থাকেন তবে তার আগে অর্থাৎ ৪৬৬ বছর আগে বঙ্গাব্দের কোন অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু ১৩২৪ বঙ্গাব্দে শিলচর থেকে প্রকাশিত ও অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি-রচিত ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত' (উত্তরাংশ: তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগ) গ্রন্থে ‘সন ৯০৬ বঙ্গাব্দ'-র উল্লেখ আছে। ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা সম্বলিত ও প্রবোধচন্দ্র বসু (প্রবুদ্ধ) রচিত 'ভগবানপুর থানার ইতিবৃত্ত' গ্রন্থে বাঙলা ৯৭৩ সালের উল্লেখ সালের উল্লেখ রয়েছে। 


১৩/ ২৬ ডিসেম্বর ১৯১১ সালে খুলনা জেলার বিছট বাসুদেবপুর গ্রামে সন্ধান করার সময় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায়ের অধিকারে থাকা একটি মুদ্রায় ১৩৩৯ সম্বৎ ও ৬০৬ সাল দেখতে পান। ৬০৬ বঙ্গাব্দ ধরলে মুদ্রাটি ৮২৩ বছর আগের অথচ আকবরের জন্ম ৪৮০ বছর আগে।

উপরে বাংলা সনের প্রবর্তনে মহারাজ শশাঙ্কের পক্ষে ও সম্রাট আকবরের বিপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি ও প্রমাণ দেওয়া হয়েছে বাকী বিবেচনা পাঠকদের উপর।


© শ্রী অনিক কুমার সাহা 

প্রচারেঃ

Sanatan Philosophy and Scripture (SPS)

সনাতনী ঐক্য, প্রচার ও কল্যাণে অবিচল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ