বর্তমানে অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ তাদের দেবতত্ত্বকে বৈদেশিক বিশেষ করে আব্রাহামিকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শুরু করে দিয়েছে। তারা নিজেদের অজান্তে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে নিজেদের বিশ্বাস এবং স্বাভিমানকে অবহেলা করা শুরু করেছে। সনাতন শাস্ত্রে সরস্বতী, কালী, দুর্গাসহ বিবিধ দেবীর ধ্যানমন্ত্রে, স্তোত্রে দেবীদের উন্নত স্তোনের উল্লেখ রয়েছে। শাস্ত্রের মর্মার্থ যথাযথভাবে না জানার কারণে দেবীর ধ্যানমন্ত্রে বা স্তোত্রে উন্নত স্তোনের উল্লেখ দেখে অনেকেই লজ্জাবনত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে দেবী সরস্বতীর কয়েকটি ধ্যানমন্ত্র এবং পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্রটিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে নেয়া যায়। দেবী সরস্বতীর প্রায় সকল ধ্যানমন্ত্রেই তাঁর উন্নত কুচযুগল বা স্তনযুগলের উল্লেখ রয়েছে। কোন ধ্যানমন্ত্রে তাঁকে কুচযুগলের ভারে অবনতা (কুচভরননমিতাঙ্গী) বলা হয়েছে ; কোন ধ্যানমন্ত্রে তাঁকে উন্নতস্তনী (তু্ঙ্গস্তনীং) বলা হয়েছে ; কোন ধ্যানমন্ত্রে তাঁকে কুচভারে ক্লান্তা বা আনতা (কুচভারক্লান্ত্যা) বলা হয়েছে; কোন ধ্যানমন্ত্রে আবার তাঁকে পীনােত্তুঙ্গ স্তনভারে শরীরের মধ্যভাগ অবনত (আপীনােত্তুঙ্গবক্ষো) বলে অবিহিত করা হয়েছে।
তরুণশকলমিন্দোর্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ।
কুচভরননমিতাঙ্গী সন্নিয়ন্না সিতাব্জে।।
নিজকরকমলােদ্যল্লেখনী পুস্তকশ্রীঃ।
সকলবিভবসিদ্ধ্যে পাতু বাগ্দেবতা নঃ॥
"ললাটে যাঁর বিরাজিত তরুণ শশিকলা, যিনি শুভ্রবর্ণা, কুচভারাবনতা, শ্বেতপদ্মে আসীনা, যাঁর একহাতে উদ্যত লেখনী ও অন্যহাতে পুস্তক শােভা পায়; সেই বাগদেবতা সকল বিভব সিদ্ধির নিমিত্ত আমাদের রক্ষা করুন।"
বাণীং পূর্ণনিশাকরােজ্জ্বলমুখীং কর্পূরকুন্দপ্রভাং অর্ধচন্দ্রাঙ্কিতমস্তকাং নিজকরৈঃ সংবিভ্রতীমাদরাৎ।
বীণামক্ষগুণং সুধাঢ্যকলসং বিদ্যাঞ্চ তু্ঙ্গস্তনীং দিব্যৈরাভরণৈর্বিভূষিততনুং হংসাধিরূঢ়াং ভজে।
"যাঁর বদনমণ্ডল পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় সমুজ্জল, কর্পূর ও কুন্দফুলের ন্যায় যাঁর শরীরের শ্বেতকান্তি, শিরোদেশে অর্ধচন্দ্র বিরাজমান, যিনি চারহাতে বীণা, রুদ্রাক্ষমালা, সুধাপূর্ণকলস ও পুস্তক ধারণ করে আছেন, যিনি দিব্য আভরণে বিভূষিতা হয়ে শ্বেত হংসের উপরে বিরাজিতা, সেই উন্নতস্তনী বাকদেবীকে ভজনা করি।"
আসীনা কমলে করৈর্জপবটীং পদ্মদ্বয়ং পুস্তকং
বিভ্রাণা তরুণেন্দুবদ্ধমুকুটা মুক্তেন্দুকুন্দপ্রভা। ভালােন্মীলিতলােচনা কুচভারক্লান্ত্যা ভবদ্ভূতয়ে ভূয়াদ্বাগধিদেবতা মুনিগণৈরাসেব্যমানানিশম্।।
"যিনি পদ্মের উপর সমাসীনা, চারটি হাতে জপমালা, দু'টি পদ্ম ও পুস্তক ধারণ করে আছেন, মস্তকে চন্দ্রকলার মুকুট ধারণ করেছেন; যাঁর দেহকান্তি মুক্তা, চন্দ্র ও কুন্দফুলের ন্যায় শুভ্র, ললাটদেশেও একটি লােচনে যিনি ত্রিনয়নী, মুনিগণ সর্বদা যাঁর সেবা-বন্দনা করেন; সেই কুচভারে আনতা বাগদেবী সদা কল্যাণ করুন।"
মুক্তাহারাবদাতাং শিরসি শশিকলালঙ্কৃতাং বাহুভিঃ স্বৈর্ব্যাখ্যাং বর্ণাখ্যমালাং মণিময়কলসং পুস্তকঞ্চোদ্বহস্তীম্।
আপীনােত্তুঙ্গবক্ষোরুহভরবিলসন্মধ্যদেশামধীশাং
বাচমীড়ে চিরায় ত্রিভুবনমিতাং পুণ্ডরীকে নিষণ্ণাম্॥
"মুক্তাহারের ন্যায় যাঁর দেহের শুভ্রকান্তি, মস্তকে চন্দ্রকলা বিরাজিতা, চারটি হাতে বাখ্যামুদ্রা, মাতৃকাবর্ণমালা, মণিময় কলস ও পুস্তক ধারণ করে আছেন, পীনােত্তুঙ্গস্তনভারে যাঁর মধ্যভাগ অবনত, শ্বেতপদ্মে সমাসীনা ত্রিলােকে পূজিতা সেই বাগ্দেবীকে সদা পূজা করি।"
দেবী সরস্বতীর পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্রে আছে, দেবীর কুচযুগল মুক্তাহারের শোভায় শোভিত।
জয় জয় দেবি চরাচর সারে,
কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীণাপুস্তকরঞ্জিত হস্তে,
ভগবতী ভারতী দেবি নমস্তে।।
" হে দেবী, তোমার জয় হোক, তোমার জয় হোক! তুমিই এই চরাচর জগতের মূল। মুক্তার মালায় তোমার কুচযুগল সুশোভিত এবং তোমার দুই করপল্লবে বীণা ও বেদ শোভিত। হে ভগবতী ভারতী দেবী তোমায় প্রণাম!"
ধর্মীয় স্তোত্রে বা মন্ত্রে কুচ বা স্তনের উল্লেখ কেন? এ নিয়ে আমাদের অনেকেরই মনে সংশয়ের কমতি নেই। কিন্তু একবার আমরা ভেবে দেখি না, একটি শিশুর জন্মের সাথে সাথেই তার মাতৃস্তনের প্রসঙ্গ আসে। কারণ এই মাতৃস্তনের অমৃততুল্য মার্তৃদুগ্ধ পান করেই শিশুটি বেঁচে থাকে। মায়ের সাথে সন্তানের মাতৃদুগ্ধের সম্পর্ক। সন্তান মায়ের এ মাতৃদুগ্ধের ঋণ আমৃত্যু শোধ করতে পারে না। মাতৃস্তনের সাথে সন্তানের বেঁচে থাকার সম্পর্ক, জীবন ধারণের সম্পর্ক। তাই জগজ্জননী আদ্যাশক্তি মহামায়ার দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, কালী ইত্যাদি সকল রূপের বর্ণনাতে উন্নতস্তন প্রসঙ্গ বারংবারই ঘুরেফিরে এসেছে। বিষয়টি লজ্জার নয়, বিষয়টি বাৎসল্যে রসের। শুক্ল যজুর্বেদে বলা হয়েছে, দেবী সরস্বতীর স্তন্য দুগ্ধ সকল প্রাণীর পরম সুখকর, রত্নের ধারক এবং বিশ্বপালক।
যস্তে স্তনঃ শশয়ো যো ময়োভূর্যো রত্নধা বসুবিদ্যঃ সুদত্রঃ।
যেন বিশ্বা পুষ্যসি বাৰ্য্যাণি সরস্বতি তামিহ ধাতবেঽর্কঃ।।
উর্বন্তরিক্ষমন্বেমি।।
(শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা: ৩৮.৫)
"হে সরস্বতি, তোমার সেই স্তন আমার পানের জন্য প্রদান কর। যে স্তন সুপ্ত, অন্য কেউ ভোগ করে নি। যা সকল প্রাণীর পরম সুখকর, যা রত্নের ধারক, যা ধনপ্রাপক ও উৎকৃষ্ট বস্তুদাতা–যে স্তনের দ্বারা তুমি বিশ্বভুবন পালন পোষণ করে থাক। আমি অনন্ত অন্তরিক্ষলোকে গমন করছি।"
আমরা অনেকেই বিষয়টিকে অন্যদের দৃষ্টিতে দেখতে লজ্জিত হয়ে 'কুচ' বা 'স্তন' শব্দগুলোকে অশাস্ত্রীয় হাস্যকরভাবে বিবিধ প্রকারের অর্থ করার প্রয়াস করি। নিজের ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে বৈদেশিক চশমায় দেখতে গিয়ে অনেকেই 'কুচ' শব্দের অর্থ করার চেষ্টা করেছেন বৃদ্ধা ও মধ্য অঙ্গুলীর অগ্রাংশ। এবং "কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে" সংস্কৃত বাক্যের অর্থ করেছেন- যাঁর বৃদ্ধা ও মধ্য অঙ্গুলীর অগ্রাংশ মুক্তামালা দ্বারা শোভিত। কিন্তু মন্ত্রের এমন অর্থ গ্রহণ অবান্তর এবং অযৌক্তিক। কারণ সংস্কৃত 'কুচ' নয় 'কূর্চ্চ' শব্দের অর্থ অঙ্গুষ্ঠ এবং মধ্যাঙ্গুলির সংযুক্ত অগ্রভাগ। যদি মন্ত্রটি অঙ্গুষ্ঠ এবং মধ্যাঙ্গুলির সংযুক্ত অগ্রভাগ অর্থে প্রযুক্ত হত তবে মন্ত্রে অবশ্যই 'কুচ' নয় 'কূর্চ্চ' শব্দটি থাকত। কিন্তু পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্রটির সকল পাঠেই যেহেতু "কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে" রয়েছে। তাই মন্ত্রটি -দেবীর কুচযুগল মুক্তার মালায় শোভিত এ অর্থেই প্রযুক্ত হবে। সর্বোপরি 'কুচ' স্থলে 'কূর্চ্চ' শব্দটি প্রয়োগ করলে মন্ত্রে ছন্দের পতন ঘটে। আবার 'কূর্চ্চ' শব্দটি বিবিধ অর্থবাচক। 'কূর্চ্চ' শব্দটির মুখ্য অর্থগুলো হচ্ছে: কুশমুষ্টি বা তৃণগুচ্ছ; ভ্রূদ্বয়ের মধ্যভাগ বা ভ্রূদ্বয়ের মধ্যস্থ রোমরাজি; শ্মশ্রু বা দাড়ি; শ্মশ্রু প্রসাধক বা দাড়ির চিরুণি; ময়ুরের পুচ্ছ; তুলিকা বা ছবি আঁকার তুলি; স্থালী; মায়া বা কপটতা ; দম্ভ; তান্ত্রিক বীজমন্ত্র; আসন বিশেষ ; অঙ্গুষ্ঠ এবং মধ্যাঙ্গুলির সংযুক্ত অগ্রভাগ ইত্যাদি। তাই "কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে" পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্রের আভিধানিক অর্থকে পরিবর্তন করে অন্য কোন নতুন কাল্পনিক অর্থের আমদানি করার প্রচেষ্টা অনর্থক। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা প্রতিমা পূজাকে সমর্থন করে না, সেই প্রতিমাপূজা বিরোধী ক্ষুদ্র গোষ্ঠীদের মধ্যে এমন অনর্থক অর্থে প্রয়োগের প্রবণতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশী দেখা যায়। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই অনাকাঙ্ক্ষিত।
অনন্ত বিদ্যা বা অনন্ত জ্ঞানরূপ বিদ্যার আধার হিসেবে শাস্ত্রে আদ্যাশক্তি মহাদেবীর উন্নত স্তন কল্পনা করা হয়েছে। দেবী অচিন্ত্য, চিন্তার অতীত। সাধকের কল্যার্থেই তাঁর রূপ কল্পনা। তাই পূজামন্ত্রে দেবীর উন্নত স্তনের বর্ণনায় লজ্জিত হওয়ার কিছুই নেই। ভীষণা কালীমূর্তি সম্পূর্ণ নগ্না, বিবস্ত্রা দিগম্বরী। তিনিও পীনোন্নত পয়োধরা। সেই কালীমূর্তির উন্মুক্ত স্তনযুগল দেখে সাধকের মনে পরম মাতৃসুখ লাভ হয়। দেবীর স্তনসুধা ক্ষরিত হয় তপঃক্লিষ্ট সাধকের জন্য। সন্তানের ভরণপোষণের জন্যই তিনি তাঁর অমৃত ক্ষরণকারী উন্নত স্তনযুগল সদা উন্মুক্ত করে রেখেছেন। তাই উন্নত উন্মুক্ত স্তনযুগল মাতৃমূর্তিকে দেখে সাধকের কোন লজ্জা নেই, সঙ্কোচ নেই। সাধক বরং মাতৃপ্রেমে গদগদ হয়ে উঠে। কিন্তু পক্ষান্তরে মায়ের সেই উন্মুক্ত স্তন দেখে দুষ্টের মনে কামভাবের সাথে সাথে মহাভীতির উদয় হয়।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
0 মন্তব্যসমূহ