ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা লাভের বহু সময় পরেও, এই উপমহাদেশের যুব সমাজ প্রকৃত ইতিহাস জানা থেকে বঞ্চিত হয়েছে বাম ইতিহাসবিদদের ইতিহাস বিকৃত করার কারণে!
প্রায় বেশিরভাগ ভারতীয় বঙ্গভূমির ইতিহাস, ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত নয়। বাংলার গৌরবময় ইতিহাস তো দূরের কথা, ইংরেজ শাসনামলে বাংলার মাটিতে জন্ম নেওয়া মহাপুরুষদের বীরত্ব সম্পর্কে আজও অনেকের অজানা! দেশের পাঠ্যসূচিতে জায়গা হয়না বঙ্গভূমি ও দেশের অভ্যন্তরের ইতিহাস, পড়ানো হয় শুধু মুঘলদের, পাঠানদের, ব্রিটিশ আধিপত্যের ইতিহাস। ইতিহাস থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণে বতর্মান হিন্দু সমাজ আজ দিকভ্রষ্ট হয়ে বিপথগামী। তাই আজকের আর্টিকেল বঙ্গভূমির এক মহারাণীকে নিয়ে, ইতিহাস ভুলে যাওয়ার কারণে যাঁর বীরত্ব ও পরাক্রম আমাদের অজানা ছিল।
রাণী ভবশঙ্করীর অজানা ইতিহাস :
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কাছে রাণী ভবশঙ্করী নামটি পরিচিত না হলেও, অবিভক্ত বাংলার মুসলমান শাসকদের কাছে একটা আতঙ্কের নাম ছিল।
যাকে বাংলার সুলতানি শাসক, পাঠান শাসকগণ কোনোদিন পরাজিত করতে পারেনি। এমনকি রাণী ভবশঙ্করীর শাসনামলে মুঘল শাসক আকবর পযর্ন্ত ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়।
১৫৫৬ – ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দের সময়, তখন দিল্লীর শাসক মুঘল সম্রাট আকবর। এদিকে বঙ্গভূমিতে সাম্রাজ্যের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মুঘল পাঠান দ্বন্দ্ব চলছে। ঠিক এমন সময় ভারতবর্ষে আলোচিত হয় রাণী ভবশঙ্করীর নাম। ভবশঙ্কীর যুদ্ধবিদ্যা, বীরত্ব, পরাক্রম ও দেশপ্রেমের নিদর্শন সমগ্র ভারতে তৎকালীন সময়ে প্রসিদ্ধ হয়েছিল।
দিল্লীতে তখন বিদেশী লুটেরা মুঘলদের আগ্রাসন; বাংলায় মুঘল, আফগান এবং পাঠানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, লুটপাট ও উপদ্রবের কারণে হিন্দুদের মধ্যে ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। লুটপাটের প্রতিযোগিতা ও ধর্মান্তকরণের কারণে বাংলাভূমিতে হিন্দু জনগোষ্ঠীদের বসবাস অসম্ভব হয়ে পরে।
ভবশঙ্করীর জন্ম :
সেই চরম সংকটময় সময়ে বাংলাভূমির ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যে (কিছু পন্ডিতের মতে ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের পেঁড়ো এলাকায়), জন্ম গ্রহণ করেন দীননাথ চৌধুরীর কন্যা, মাতা চন্ডীর পরম একনিষ্ঠ ভক্ত ভবশঙ্করী। ভবশঙ্করী অর্থাৎ ভূরশুট রাজ্যের রাণী ভবশঙ্করী। বতর্মান পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া ও হুগলি জেলা নিয়ে গঠিত হয়েছিল ভূরশুট রাজ্য। ভূরীশুট / ভূরশুট রাজ্য নামটি “ভূরিশ্রেষ্ঠ” সাম্রাজ্য নামেই ভারতীয় ইতিহাসে পরিচিত। ঐতিহাসিক সুত্র অনুযায়ী, অঞ্চলটির একসময় নাম ছিল ভূরিশ্রেষ্ঠ নগর।
এই নগরে শ্রেষ্ঠ বণিকদের বসবাস থাকার কারণে নাম হয় ভূরিশ্রেষ্ঠ। দামোদর নদ ও রণ নদী এই নগরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হত। তৎকালীন সময়ে এই নদীপথেই বাণিজ্য হত এই অঞ্চলে। ইতিহাসবিদ দের ভাষ্য মতে, ভবশঙ্করী ছিলেন ব্রাহ্মণ কন্যা। দীননাথ চৌধুরী পেঁড়োর জমিদারের নিয়ন্ত্রিত পেঁড়ো দুর্গের সেনাপতি ছিলেন (মতান্তরে রাজা রুদ্রনারায়ণের সাম্রাজ্যে একজন দুর্গরক্ষক ছিলেন এবং সেইসঙ্গে সেনাদের যুদ্ধ বিদ্যার প্রশিক্ষণ দিতেন)।
স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ দীননাথ রণকৌশলে অত্যন্ত দক্ষ ছিল। ভূরিশ্রেষ্ঠ নগরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি। এই পেঁড়োতেই জন্ম হয় ভবশঙ্করীর। রাণী ভবশঙ্করী জন্মসূত্রে এই নামটি পেয়েছিলেন। দীননাথের দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছিলেন ভবশঙ্করী।
ভবশঙ্করীর শৈশব ও শিক্ষালাভ :
ছোট ভাইয়ের জন্মের সময় তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। ভবশঙ্করীর ভাই বিমাতার কাছে বড় হয়েছিল, আর ভবশঙ্করীর শৈশব ছিল পিতার সাহচর্যে। এই কারণে শৈশবেই ভবশঙ্করী পিতার কাছে থেকে অস্ত্রবিদ্যা, ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করা ও তীরন্দাজিতে অত্যন্ত দক্ষ হয়ে ওঠেন। সেইসঙ্গে তিনি মাঝে মাঝে পিতার সঙ্গে যুদ্ধ এবং শিকার অভিযান করতেন। ভবশঙ্করী ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ পন্ডিতদের কাছ থেকে সমাজশাস্ত্র, রাজনীতি, দর্শন, কূটনীতি এবং ধর্মশাস্ত্র ও দর্শনের জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।
ভবশঙ্করীর বিয়ে ও রাণী উপাধি গ্রহণ :
এইভাবে তিনি বেড়ে উঠেন সনাতনী ভাবধারার সঙ্গে। ভবশঙ্করীর মায়ের মৃত্যু পরে দীনানাথ তাঁর কন্যার বিয়ে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান করতে থাকেন। কিন্তু বিচক্ষণ সুকৌশলী যোদ্ধা ভবশঙ্করী এক অদ্ভুত শর্ত দেন, যে পুরুষ তাকে তলোয়ার যুদ্ধে হারাতে পারবেন তাকেই তিনি বিয়ে করবেন। বহু খ্যাতনামা যোদ্ধা এই শর্ত পালন করতে গিয়ে ভবশঙ্করীর কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ভবশঙ্করীর সাথে রাজা রুদ্রনারায়ণের বিয়ে সম্পন্ন হয়।
এ বিষয়ে আজও হাওড়া এবং হুগলী জেলার কয়েকটি গ্রামে প্রচলিত আছে, একবার যুবতী ভবশঙ্করী শিকার অভিযানে গিয়েছিলেন। দামোদর ও রণ নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে শিকার করার সময়, একটি হরিণকে তাড়া করার সময় সেখানে বুনো মহিষের একটি দল ভবশঙ্করীকে আক্রমণ করে। কিন্তু সুযোদ্ধা ভবশঙ্করী অসাধারণ দক্ষতায় তরোয়াল চালিয়ে সবকটি বুনো মহিষকে তিনি একা হত্যা করেন এবং সেইসঙ্গে শিকার অভিযানে থাকা অন্য সদস্যদের রক্ষা করেন।
ওই সময় ভূরিশ্রেষ্ঠরাজ রুদ্রনারায়ণ নৌকোয় করে দামোদর নদী দিয়ে কাষ্ঠসাংড়ার দিকে যাচ্ছিলেন। এই অসাধারণ যুদ্ধ দক্ষতার দৃশ্য রাজা রুদ্রনারায়ণ দূর থেকে লক্ষ্য করেন এবং মুগ্ধ হন। এই মেয়েকেই তিনি বিয়ে করবেন বলে মনস্থির করলেন। পরে তিনি ভবশঙ্করীর পিতাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয় গড় ভবানীপুর দুর্গের কাছে দামোদর রাজপ্রাসাদে।
ভূরিশ্রেষ্ঠ নগরের রাজপুরোহিত হরিদেব ভট্টাচার্যের পৌরোহিত্যে ভবশঙ্করীর সঙ্গে বিয়ে হলো রাজা রুদ্রনারায়ণের। বিয়ের পরে দামোদরের তীরে গড় ভবানীপুরের নিকটে নতুন রাজবাড়ি তৈরী হয়। এরপরে দীননাথ কন্যা ভবশঙ্করী চৌধুরী পরিচিত হন রাণী ভবশঙ্করী নামে। বিয়ের পরে রাণী ভবশঙ্করী রাজ্য শাসনের বিষয়ে রাজা রুদ্রনারায়ণকে সাহায্য করতেন।
ঐতিহাসিক সুত্র মতে, রাণী ভবশঙ্করী দেবী চন্ডীর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। আর এই কারণে বিবাহের পরে রাজপ্রাসাদের পাশে দেবী চন্ডীর মন্দির নির্মাণ করেন। প্রতিদিন তিনি বিধিমতে একনিষ্ঠভাবে দেবী চন্ডীর পূজা করতেন। আজ হাওড়া ও হুগলী জেলার বিভিন্ন এলাকায় যে বেতাই চন্ডী এবং মেলাই চন্ডীর পূজা হয়, সেটা রাণী ভবশঙ্করীর শাসনামল থেকেই প্রথম শুরু হয়। তিনি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে দেবী চন্ডীর বেশকিছু মন্দির নির্মাণ করেন। ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজবংশের কুলদেবী ছিল রাজবল্লভী।
দেবী চণ্ডীর একটি রূপের নাম রাজবল্লভী। রাজবল্লভীর নাম থেকেই ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের পুরোনো রাজধানী “রাজবলহাট” নাম হয়েছিল। কথিত আছে, রাণী ভবশঙ্করী দেবী রাজবল্লভীর অষ্টধাতুর মূর্তি তৈরি করে নিত্য পূজো করত। একবার দেবীর কাছে মানত করে তিনদিন উপবাস থাকার পরে রাণী ভবশঙ্করী গড় ভবানীপুরের দীঘিতে স্নান করতে গেলে, সেই সময় জল থেকে দেবীর স্বপ্নাদিষ্ট তলোয়ার পেয়েছিল। এই তলোয়ার হাতে থাকলে কেউ কোনোদিন তাকে হারাতে পারবে না, দেবী রাজবল্লভীর বর ছিল এটা।
সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও মহিলা সেনাবাহিনী গঠন :
ধর্মীয় বিষয় ছাড়া তাঁর সবচেয়ে বেশি সুনজর ছিল, নিজ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার বিষয়ে। সেই সাথে নিজ সাম্রাজ্যের সামরিক প্রশিক্ষণের বিষয় ও দেখাশোনা করতেন। রাণী ভবশঙ্করীর ব্যাবস্থাপনায় অনেকগুলো সামরিক প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালিত হতো।
তিনিই সর্বপ্রথম ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের মহিলাদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন। সেই সাথে নিয়ম করেন, ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের প্রতিটি পরিবারের অন্তত একজনকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। শত্রু কর্তৃক রাজ্য আক্রান্ত হলে, পরিস্থিতি অনুযায়ী সেনার দরকার পড়লে যুদ্ধ যোগ দিতে পারে এজন্যই এই উদ্যোগ। তৈরি করা হয় মহিলাদের বিশাল সেনা বাহিনী। তারপর ধীরে ধীরে উগ্রপন্থীদের জন্য অসুরবিনাশী দেবীর রূপ নিতে থাকে মহিলা সমাজ। সমাজ ও রাজ্যকে উগ্রবাদী লুটেরাদের থেকে রক্ষা করতেই গ্রহণ করেন একের পর এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তৎকালীন সময়ে রাণী ভবশঙ্করীর বাংলার ভূরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের প্রশংসা ভারতে ব্যাপক আলোচিত হয়।
রাণী ভবশঙ্করীর সাম্রাজ্য বিস্তার ও প্রতিরক্ষা দূর্গ :
রাণী ভবশঙ্করীর প্রশাসনিক দক্ষতায় তাঁর সাম্রাজ্য হাওড়া, হুগলি থেকে বর্ধিত হয়ে পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান এর বিস্তীর্ণ অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।
দেবী চন্ডীর এবং শিবের পরম একনিষ্ঠ ভক্ত রাণী ভবশঙ্করী:
হাওড়া, হুগলির চারপাশের এলাকা নিয়ে গড়ে উঠা ভূরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি নজর দেন। খানাকুল, ছাউনপুর, তমলুক, আমতা , উলুবেড়িয়া, নস্করডাঙ্গায নামক বেশকিছু স্থানে দুর্গ নির্মাণ করেন। রাণী ভবশঙ্করী রাজ্যের সামরিক ব্যাবস্থা নতুন করে গঠন করেন। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি তিনি নৌবাহিনীর প্রতি বিশেষ নজর দেন। রাণী ভবশঙ্করীর দিক নির্দেশনায় ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের নিজস্ব ও যথেষ্ট শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করা হয়। তাঁর শাসনামলে ভূরীশ্রেষ্ঠ রাজ্য শৌর্যে / বীর্যে, কৃষি, স্থাপত্য, বাণিজ্য, তাঁত শিল্প ও ধাতু শিল্পে সমৃদ্ধ হয়ে উঠে।
ত্রিবেণীর যুদ্ধ ও সুলেমান কারীর পরাজয় :
পাঠান বংশীয় সুলেমান কারী তখন গৌড়ের শাসক ছিলেন। মুসলিম শাসকদের লুটেরাদের দল ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় অতর্কিত আক্রমণ ও লুঠপাট করতো। তাই এদের প্রতিরোধ করতে রাণী ভবশঙ্করীর পরামর্শে উড়িষ্যার রাজা মুকুন্দদেবের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন রাজা রুদ্রনারায়ণ। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে ত্রিবেণির যুদ্ধে ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য এবং মুকুন্দদেবের গঠিত যৌথ সেনাবাহিনী গৌড়ের সুলতান সুলেমান কারীকে পরাজিত করেন। কালাপাহাড় নামে বিখ্যাত মুকুন্দদেবের সেনাপতি রাজীবলোচন রায় এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সুলেমানের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র দাউদ খান গৌড়ের শাসনভার প্রাপ্ত হয়। দাউদ খান মুঘলদের পরাজিত করার জন্যে রাজা রুদ্রনারায়ণের সাহায্য চান। রুদ্রনারায়ণ দ্বিমত প্রকাশ করলে, দাউদ খান তাঁর সেনাপতি কলটু খানকে নির্দেশ দেন ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য আক্রমণ করতে। নির্দেশ পেয়ে কলটু খান আক্রমণ করলে, রুদ্রনারায়ণ কলটু খানের সেনাবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। এই যুদ্ধে কলটু খান নিহত হয় এবং উল্লেখযোগ্য সংখক পাঠান সেনার মৃত্যু হয়। এই যুদ্ধ জয়ের কারণে বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুসলিম শাসনের অধীনত হওয়া থেকে রক্ষা পায়।
প্রতাপ নারায়ণের জন্ম এবং রুদ্রনারায়ণের মৃত্যু :
এরপর রাণী ভবশঙ্করী এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। পুত্রের নামকরণ করেন প্রতাপ নারায়ণ। প্রতাপ নারায়ণের ৫ বছর বয়সে রাজা রুদ্রনারায়ণ মৃত্যু বরণ করেন। রাজা রুদ্র নারায়ণের মৃত্যুর পরে রাণী ভবশঙ্করী মানসিক দিক থেকে অত্যন্ত আঘাত প্রাপ্ত হয়।
তিনি মানসিক দিক থেকে এতটা ভেঙে পড়েছিলেন যে, তিনি রাজা রুদ্র নারায়ণের চিতায় নিজেকে আহুতি দিয়ে সহমরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তখন ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজবংশের কুল পুরোহিত রাণী ভবশঙ্করীকে বাধা দেন। রাজকুমার প্রতাপ নারায়ণ প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পযর্ন্ত রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করার অনুরোধ করেন। তারপর রাণী ভবশঙ্করী রাজ্যের শাসনভার সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার জন্যে, শাসনভার গ্রহণ করার পূর্বে রাজ্যের সভাসদদের কাছে তিন মাস সময় চেয়ে নেন।
এরপর তিনি তাঁর রাজ্যের দায়িত্বভার প্রদান করেন সেনাপতি চতুর্ভুজ চক্রবর্তী এবং রাজস্ব মন্ত্রী দুর্লভ দত্তকে।
রাণী ভবশঙ্করীর কাস্তাসন গড়ে গমন, সাধনা ও পরবর্তী যুদ্ধ :
এরপর কাস্তাসন গড়ের (মতান্তরে কাষ্ঠসাংড়া) মহাদেব মন্দিরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। পাঠান আক্রমণের সম্ভাবনা মাথায় রেখে তিনি তাঁর সঙ্গে খুবই বিশ্বস্ত এবং শক্তিশালী মহিলাদের একটি ছোট সেনাদলকে নিয়ে গিয়েছিলেন।
স্বামীর মৃত্যুর পরবর্তী তিন মাস ব্রহ্মচারিণী হয়ে ছিলেন রাণী ভবশঙ্করী। কাস্তাসন শিবমন্দিরে রাণী ভবশঙ্করী শৈব সাধনায় নিয়োজিত করেন, পুত্র প্রতাপ নারায়ণ এসময় সঙ্গে থাকতো। এখানে প্রতিদিন শিব কীর্তন হতো। প্রতিদিন তিনি মহাদেব মন্দিরে ভক্তিভাবে পূজা করতেন এবং সেইসঙ্গে গরিব-দুঃখী, সন্যাসীদের অর্থ, অন্ন-বস্ত্র দান করতেন।
আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বাংলায় মোঘল পাঠানদের দ্বন্দ্বের এই সময়ে মোঘলদের কাছ থেকে পাঠানরা তখন পরাজিত হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল উড়িষ্যায়। সেখান থেকে বঙ্গভূমিতে আধিপত্য বিস্তারে নজর দেন পাঠান সর্দার ওসমান খান। কিন্তু পাঠান সর্দার ওসমান খান মোগলদের বিরুদ্ধে রাণী ভবশঙ্করীর সাহায্য চাইলে, তিনি তা নাকচ করে দেন। কারণ, রাণী ভবশঙ্করী বাংলার মোগল পাঠান দ্বন্দ্বে নিজ রাজ্যকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ রেখেছিল। এতে ক্ষুব্ধ হয় ওসমান।
রাণীর প্রধান সেনাপতি ছিল চতুর্ভূজ চক্রবর্তী এবং দেওয়ান ছিল দুর্লভ দত্ত। রাণী ভবশঙ্করীর অনুপস্থিতিতে সেনাপতি চতুর্ভুজ চক্রবর্তী রাজ্যের ক্ষমতা দখলের জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করেন। সেনাপতি চতুর্ভুজ, সুলতান ওসমান খানের সঙ্গে সন্ধি করেন রাণী ভবশঙ্করী এবং তাঁর নাবালক পুত্র প্রতাপ নারায়ণকে হত্যা করার জন্য। এজন্য চতুর্ভুজ সমস্ত তথ্য ওসমান খানের নিকট পৌঁছে দিত। ওসমান খান তাঁর সেনাবাহিনীর শক্তিশালী সেনা নিয়ে রাণী ভবশঙ্করীকে হত্যার উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালনা করেন। বেশকিছু তথ্য মতে, ওসমান খানের সেনাবাহিনী, হিন্দু সন্ন্যাসীদের ছদ্মবেশে ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্যে প্রবেশ করেন। এছাড়াও বহু পাঠান সৈন্য ব্যবসায়ী, পর্যটক, ভিক্ষুক… ইত্যাদি ছদ্মবেশে ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্যে প্রবেশ করেন।
কিন্তু বর্তমান হাওড়া জেলার আমতার দুর্গে থাকা রাণী ভবশঙ্করীর সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা দল পাঠান সেনাদের চিনতে পারেন। তারা দ্রুতগতিতে রাণী ভবশঙ্করীর নিকট, পাঠান সেনার আগমনের খবর পৌঁছে দেয়। রাণী ভবশঙ্করী এই সংবাদ পাওয়া মাত্রই পাঠান সেনাদের বধ করার পরিকল্পনা করেন। এজন্য তিনি আশেপাশের দুর্গ থেকে দক্ষ সেনাদের ডেকে নিয়ে তাদের নিকটবর্তী জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে বলেন। নিজের সঙ্গে বিশ্বস্ত নারী সেনাদের রাখেন তিনি।
রাতে রাণী ভবশঙ্করী যুদ্ধের পোশাক পরে, অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পূজায় বসেন (কিছু সুত্র মতে এই স্থান ছিল, ভূরশুটের তৎকালীন রাজধানী পাণ্ডুয়ার গড় ভবানীপুর থেকে ১৪ মাইল দূরে বাসডিঙা গড়ের কালীমন্দির)। পূজায় বসার সময়ে তিনি নিজের শরীরে একটি সাদা কাপড় জড়িয়ে নেন। গভীর রাতে ওসমান খানের সেনাবাহিনী রাণী ভবশঙ্করীকে হত্যার উদ্দেশ্যে মন্দির আক্রমণ করেন।
কিন্তু রাণীর সেনাবাহিনী প্রস্তুত থাকায়, তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। রাণী ভবশঙ্করী হাতে থাকা দেবী রাজবল্লভীর স্বপ্নাদিষ্ট তরবারি নিয়ে যুদ্ধ করেন। রাণী ভবশঙ্করীর নেতৃত্বে থাকা সেনাবাহিনী, পাঠান সেনাদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে বধ করেন। পিছনে থাকা পাঠান সেনাবাহিনীর একটি দল এই খবর পেয়ে ভোরের সময় একটু দূরের গ্রামে থাকা একটি শৈব সাধুদের আখড়ায় আক্রমণ করেন।
কিন্তু শৈব সাধুগণ পাঠানদের তরোয়ালের জবাব ত্রিশুল দিয়ে দেন। সেখানে শৈব সন্ন্যাসীগণ বহু পাঠান সৈন্যকে বধ করেন। চর্তুদিকে পরাজিত হয়ে সুলতান ওসমান খান রাতের অন্ধকারে প্রাণ বাঁচাতে পলায়ন করেন। (কিছু ইতিহাসবিদ দের মতে, এই যুদ্ধে পাঠান সর্দার ওসমান খান পরাজিত ও নিহত হয়। পরে তার উত্তরাধিকার পাঠান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভূরশুট দখলের উদ্দেশ্যে চর্তুভুজের সঙ্গে সন্ধি করে )
এই ঘটনার পরেরদিন রাণী ভবশঙ্করী রাজধানী গড় ভবানীপুরে ফিরে আসেন। পূর্বেই তিনি গুপ্তচরের মাধ্যমে সংবাদ পেয়েছিলেন চতুর্ভুজ চক্রবর্তীর ষড়যন্ত্রের কথা, কিন্তু প্রমাণের অভাবে সাজা দিতে পারেননি।
রাণী ভবশঙ্করীর ভূরশুট রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ :
এরপর রাজ্যের শাসনভার সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেন রাণী ভবশঙ্করী। দায়িত্ব নিয়ে তিনি চতুর্ভুজ চক্রবর্তী সেনাপতিকে পদচ্যূত করেন এবং ভূপতি কৃষ্ণ রায়কে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। রাজ্যের বেশকিছু প্রান্তে সেনা প্রশিক্ষণের শিবির স্থাপন করেন, নিজেই দেখভাল করতেন। পাঠান সেনাদের বিরুদ্ধে বাঘের মতো ক্ষিপ্রতায় বীরত্বের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ করার ঘটনা ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের জনগণের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক প্রশংসিত হয়।
ঐ যুদ্ধে রাণী ভবশঙ্করী যদি ওসমান খানকে পরাজিত করতে না পারত, তাহলে ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য ইসলামী শাসনের অধীনে শুরু হতো এবং হিন্দুদের মঠ-মন্দির, সংস্কৃতি, সুখ-শান্তি সব ধ্বংস হয়ে যেত।
রাণী ভবশঙ্করীর সঙ্গে পাঠানদের পুনরায় যুদ্ধ ও রাজ্যভিষেক:
এর কিছুদিন পরে রাণী ভবশঙ্করীর রাজ্যাভিষেকের দিন ঠিক করা হয়। পন্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এক বিশেষ দিনে তান্ত্রিক মতে ছাউনাপুরের অন্তর্গত বাঁশুরি গ্রামে ভবানী মন্দিরে রাণী ভবশঙ্করীর রাজ্যাভিষেক হবে এবং এই পক্রিয়া সম্পন্ন করবেন গোলক চট্টোপাধ্যায় নামে একজন তান্ত্রিক।
এদিকে পদচ্যুত সেনাপতি চতুর্ভজ চক্রবর্তী পুনরায় ষড়যন্ত্র করে ভূরিশ্রষ্ঠ রাজ্যের ক্ষমতা দখল করতে আলোচনা করেন পাঠান সেনাপতি ওসমান খানের সঙ্গে। চতুর্ভুজ চক্রবর্তী, ওসমান খানকে প্রতিশ্রুতি দেন, তিনি তাঁর অনুগত সেনাদের নিয়ে ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্য আক্রমণ করবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ওসমান খান তাঁর অনুগত কয়েকশো সেনা নিয়ে রাতের অন্ধকারে খানাকুলে এসে জঙ্গলে শিবির স্থাপন করেন।
এই সময় জঙ্গলে শিকারে থাকা এক শিকারী এদের দেখে খানাকুলের দুর্গে সংবাদ দেন। সেই সংবাদ চতুর্ভুজ চক্রবর্তী জানার পরে, তিনি গুজব বলে উড়িয়ে দেন। ( উল্লেখ্য, ঐ সময় সেনাপতি ভূপতি কৃষ্ণ রায় জরুরি কাজে দূরে থাকায় চতুর্ভুজ চক্রবর্তী খানাকুল দুর্গের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে ছিলেন)।
কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল রাণী ভবশঙ্করীর গুপ্তচর ব্যাবস্থা, তাই এই সংবাদ তাঁর কাছে পৌঁছে যায়। সংবাদ পাওয়া মাত্রই তিনি প্রতিরোধে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে দূতের মাধ্যমে ভূপতি কৃষ্ণ রায়কে ফিরে আসতে বলেন। সেই সাথে বিভিন্ন দুর্গে অবস্থান করা সেনাদের ডেকে নেন। উল্লেখ্য, রাণী ভবশঙ্করী নিজের রাজ্যকে নিরাপদ রাখতে রাজ্যের সীমান্ত এলাকায় সেনাবাহিনী ছড়িয়ে রাখতেন। এজন্য রাজধানীতে বেশি সংখ্যক সেনা থাকতো না।
তিনি রাজ্যের সীমান্ত এলাকায় নির্দিষ্ট দূরত্বে বহু দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন এবং প্রতিটি দুর্গে একটি করে সেনা ইউনিট থাকতো। এছাড়াও প্রতিটি দুর্গে অশ্বারোহী সৈন্য, হস্তী বাহিনী এবং পদাতিক সৈন্য থাকতো।
রাণী ভবশঙ্করী ছাউনাপুর, বাঁশডিঙ্গাগড় এবং লস্করডাঙ্গা দুর্গের সেনা ইউনিটগুলোকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে, তাদেরকে আশেপাশের এলাকায় মোতায়েন করেন। সেই সঙ্গে রাণী ভবশঙ্করী তাঁর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হরিদেব ভট্টাচার্যের পরামর্শে আশেপাশের বর্ণ ক্ষত্রিয় এবং নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে বাছাই করে কিছু যোদ্ধাদের অর্ন্তভুক্ত করেন, যারা ধর্নুবিদ্যা এবং তরোয়াল চালানোয় বিশেষ দক্ষ ছিলেন। উল্লেখ্য, তাদের পূর্বেই যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়া ছিল, যেহেতু রাণী ভবশঙ্করী রাজ্যের প্রতিটি পরিবারের অন্তত একজনের সেনা প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করেছিলেন।
পাঠান সেনাপতি ওসমান খানের নেতৃত্বে পাঠান সেনাবাহিনী এবং বিশ্বাসঘাতক চতুর্ভুজ চক্রবর্তীর সঙ্গে থাকা সেনাবাহিনী একযোগে বাশুড়িতে আক্রমণ করেন। কিন্তু রাণী ভবশঙ্করীর সেনাবাহিনী পূর্বেই প্রস্তুত থাকার কারণে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে। ঐতিহাসিক সুত্র মতে, রাণী ভবশঙ্করী নিজে হাতির পিঠে আরোহন করে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। রাণী ভবশঙ্করী যাদেরকে তিনি নিজে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, সেই সেনাদের দল প্রবল বিক্রমের সাথে পাঠান সৈন্যদের বধ করতে থাকে। এই যুদ্ধে বাগদি (বর্গ ক্ষত্রিয়) ও চন্ডাল সেনাগণ প্রবল বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। কয়েক ঘন্টার এই যুদ্ধে পাঠান সেনাবাহিনী পরাজিত হয় এবং পাঠান সেনাপতি ওসমান খান যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়। পরে তিনি ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে উড়িষ্যা পালিয়ে যান। বিভিন্ন সুত্র অনুযায়ী, এই যুদ্ধের পরে রাণী ভবশঙ্করীর রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন হয়।
মোঘলদের সঙ্গে রাণী ভবশঙ্করীর যুদ্ধ ও রায়বাঘিনি উপাধি লাভ :
এই সংবাদ পেয়ে মোঘল সম্রাট আকবর তাঁর সেনাপতি মানসিংহকে প্রেরণ করেন ভূরীশ্রেষ্ঠ রাজ্য নিজ অধীনস্থ করতে। এখানেও পরাজিত হয় মোঘল বাহিনী। কিছু ইতিহাস গ্রন্থ মতে, এই যুদ্ধে কেউ পরিপূর্ণ বিজয় অর্জন করতে না পেরে বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, কেউ কারো রাজ্য আক্রমণ করবে না।
অন্য কিছু সুত্র মতে, রাণী ভবশঙ্করীর বীরত্বের কথা, পাঠান সেনাদের পরাজিত করার সংবাদ মুঘল সম্রাট আকবরের কাছে পৌঁছায়। এই সংবাদ আকবরের কাছে পৌঁছনোর পর আকবর ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতা করতে ইচ্ছা করেন।
এর কারণ ছিল; তৎকালীন সময় অবিভক্ত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা, যাকে সুবে বাংলা বলা হতো, তার সুবেদার ছিলেন মান সিংহ। কিন্তু সেই সময়ে অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন অংশে পাঠানদের অত্যাচার ছিল। পাঠানগণ মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন বাণিজ্যকেন্দ্রে হামলা ও লুটপাট করতো। এজন্য চিন্তিত ছিলেন আকবর কারণ ঐ সময় বাংলা ছিল সোনার বাংলা!
রাণী ভবশঙ্করী অসাধারণ রণকৌশল ও বীরত্বে সেই পাঠান সৈন্যদের পরাজিত করেছিলেন। আকবর ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যে মান সিংহকে প্রেরণ করেন। মান সিংহ ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেন। সেইসঙ্গে আকবর ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের সার্বভৌমত্ব মেনে নেন। মুঘল সম্রাট আকবর রাণী ভবশঙ্করীকে ‘রায় বাঘিনী’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
অনেকগুলো যুদ্ধে রাণী ভবশঙ্করী উগ্রবাদী মুঘল, পাঠান, সুলতানদের সেনাদের পরাজিত করে রাজ্যকে রক্ষা করেন। বিশ্বাসঘাতকদের সহায়তায় লুটেরাদের দল কয়েকবার তাঁর সাম্রাজ্য আক্রমণ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তখন রাণী ভবশঙ্করীর বীরত্ব ও প্রবল বিক্রমের কারণে মুঘল সম্রাট আকবর পযর্ন্ত এই সাম্রাজ্যের দিকে তাকানোর সাহস পায়নি। সম্রাট আকবর রাণী ভবশঙ্করীকে “রায়বাঘিনী” উপাধিতে ভূষিত করার পর থেকে রাণী ভবশঙ্করী “রায়বাঘিনী রাণী ভবশঙ্করী” নামে পরিচিত হয়। এরপরে বহুদিন পর্যন্ত ভূরশুট রাজ্য স্বাধীন ছিল।
রায় বাঘিনি রাণী ভবশঙ্করীর কাশীধামে গমন :
সারা জীবন নিরাপত্তার সঙ্গে রাজ্য পালনের পরে শেষ জীবনে পুত্র প্রতাপ নারায়ণকে রাজ্যভার প্রদান করে কাশীতে তপস্যা করার জন্য গমন করেন রায়বাঘিনী রাণী ভবশঙ্করী। হাওড়া জেলার উদনারায়নপুরে রাণী ভবশঙ্করী প্রতিষ্ঠিত রায়বাঘিনী মন্দির এখনো গড় ভবানীপুর জীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তাঁরই স্মৃতিতে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ভারতের সরকারের উদ্যোগে প্রতি বছর হাওড়ায় উদয় নারায়ণপুরে “রায়বাঘিনী ভবশঙ্করী” মেলা অনুষ্ঠিত হয়। রায়বাঘিনী রাণী ভবশঙ্করী স্মৃতি বিজড়িত এই জায়গা প্রাচীন ইতিহাসের বহু নিদর্শন নিয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
রায়বাঘিনী রাণী ভবশঙ্করীর এই বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস রাজ্যের মানুষের কাছে তুলে ধরতে, গড়ভবানীপুরের এই জায়গাটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয় কয়েক বছর আগে। স্থানীয়দের মতে, তারপর থেকেই এই জায়গাটিকে সংস্কার করার কাজ শুরু হয়। কিন্তু প্রাচীন ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরটিকে সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এছাড়া উদয় নারায়ণপুরে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে “রায়বাঘিনী ভবশঙ্করী অডিটোরিয়াম” নির্মিত হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ইতিহাসের পাতায় রায়বাঘিনী রাণী ভবশঙ্করীর নাম এখনো জ্বলজ্বল করছে। আর এই কারণে পর্যটকদের পাশাপাশি ইতিহাসবিদদের কাছে এই জায়গাটির গুরুত্ব অপরিসীম।
এই ইতিহাস নিয়ে, নাট্যকার দীনেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত একটি ঐতিহাসিক নাটক ‘রানী ভবশঙ্করী‘ রচনা করেছেন।
রেফারেন্স :
- * হিন্দু সংহতি; শ্রী অমিত মালীর লেখা প্রবন্ধ।
- * মহারাণী ভবশঙ্করী গ্রন্থ।
- * বাংলা প্রবাদে স্থান, কাল, পাত্র; বরুন কুমার চক্রবর্তী।
- * হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি; তারাপদ সাঁতরা।
- * কবি ভারতচন্দ্র; শান্তনু গোস্বামী।
- * বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত; অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
- * মাসিক বসুমতী পত্রিকা; ১৯৬২ সাল।
- * বঙ্গের অনন্ত সামন্তচক্র ও ইসলাম রাষ্ট্রের ইতিহাস; ধনঞ্জয় দাস মজুমদার।
- * বিভিন্ন আর্কাইভ ও পত্র-পত্রিকা থেকে সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ