আমাদের ধর্মের নামই 'ধর্ম' - কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

আমাদের ধর্মের নামই 'ধর্ম' - কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী


ধর্ম বা সনাতন ধর্মের দু'টি প্রধান বৈশিষ্ট্য বেদমন্ত্রে বলা হয়েছে। সে বৈশিষ্ট্য দুটি হল– দিব্য এবং সত্য। অর্থ সনাতন ধর্ম দিব্য, অর্থাৎ অপৌরুষেয় এবং যুগপৎভাবে সনাতন ধর্ম সত্য।


মা না হিংসীজনিতা যঃ পৃথিব্যা 

যে বা দিবং সত্যধর্মা জজান। 

যশ্চাপশ্চন্দ্রা বৃহতীর্জজান 

কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।। 

(ঋগ্বেদ সংহিতা:১০.১২১.০৯)


"যিনি পৃথিবীর স্রষ্টা, যিনি দিব্য ও সত্যরূপ ধর্মের প্রবর্তক এবং ধারক, যিনি অন্তরীক্ষ সহ সকল লােককে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি অনন্ত জলরাশিকে সৃষ্টি করেছেন, যিনি চন্দ্রসহ দীপ্যমান সকল বস্তুকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি যেন আমাদের হিংসা না করেন; সেই তাঁকে ছাড়া আর কাকে আমরা হব্যদ্বারা উপাসনা করব?"

ঈশ্বর দিব্য ও সত্য স্বরূপ ধর্মের প্রবর্তন করেছেন।বেদ সহ সনাতন শাস্ত্রে ধর্ম বলতে শুই ধর্মকে বোঝানো হয়েছে। কারণ ধর্ম একটিই; পরবর্তীতে  ধর্মের নামে বিভিন্ন ব্যক্তি এসেছেন, বিভিন্ন কথা বলেছেন, লোক জড়ো করেছেন। এরপর যখন কোন রাজা সেই মতবাদের সাথে যুক্ত হয়েছে, কোন ব্যবসায়ী যুক্ত হয়েছে, তাই পরবরতীতে ধর্ম নামে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সনাতন ধর্মের ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টো। ঈশ্বর স্বয়ং এ শাশ্বত, চিরন্তন ধর্মের প্রবর্তন করেছেন। বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বেদের মধ্যেই বলা আছে:


যজ্ঞেন যজ্ঞমযজন্ত দেবাঃ

তানি ধর্মাণি প্রথমান্যাসন্।

তে হ নাকং মহিমানঃ সচন্ত 

যত্র পূর্বে সাধ্যাঃ সন্তি দেবাঃ।।

(ঋগ্বেদ সংহিতা:১০.৯০.১৬)

"দেবতারা যজ্ঞের দ্বারা যে মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান সম্পাদন করলেন, তা থেকেই সর্বপ্রথম ধর্মের আবির্ভাব। মহিমান্বিত দেবগণ সাধ্য এবং দেবগণের বাসভূমি স্বর্গলোক এভাবেই সৃষ্টি করলেন।"


ঈশ্বরের প্রেরণায় প্রথম আবির্ভাব হওয়া ধর্ম দিব্য এবং সত্য; ইত্যাদি বিবিধ কথা বেদে বলা হয়েছে। বেদে শুধুই আছের ধর্মের কথা। কারণ ধর্ম একটাই তাই ধর্মের আগে কোন বিশেষ্যের প্রয়োজন হয়নি। শুধু ধর্ম শব্দেই ধর্মকে বোঝানো হয়েছে। ধর্মের আগেপিছে কোন শব্দের প্রয়োজন নেই। ধর্ম নামে যে সকল ব্যক্তিগতকেন্দ্রিক মতবাদ পৃথিবীতে প্রচলিত হয়েছে তারা কখনই শুধু ধর্ম শব্দটি ব্যবহার করতে পারবে না। কারণ ধর্ম পূর্ব থেকেই প্রচলিত এবং শাশ্বত। এর কোন উৎপত্তির দিন নেই, যেদিন থেকেই এ জগতের উৎপত্তি সেদিন থেকেই ধর্মের উৎপত্তি। এ ধর্মকে কে প্রবর্তন করেছেন? স্বয়ং ঈশ্বর করেছেন। বিষয়টি একটি বাস্তব উদাহরণ দিলে সুস্পষ্ট হবে। রাতের অন্ধকারকে দূর করতে পৃথিবীর একটি উপগ্রহ হিসেবে চন্দ্রের উৎপত্তি। এ চন্দ্রের উৎপত্তি কবে হয়েছে, কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না। বিজ্ঞানীরা আনুমানিক একটি সময়কাল বলেন, কিন্তু চন্দ্রের উৎপত্তির প্রকৃত সময় শুধু ঈশ্বরই জানেন। চিনের বিভিন্ন অবিশ্বাস্য অভিনব বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এমনই একটি তাদের অভিনব পরিকল্পনা হল 'কৃত্রিম চন্দ্র'। যে চন্দ্র রাত্রে চিনের আকাশকে আলোকিত করে রাখবে।কথাটা শুনে হেয়ালি মনে হলেও; এ কোনও হেয়ালি নয়। ঠিক এমনটাই বাস্তবায়ন হতে চলেছে চিনে।  আকাশে কৃত্রিম চন্দ্র বানিয়ে রাতের অন্ধকারকে আলোকিত করার প্রচেষ্টা শুরু করেছে চিন। চৈনিক বিজ্ঞানীদের বদৌলতে 'অমাবস্যার চাঁদ' বাংলা এই বাগধারাটিও  সত্য হতে চলছে পৃথিবীতে। 


বিদ্যুতের খরচ কমাতে, স্ট্রিট লাইটের ব্যবহার বন্ধ করতেই এমন অভিনব পরিকল্পনা করেছে ড্রাগনের দেশ চিন। চায়না ডেলি-র রিপোর্ট অনুযায়ী,  সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২০ সালের মধ্যেই এই কৃত্রিম চন্দ্র তৈরি করে ফেলবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন সে দেশের বিজ্ঞানীরা।প্রাথমিক ভাবে চিনের চেঙদু শহরে একটি কৃত্রিম চন্দ্র লাগানো হবে। যদি সেই প্রকল্প সফল হয়, তা হলে ২০২২-এর মধ্যে আকাশে আরও তিনটি চন্দ্র স্থাপন করবে চিন। এমনটাই জানিয়েছেন, 'চেঙদু অ্যারোস্পেস সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মাইক্রোইলেকট্রনিক্স সিস্টেম রিসার্চ ইনস্টিটিউট' এর চেয়ারপার্সন এবং এই 'কৃত্রিমচন্দ্র' প্রকল্পের প্রধান উ চুনফেঙ। প্র বিস্ময়কর প্রকল্প প্রসঙ্গে তিনি বলেন,"চাঁদের আলোতেই আলোকিত হবে এই কৃত্রিম চাঁদ। কিন্তু চাঁদের থেকেও আট গুণ বেশি হবে এই কৃত্রিম চাঁদের আলো। এই কৃত্রিম চাঁদ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আজ নয়, শুরু হয়েছিল দু’বছর আগেই। আর এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে হাজির এই প্রকল্পের কাজ।একজন ফরাসি আর্টিস্টের পরিকল্পনা থেকেই আমাদের মাথায় এই কৃত্রিম চাঁদের চিন্তাভাবনা আসে। প্যারিসের রাস্তায় কী সুন্দর ভাবে আয়না দিয়ে একটি ঝুলন্ত নেকলেস তৈরি করে সূর্যের আলোকে কাজে লাগানোর কথা ভেবেছিলেন তিনি! মানুষের হাতে তৈরি চাঁদ। সেই আলোর প্রাবল্য ওঠানামার বিষয়টাও মানুষেরই হাতে ( 'বিদ্যুৎ খরচ কমাতে কৃত্রিম চাঁদ বানাচ্ছে চিন!', আনন্দবাজার পত্রিকা ২১ অক্টোবর ২০১৮)।’’


সম্পূর্ণ আয়নার মতই কাজ করবে এই কৃত্রিম চন্দ্র। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৫০০ কিলোমিটার উঁচুতে থাকবে এই চন্দ্র। এতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে যে আলোর সৃষ্টি হবে সেটাই আলোকিত করবে চিনের বিভিন্ন শহরকে। তবে প্রকৃতির সম্মতিবিহীন কৃত্রিম কোন কিছুই মানুষের জন্যে কল্যাণকর নয়। কৃত্রিম চাইনিজ চন্দ্রের আলো দ্বারা প্রকৃতি, পরিবেশ এবং পশুপাখি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে বলে আশঙ্কা। 


বর্তমান চন্দ্রের থেকেও আট গুণ বেশি আলো হলেও, এ কৃত্রিম চায়নিজ চন্দ্রের সকল শক্তির উৎস হল আসল চন্দ্র। অর্থাৎ আসল চন্দ্রের আলোতেই কৃত্রিম চন্দ্র আলোকিত হবে। কৃত্রিম চন্দ্রের চাকচিক্য ছাড়া নিজস্ব কোন শক্তি নেই। এই কৃত্রিম চন্দ্রের আলো আসল থেকে আটগুণ আলো হোক বা আটলক্ষগুণ হোক ; এতে কিছুই যায় আসে না। কৃত্রিম সর্বদা কৃত্রিমই থাকে। এ কৃত্রিম চন্দ্রের নাম কখনই শুধু চন্দ্র হবে না। কারণ আসল অকৃত্রিম চন্দ্র পূর্ব থেকেই বর্তমান। তাই এ চন্দ্রকে কৃত্রিম চন্দ্র, চাইনিজ চন্দ্র অথবা মাওসেতুং চন্দ্র এমন কোন শব্দ পূর্বে যুক্ত করে কৃত্রিম চন্দ্রের নামকরণ করতে হবে। চিনের দেখদেখি পরবর্তীতে হয়ত আমেরিকা এমন কৃত্রিম চন্দ্র বানাবে, তখন নামকরণ হবে 'আমেরিকান চন্দ্র' বা 'জর্জ ওয়াশিংটন চন্দ্র'। একইভাবে গ্রেট ব্রিটেন বানালে ব্রিটিশ চন্দ্র; ফ্রান্স বানালে ফরাসি চন্দ্র; ইতালি বানালে ইতালিয়ান চন্দ্র; জার্মানি বানালে জার্মান চন্দ্র; রাশিয়া বানালে রাশিয়ান চন্দ্র -এ প্রকারের হয়ত নামকরণ করতে হবে। কৃত্রিম চন্দ্র যতই চাকচিক্যময় হোক এর আগে কোন বিশেষ্য বা বিশেষণ বাচক কোন একটি শব্দ যুক্ত করতেই  হবে। শুধু কোন অতিরিক্ত শব্দ যুক্ত করতে হবে না আসল চন্দ্রের ক্ষেত্রে। কারণ আমাদের সৌরমণ্ডলে পৃথিবীর উপগ্রহ চন্দ্র একটিই; এর কোন দ্বিতীয় নেই। তাই আসল চন্দ্রের আগেপিছে কোন শব্দেরও প্রয়োজন নেই।


স্বয়ং ঈশ্বর যে ধর্মের প্রবর্তন করেছেন;আমরা সেই চিরন্তন ধর্মের অনুসারী।ধর্মের আগে কোন বিশেষ্য বা বিশেষণ নেই যে অমুক ধর্ম, তমুক ধর্ম। এ ধর্ম সত্য, তাই তাকে সত্যধর্ম বলা হয়। এ ধর্ম শাশ্বত চিরন্তন, তাই তাকে সনাতন ধর্ম বলা হয়। এই ধর্ম সৃষ্টির নিয়মে সুশৃঙ্খলভাবে প্রবাহিত, তাই তাকে ঋতম্ বলা হয়।এ শব্দগুলো শুধুই ধর্মের সমার্থক শব্দ। এ শাশ্বত ধর্মই আজ সনাতন ধর্ম নামে পরিচিত এবং জনপ্রিয়। আরেকটি জনপ্রিয় পরিচয় হল, হিন্দুধর্ম নামে। হিন্দু শব্দটি হল একটি ভৌগোলিক জাতিগত পরিচয়। এ ভৌগোলিক জাতিগত পরিচয়টি নবীন। মাত্র কয়েক সহস্রাব্দের।  শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা, বিতস্তা, সিন্ধু ও সরস্বতী এই সাতটি নদীর অববাহিকা অঞ্চলকে এককথায় সপ্তসিন্ধুবিধৌত অঞ্চল বলে। এ পবিত্র  সপ্তসিন্ধু অববাহিকায় যারা বসবাস করে তারাই হিন্দু। কিন্তু পরবর্তীতে সপ্তসিন্ধুবিধৌত অঞ্চলের পরিচয়টি সম্প্রসারিত হয়ে বৃহত্তর ভারতবর্ষে যারা পুরুষানুক্রমে বসবাস করে, তারা সকলেই হিন্দু নামে খ্যাত হয়।


কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


https://www.facebook.com/KushalBaranBD/posts/pfbid02QKY3Mqoz9TMLqZLgqfzzcrGPZ1hsmHLA53M5DyyA2dAoPfhBx12RYU1zecqCxhNnl

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ