সংখ্যালঘু কমছে কেন?
সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশিত: জুলাই ২৮, ২০২২ , ৮:১৭ পূর্বাহ্ণ আপডেট: জুলাই ২৮, ২০২২ , ৮:১৮ পূর্বাহ্ণ
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আদমশুমারি হয় ১৯৭৪ সালে। তখন মোট জনসংখ্যার ১৩ দশমিক ৫ ভাগ ছিল হিন্দু। এরপর ১৯৮১ সালে ১২ দশমিক ১ ভাগ, ১৯৯১ সালে ১০ দশমিক ৫, ২০০১ সালে ৯ দশমিক ৩ ভাগ হিন্দু লোকের বসবাসের তথ্য উঠে আসে আদমশুমারিতে। ২০১১ সালের আদমশুমারিতে বলা হয়, মোট জনগোষ্ঠীর ৮ দশমিক ৫ ভাগ হিন্দু। এতে স্পষ্ট যে স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে কমেছে।
দেশে সংখ্যালঘু কমে যাওয়ার দাবি দীর্ঘ দিন ধরেই করছিলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে গত কয়েক বছর ধরেই দাবি করা হচ্ছিল, এই সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু গতকাল বুধবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মুসলিম জনসংখ্যা বেড়েছে, কমেছে অন্যান্য ধর্মের মানুষ। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিন্দু জনসংখ্যা ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ থেকে কমে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ, বৌদ্ধ জনসংখ্যা শূন্য দশমিক ৬২ থেকে কমে শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ, খ্রিস্টান জনসংখ্যা শূন্য দশমিক ৩১ থেকে কমে শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ এবং অন্যান্য ধর্মের জনসংখ্যা শূন্য দশমিক ১৪ থেকে কমে শূন্য দশমিক ১২ শতাংশে নেমেছে।
প্রতি ১০ বছর পর পর আদমশুমারি হলেও প্রতি বছর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিবিএস বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স প্রকাশ করে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে হিন্দু এবং অন্য ধর্মাবলম্বী ১১ দশমিক ৬ ভাগ। এখানে হিন্দুদের শতকরা হার আলাদাভাবে দেয়া হয়নি।
বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তার ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ নামের গবেষণা গ্রন্থে বলেছেন, ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল সময়কালে আনুমানিক ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন। এই গবেষণার বাইরে তিনি তার কিছু পর্যবেক্ষণও তুলে ধরেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের দেশ ত্যাগের ছয়টি কারণ চিহ্নিত করেন তিনি। সেগুলো হলো- এই অঞ্চলে মুসলমানদের প্রজনন হার বেশি, ৬৪ সালের দাঙ্গা, ৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, এনিমি প্রোপার্টি অ্যাক্ট, ভেস্টেড প্রোপার্টি অ্যাক্ট এবং নিরপত্তাহীনতা।
সরকারের পরিসংখ্যানে ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী কমার পেছনে দুটি অর্থ আছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, সরকারি তথ্যও বলছে দেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী কমছে। এ ক্ষেত্রে দুটি অর্থ থাকতে পারে। প্রথমত, সংখ্যালঘুদের হার কম করে দেখানো অতীতের রাষ্ট্রীয় প্রবণতা এবং বাংলাদেশ যে ক্রমশই ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে বা ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গেছে এটি দেখানো। দ্বিতীয়ত, সংখ্যালঘুদের জন্য পাকিস্তান যা ছিল বাংলাদেশও তাই আছে। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হলেও সংখ্যালঘুদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি বরং পরিস্থিতি তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করছে। আর এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ড. আবুল বারকাতের ভাষায়, দুই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য হয়ে যাবে। তখন বাংলাদেশ হবে আফগানিস্তান। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ আফগানিস্তান হতে চলেছে। যদি পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব এই দাঁড়ায়, তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি গোটা জাতি একটা বিপর্যয়ের দিকে চলেছি।
সংখ্যালঘু কমার পেছনে হিন্দুদের প্রজনন ক্ষমতা কম বলে বলা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শীর্ষস্থানীয় এই নেতা বলেন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে পরিবার প্রতি জনসংখ্যার যে হার তাতে দেখা যাচ্ছে হিন্দু-মুসলমান জনসংখ্যার সন্তান উৎপাদনের হার একই। এই হার মুসলমানদের ক্ষেত্রে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ বেশি। তাই এই যুক্তিটি সঠিক নয়।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. চন্দ্র নাথ পোদ্দার মনে করেন, গত ১০ বছর ধরে অব্যাহতভাবে ঘটে যাওয়া সহিংসতা, নির্যাতন, উচ্ছেদের কারণে হিন্দু জনগোষ্ঠী কমছে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, অবকাঠামোর দিক থেকে পরিবর্তন হচ্ছে ঠিকই, অন্য কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।
পূজা উদযাপন পরিষদের সহসভাপতি জয়ন্ত কুমার দেবও মনে করেন, নিরাপত্তার অভাবেই সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করছে আর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী কমছে।
দীর্ঘ দিনের নির্যাতন ও বঞ্চনার কারণে সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব এডভোকেট গোবিন্দ প্রামাণিক। পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের কম করে দেখানোর মানসিকতাও আছে বলে তিনি মনে করেন। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী কমার পেছনে দেশত্যাগ তো একটি বড় কারণ। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা আশা করেছিলাম, বাংলাদেশ যেহেতু স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশ, সেখানে মানুষ দেশত্যাগ করবে না। ১৯৭১ সালের পর পরই অত্যাচার নিপীড়নের কারণে অনেক সংখ্যালঘু দেশত্যাগ করে। সরকার শত্রু সম্পত্তি আইন পুনরুজ্জীবিত করায় অনেকেই বাড়ি ঘর ফিরে পায়নি। অনেকে দেশে ফিরে এসেও থাকতে পারেনি। সরকারের হিন্দুদের কম করে দেখানোর প্রবণতাও থাকতে পারে। কারণ সংখ্যা অনুপাতে হিন্দুরা যাতে কোনো জোরালো দাবি না করতে পারে।
https://www.bhorerkagoj.com/2022/07/28/%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%96%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%98%E0%A7%81-%E0%A6%95%E0%A6%AE%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8/
0 মন্তব্যসমূহ