মা দুর্গা সপ্তমিথ - তমাল দাশগুপ্ত

মা দুর্গা সপ্তমিথ - তমাল দাশগুপ্ত
১৮৪০ সালে বাংলায় উৎকীর্ণ এই টেরাকোটা দুর্গামূর্তির বর্তমান অবস্থান ব্রিটিশ মিউজিয়াম।


মা দুর্গা সপ্তমিথ - তমাল দাশগুপ্ত


১. মহিষাসুরকে বধরত দুর্গামূর্তি আর্য আগ্রাসনের প্রতীক। এটা সত্যি নয়।


মাতৃকা উপাসক হরপ্পা সভ্যতায় মহিষমেধ প্ৰচলিত ছিল, প্রত্নসাক্ষ্য থেকে জানা যায়। মায়ের উৎসবে মহিষবলি দেওয়া হত। এখান থেকে মহিষমর্দিনী এসেছেন, মহাভারতে অর্জুনের দুর্গাস্তবে মাকে মহিষসৃকপ্রিয় বলা হয়েছে, অর্থাৎ মহিষের রক্ত যাঁর প্রিয়।

এই মহিষ পরবর্তী কালে anthropomorphic পরিবর্তনে মহিষাসুর হয়েছে, মোষটাকে অসুর কল্পনা করা হয়।


২. শারদীয়া পুজো আগে ছিল না, রামচন্দ্র অকাল বোধন করেন। এটা সত্যি নয়।


বাল্মীকি রামায়ণে এমন কোনও কাহিনী নেই, বাল্মীকির রাম সূর্যের উপাসনা করেছিলেন। বাংলায় রামকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে অকাল বোধনের কাহিনী প্রথম মধ্যযুগে কৃত্তিবাস প্ৰচলিত করেন। শারদীয়া মাতৃকার উৎসব সুপ্রাচীন। হরপ্পা সভ্যতায় ঊষা ও নিশার উপাসনা হত, ঊষার শারদীয়া বোধন দিয়ে শুরু এবং হেমন্তের কার্তিকী অমাবস্যায় নিশার উপাসনা দিয়ে শেষ। আজকের দুর্গা কালী পুজো হরপ্পা সভ্যতা থেকে এসেছে।


৩. দুর্গাপুজো খুব অর্বাচীন, মধ্যযুগে তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ প্রথম শুরু করেন। এটা মিথ, সত্য নয়।


কংসনারায়ণ মধ্যযুগে নতুন করে জাঁকজমকের মাধ্যমে দুর্গা পুজো শুরু করেন। কিন্তু তার অনেক আগেই, এই মধ্যযুগেই চণ্ডীচরণপরায়ণ বলে নিজেদের আখ্যায়িত করেছেন দনুজমর্দনদেব ও মহেন্দ্রদেব। 


৪. সিরাজ পতনের ফলে দুর্গাপুজো শুরু হয়, আগে ছিল না। সত্যি নয়, এটাও মিথ। 


কলকাতা অঞ্চলে সাবর্ণ পরিবার দুর্গাপুজো করছেন সপ্তদশ শতকের প্রথম থেকেই। চিত্তেশ্বরী দুর্গার মন্দিরও সপ্তদশ শতকের প্রথমেই স্থাপিত। অর্থাৎ সিরাজ পতনের দেড়শ বছর আগেই নথিবদ্ধ দুর্গাপুজো হত কলকাতায়।


৫. বাংলায় দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক সেনদের আমলে, আগে ছিল না। এটাও মিথ, একেবারেই সত্য নয়।


পালযুগে নবম শতকের গৌড়বঙ্গে প্রথম অষ্টভুজা দুর্গামূর্তি পাওয়া গেছে। দশম শতকে রাজা মহীপাল ভবানী মন্দির স্থাপন করেন। এই সময় থেকে নিয়মিত দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী সিংহবাহিনী দুর্গার মূর্তি পাওয়া যাচ্ছে। শরৎকালে উমাপুজোর মহা ধুমধাম হত রামপালের সময়ে, জানা যায়। বস্তুত পাল ও সেনযুগের মধ্যে অনেকগুলো ধারাবাহিকতার একটি হল দুর্গাপুজো যা পালযুগের সহজ আন্দোলনের সমকালীন। 


বাঙালির মাতৃকা উপাসনা চার সহস্র বছর পুরোনো। যতদিন বাঙালি ততদিন মাতৃকাধর্ম। এই মাতৃকাধর্মে বাঙালির সংজ্ঞায়ন হয়। চার সহস্র বছর আগে পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে মাতৃকা উপাসনার নিদর্শন পাওয়া যায়। তা অন্তিম হরপ্পা সভ্যতার সমসাময়িক। হরপ্পা সভ্যতার তন্ত্রনির্ভর মাতৃকাধর্মের উত্তরাধিকার বহন করে বাঙালি, হরপ্পা সভ্যতা পরিত্যক্ত হলে পূর্ব ভারতে তন্ত্রাশ্রয়ী মাতৃকা উপাসক সভ্যতার ভরকেন্দ্র সরে আসে।


৬. দুর্গাপুজো একটি বৈদিক সনাতনী উৎসব। এটা মিথ, সত্য নয়। 


দুর্গাপুজো একেবারেই বৈদিক উৎসব নয়, এটি সম্পূর্ণ অবৈদিক, ব্রাত্যধর্মীয় তন্ত্রাশ্রয়ী উৎসব। হরপ্পা সভ্যতার প্রধান মাতৃকা ছিলেন ঊষা। তাঁর বোধন হত শরৎকালে। সেই সময়েও মায়ের পুজোয় বলি বা মেধ অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল যার স্মৃতি আজকের সন্ধিপুজো বহন করে। শস্যমাতৃকার উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য আজকের নবপত্রিকা।


৭. দুর্গাপুজো, অথবা তন্ত্র বা মাতৃকা উপাসনা একটি ধর্মীয় কুসংস্কার, আমাদের ধর্মমুক্ত মানবতা ও ধর্মমুক্ত বাঙালিয়ানা গড়তে হবে। একেবারেই মিথ, অতীব অবাস্তব।


বাঙালির ধর্ম বাঙালির মেরুদণ্ড। যারা বাঙালিকে তার সহস্র সহস্র বছরের প্রকৃতিমাতৃকাধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছেন তারা অবশ্যই বাঙালির শত্রু। আদি সাংখ্য ও তন্ত্রের প্রকৃতি একেবারেই ঈশ্বর আল্লা গড ধরণের ভাববাদী মানবকল্পনা নন। আদ্যা ও নিত্যা প্রকৃতি হলেন জগদকারণ। তিনি অব্যক্ত, আমরা বোঝার সুবিধার জন্য মা বলি। 


পৃথিবীর কোনও ধর্ম যদি একুশ শতকের জন্য উপযোগী হয় তবে তা বাঙালির তন্ত্রাশ্রয়ী মাতৃকাধর্ম।


এই প্রবন্ধের প্রত্যেক শব্দ আমার দীর্ঘ গবেষণা এবং কয়েক হাজার পুস্তক ও গবেষণাপত্র দ্বারা সমর্থিত, এই পেজে এই প্রত্যেক পয়েন্ট নিয়ে আগে অনেকবার লিখেছি।


মা আসছেন, আর বেশি দেরি নেই।


© তমাল দাশগুপ্ত


https://www.facebook.com/tdasgupto/posts/pfbid02xg16QsKCHnML4DSWm3auJD5f5b3uvtPHXjWo6ttzgyVDCK9jwsPBovY2gjwdq2Pil


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ