ফেসবুক, গুজব ও সাম্প্রদায়িক হামলা | চিররঞ্জন সরকার

ফেসবুক, গুজব ও সাম্প্রদায়িক হামলা | চিররঞ্জন সরকার

চিররঞ্জন সরকার, ০৮ নভেম্বর, ২০১৬


আমাদের দেশের মানুষ আশ্চর্য স্ববিরোধিতা দিয়ে গড়া। এখানে সাম্প্রদায়িকতা, জাতিবিদ্বেষ এবং ‘মানুষ মানুষের জন্য’ বলে কিছু মানুষের আন্তরিক আকুতি প্রায় একইসঙ্গে চলে। অসাম্প্রদায়িকতা প্রশংসা ও প্রয়োজনীয়তা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন, নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণ এখানে একই সঙ্গে চলে। এখানে ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান, মিলিয়া…’ গানটি খুবই জনপ্রিয়, আবার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ করার জন্য লোকের অভাব হয় না। এখানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘মোরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’ কিংবা ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা'র!. . .’ কবিতা আবৃত্তি করে অসাম্প্রদায়িকতার ভান করার জন্য প্রচুর মানুষ পাওয়া যায়।


আবার এই ধর্মপ্রাণ মানুষেরাই মুহূর্তের মধ্যে কোনো কারণ ছাড়াই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা বোধ করে না। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের জন্য এখানে মানুষের ছবি চাঁদে দেখার গুজব মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। ফেসবুকে ‘ধর্ম অবমাননা’র খবর রটিয়ে দিয়ে শত শত হিন্দুবাড়িতে আক্রমণ চালাতে দেখা যায়!


জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, নির্যাতন, প্রতিমা ভাঙচুর, লুটপাট, ভয় দেখানো ইত্যাদি আমাদের দেশে আগে থেকেই ছিল। কিন্তু অতীতে মূলত নির্বাচন, ভোটের রাজনীতি, ভূমি ও সম্পত্তি দখল, নারীদের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি ইত্যাদিই ছিল সংখ্যালঘু নির্যাতনের পেছনে মূল উপজীব্য। সে সময় মৌলবাদী উপায়ে সশস্ত্র হামলা করে সংখ্যালঘু নির্যাতন করা হতো। ইদানীংকালে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনে যুক্ত হয়েছে একটি নতুন মাত্রা। সেটি হচ্ছে-‘ইসলাম এবং নবী নিয়ে কটূক্তি করেছে’ এমন গুজব রটিয়ে সংখ্যালঘুদের উপর নারকীয় তাণ্ডব চালানো। বেশ ভালো একটা কৌশল অবলম্বন করছে নির্যাতনকারীরা। ফেসবুক, ব্লগ ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন গুজব-বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ফেসবুক এখন অনেক ধর্মীয় সংখ্যালঘুর নিঃস্ব হওয়ার কারণে পরিণত হয়েছে।


বিগত কয়েক বছরের এধরনের (কটূক্তির অভিযোগ তুলে) নির্যাতনের হার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।


এ ধরনের মিথ্যা গুজব রটিয়ে ব্যক্তিগত সংখ্যালঘু নির্যাতন থেকে শুরু করে সমষ্টিগত অর্থাৎ, কোনো একটি গ্রাম কিংবা সম্পূর্ণ এলাকার উপর ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে।নিচে তেমনই কিছু ঘটনার উল্লেখ করা হল।


রামুতে সাম্প্রদায়িক হামলা: ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামু উপজেলার উত্তম বড়ুয়া নামে একজন ব্যক্তির ফেসবুক আইডিতে কে বা কারা কোরআন অবমাননামূলক একটি ছবি ‘ট্যাগ’ (Tag) করে দেন। তারপর গুজব রটানো হয় উত্তম বড়ুয়া কুরানের উপর পা তুলে ছবি আপলোড দিয়েছেন।


ব্যস সে রাতেই হামলা করা হয় রামুর ১২ টি বৌদ্ধ মন্দির এবং ৪০ টি বাড়িতে। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ মন্দির পুড়িয়ে সম্পূর্ণ ছাই করে দেওয়া হয়। তারপর দিন চট্টগ্রামের পটিয়া থানার দুটি বৌদ্ধ মন্দির ও দুটি হিন্দু মন্দির ভাঙচুর করা হয়। অথচ সত্যি হচ্ছে উত্তম বড়ুয়া তেমন কোনো ছবি আপলোড করেন নি কিংবা কোনো ব্যক্তি কোরআন অবমাননা করেন নি। সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছিলো।


কুমিল্লার হোমনা: ২০১৪ সালের ২৮ এপ্রিল কুমিল্লার হোমনা উপজেলার বাকসীতারামপুর গ্রামে ফেসবুকে মহানবীকে নিয়ে কটূক্তি করেছে এমন গুজব রটিয়ে ৩৫ টি হিন্দু বাড়িঘর ও ১ টি মন্দির ভাঙচুর করে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও সেখানকার স্থানীয় মুসলমানেরা। প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার লোক এই হামলায় অংশ নেয়।


কেউই যাচাই করার প্রয়োজনও দেখে নি; আসলেই কি কেউ নবীকে নিয়ে কটূক্তি করেছে কি না!


পাবনার সাঁথিয়া: ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর ফেসবুকে মহানবী ও ইসলাম নিয়ে কটূক্তি করা হয়েছে এমন গুজব রটিয়ে পাবনার সাঁথিয়ায় শতাধিক হিন্দু বাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট চালানো হয়।


সাতক্ষীরা উপজেলার ফতেপুর: ২০১২ সালের ৩০ মার্চ নাটকে ইসলাম অবমাননা করা হয়েছে এই অভিযোগে সাতক্ষীরা ফতেপুর ইউনিয়নের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ন্যক্কারজনক হামলা চালানো হয়। এ সময় ১৫ টি হিন্দু বাড়িঘর লুটপাট করে হামলাকারীরা। তারপর বাড়িগুলো আগুন লাগিয়ে ভস্ম করে দেওয়া হয়।


সর্বশেষ নাসিরনগরে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে নজিরবিহীন তাণ্ডব চালানো হয়েছে। রসরাজ নামের ছেলেটির বিরুদ্ধে ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটা একেবারেই বানোয়াট। সে লেখাপড়া জানে না। মাত্র ক্লাস ফাইভ-সিক্স পর্যন্ত পড়েছে। তার পক্ষে তো ফটোশপের মতো টেকনিক্যাল বিষয় জানা সম্ভব নয়। এটা অন্য কেউ করে তার নামে চালিয়েছে। ঠিক যেভাবে রামুর ঘটনায় করা হয়েছিল।


আমাদের দেশের মানুষ এখনও হুজুগে মাততে পছন্দ করে। ধর্ম অবমাননার হুজুগ তুলে সাম্প্রদায়িকতার উন্মত্ত নেশায় মাতোয়ারা হতে একশ্রেণির মানুষের উৎসাহের শেষ নেই। ফেসবুকের ইতিবাচক দিক অনেক। এক শ্রেণির মানুষ সেই ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ না করে ঝুঁকছে নেতিবাচকের দিকে। এ ব্যাপারে বিশেষ চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। আমাদের দেশে এখনও অনেক মানুষই ফেসবুক বা ব্লগের টেকনিক্যাল দিকগুলো ভালো বোঝেন না। অনেকে তো আরেকজনের সহযোগিতা নিয়ে ফেসবুক আইডি খোলেন, ফেসবুক ব্যবহার করেন। পাসওয়ার্ড পর্যন্ত নিজে জানেন না। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের অনেকেই ‘ট্যাগ’ কী জানেন না। ডিজিটাল জালিয়াতি ফটোশপ করে কীভাবে মিথ্যাকে সত্য রূপ দেওয়ার চেষ্টা হয় সেটাও বোঝেন না।


রামুর উত্তম কিংবা নাসিরনগরের রসরাজের মত যে কেউ যে কোনো সময় নিশানা হতে পারেন। ফেইসবুককে কেন্দ্র করে সংগঠিত এসব অপরাধ মোকাবেলা করতে হলে ফেসবুক সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর বিকল্প নেই। কেবল তথ্যপ্রযুক্তি আইন দিয়ে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না।


নাসিরনগরের ঘটনায় পুলিশ, প্রশাসন, স্থানীয় আইনজীবী, হামলাকারীরা সবাই যেন উন্মাদনায় একাট্টা হয়েছে। হামলাকারীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে আইনজীবীরা। কিন্তু রসরাজের পক্ষে কোনো আইনজীবী নেই!জামায়াত, আওয়ামী লীগের আইনজীবীরা একাট্টা হয়ে দাঁড়িয়েছে হামলাকারীদের পক্ষে। রসরাজ যদি ধর্ম অবমাননাকর অপরাধ করেও থাকে তাহলে তার এই বিকৃত এবং ঘৃণ্য অপরাধের জন্য রাষ্ট্রীয় আইনে তার বিচার এবং সাজা হবে। পুলিশ তো তাকে গ্রেপ্তার করেছে। কেউ যদি অপরাধ করে থাকে তাহলে এর মাশুল তার পুরো সম্প্রদায় এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিতে হবে কেন? এমন অবিচার ইসলাম এবং রাষ্ট্রীয় আইনি ব্যবস্থা-কোনোটার সঙ্গে যায় কি?


নাসিরনগরে বিক্ষোভ সভা-সমাবেশ করে রীতিমতো সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে সহিংসতার ক্ষেত্র তৈরি করে সহিংসতা চালানো হয়। ৩০ অক্টোবরের বিক্ষোভ সমাবেশে স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ওসি উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা এখন যে অজুহাতই দেখান না কেন আসলে তাঁদের পেশাগত এবং রাষ্ট্রীয় কর্তব্য কি এটা ছিল?


সংবিধানে বলা আছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটাতে পারে এখন বেআইনি সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে এমন সভা-সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করে দিতে হবে। সংবিধানে সমাবেশের স্বাধীনতা বলতে বলা হয়েছে– “জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।”


একটা উপজেলার ভালো-মন্দ দেখার দায়দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত এবং যারা রাষ্ট্র ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ এবং সরকারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত তারাই তাদের কর্তব্য পালন করলেন না! এলাকায় ২৮ অক্টোবর থেকে টান টান উত্তেজনা বিরাজ করার খবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসপি, জেলা প্রশাসক কি জানতেন না? জানবেন না-ই বা কেন? তাঁরা কি আগাম কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন? এত ক্ষত, এত ক্ষতির পরও কী তারা শুধু ‘প্রত্যাহারেই’ পার পেয়ে যাবে?


দুই.

নমস্য ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ‘বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি’ শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছিলেন–


‘‘১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা হয়েছে। বরিশাল জেলার আগরপুর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণদিয়া গ্রামে কয়েক হাজার হিন্দু আশ্রয় নেয়। তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন বরিশাল সদর মহকুমা মুসলিম লীগের সভাপতি, বরিশাল জেলা মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি এবং আগরপুর ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট আলতাফউদ্দীন। তিনি কিছুসংখ্যক গ্রামবাসী নিয়ে দাঙ্গা প্রতিরোধ করার সংকল্প করেন এবং নিজেই বন্দুক হাতে আশ্রয়প্রার্থীদের প্রহরায় নিযুক্ত হন।


১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে দাঙ্গাকারীরা দল বেঁধে আক্রমণ করতে আসে। আলতাফউদ্দীন তাদের নিরস্ত করতে ফাঁকা গুলি ছোড়েন। দুর্বৃত্তেরা দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করে বল্লম ছোঁড়ে। আলতাফউদ্দীন তাতে বিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে তারা তাকে হত্যা করে। তার আত্মাহুতিতে দাঙ্গা প্রতিরোধ করতে অনেকে এগিয়ে আসে এবং পরদিন বরিশালের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে এক সশস্ত্র পুলিশ-বাহিনী ওই গ্রামে এসে দাঙ্গা দমন করতে থেকে যায়। আলতাফউদ্দীনের আত্মত্যাগের ফলে সেদিন বহু প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল।


১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে সীমান্তের দুপারে আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয়। ঢাকায় নবাবপুর রোডে ছিল আমীর হোসেন চৌধুরীর রিমা কেমিক্যালসের কারখানা এবং তার বাসভবন। আমীর হোসেন চৌধুরী ছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কনিষ্ঠ ভগ্নী হোমায়েরা খাতুনের একমাত্র পুত্র। দাঙ্গার সময়ে প্রতিবেশি হিন্দুর বাড়ি আক্রান্ত হলে আমীর হোসেন চৌধুরী তাদের রক্ষা করতে ছুটে যান এবং দুর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ হারান। তখন তাঁর বয়স ছিল ৫৩ বছর।


সেবারই দাঙ্গা প্রতিরোধ করতে গিয়ে আরও একজন আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। তিনি জিন্নাত আলী মাস্টার। সে বছরের শেষে প্রকাশিত জীবনকথা বইটি জসীমউদ্দীন উৎসর্গ করেছিলেন আমীর হোসেন চৌধুরী, জিন্নাত আলী মাস্টার আর যারা নিজের জীবন


বিপন্ন করেও দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা দূর করতে চেয়েছিলেন, তাদের সকলকে।


বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির এই চিত্র এখন ইতিহাস। এখন আক্রমণ হয়, পুড়িয়ে দেওয়া হয়, সংখ্যালঘুরা নীরবে মার খায়, কিন্তু প্রতিবাদ হয় না। ফলে আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতা এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হাতে সংখ্যালঘু মানুষের একতরফা আক্রমণে পরিণত হয়েছে।’’


সমস্যা হল, এসব কথা এখন কে বলবে, কে শুনবে? কে মানবিক সমাজ গড়ার ডাক দেবে? এখন যে আক্রমণকারীর তালিকায় জামায়াত, হেফাজত, বিএনপি, আওয়ামী লীগ সব একাকার হয়ে যায়!


সূত্র: সিলেট টুডে ২৪

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ