28 June 2025
আসুন আমরা আজ একটি একাডেমিক আলোচনা করি।
কম্পারেটিভ রিলিজিয়নের আলোচনা আমাদের সব ধর্ম-মতবাদের ভাইবোনদেরই জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবে।
গত ২ দিন ধরেই ছবিতে দেয়া পোস্টটি বিভিন্ন ইসলামিক পেজে এবং অন্যান্য সাধারণ পেইজেও ঘুরাঘুরি করছে। শিক্ষাবার্তা নামক একটি পেইজে এটা দেয়ার পর শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন হিন্দুদের শাস্ত্রীয় কাউন্টারের মুখে তারা পোস্টটি ইডিট করে ছবি ও লেখাটি বাদ দিয়ে দেয়। আবার অনেক সাধারণ মুসলিম ভাইবোনেরাও অজ্ঞতাবশত এই পোস্টটি শেয়ার করে খুব সুপিরিয়রিটি ভাব নিয়ে ক্যাপশন দিচ্ছেন "You can never create your creator"। আসুন আমরা শাস্ত্রীয়ভাবে ও তথ্যগতভাবে তাদের এই ভুল ধারণাটির যৌক্তিক সমালোচনা করি।
১. ছবিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি যিশু খ্রিষ্টের একটি ভাস্কর্য তার নিচে ক্রস চিহ্ন, পৌরাণিক দেবতা গণেশের একটি প্রতিমা ও তার নিচে পরমেশ্বরের সর্বোচ্চ নাম পবিত্র ওঁ, তারপর গৌতম বুদ্ধ এবং নিচে ধর্মচক্র। এই ধর্মচক্র প্রতীকটি আবার মূলত বৈদিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকেই নেয়া, নামটিও সংস্কৃত ভাষায়।
আমরা এই ছবিতে সনাতন ধর্মের যে অংশটি রয়েছে সেটির উদাহরণ দিয়েই দেখি বিষয়টা।
ওঁ পরমাত্মার সর্বোচ্চ নাম, এটি লিখলে সেই লেখাটি নিজে পরমাত্মা হয়ে যায়না। মুসলমান ভাইবোনেরাও তাদের ঘরবাড়ি, মসজিদ,মাদ্রাসায় তাদের স্রষ্টার আরবি নাম, কালেমা প্রভৃতি লিখে ছবি ঝুলিয়ে রাখেন।
অপরদিকে দেবতা গণেশের যে প্রতিমূর্তি তা মাত্রেই তাকে কোন পৌরাণিক মতাবলম্বী সনাতনীই ঈশ্বর মনে করেন না, এটি কেবলই দেবতার একটি ছবি বা ভাস্কর্য বা মূর্তি। তারা একে মাধ্যম হিসেবে স্বীকার করে উপাসনার। কোন শ্রদ্ধেয় বা পূজনীয় কারও ছবি বা মূর্তিকে সারাবিশ্বেই সম্মান দেখানো হয়। যেমন প্রতিটা আমেরিকানই জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিকে সম্মান করেন, কিন্তু ছবিটিকেই তারা জর্জ ওয়াশিংটন মনে করেন না। এখন কোন আমেরিকান জর্জ ওয়াশিংটনের মূর্তি বানালে আপনি যদি তাকে গিয়ে বলেন "আপনি আপনাদের জাতির জনককে বানিয়েছেন, You can never create your own creator" তাহলে সেটি আপনারই মূর্খতা প্রমাণ করবে। পুরাণ মতে সাকার দেবতার মূর্তি কেউ বানাতেই পারে, ছবি কেউ আঁকতেই পারে। যে দেবতা/মহাপুরুষ/বিশেষ ব্যক্তির আকার রয়েছে তার ছবি,মূর্তি তৈরী করাই যৌক্তিক বিষয়, এটা না অসম্ভব, না অযৌক্তিক। কারও মূর্তি বানালেই তাকে বানানো হয়ে যায়না। আর এখানে আরও একটি কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, দেবতারা কিন্তু স্রষ্টা বা ঈশ্বর নন, তারা ঈশ্বরানুগত। সেটা বৈদিক মতে মানুন বা পৌরাণিক মতে, মহাদেব শব্দটা এজন্যই এসেছে যে যিনি সকল দেবেরও দেব। সুতরাং তাদের ক্ষেত্রে You can never your own creator কথাটা বলার কোন সুযোগই নেই।
২. এখন কোন মুসলিম ভাইবোন প্রশ্ন করতে পারেন
"কেন দেবতারা সাকার? তারা কেন নিরাকার নন? আল্লাহ তো নিরাকার তাই আমরা আল্লাহের কোন প্রতিমূর্তি বানাই না।"
সেক্ষেত্রে বলতে হবে প্রিয় মুসলিম ভাইবোনেরা আপনারা আপনাদের নিজেদের রিলিজিয়নের গ্রন্থই জানেন না, জানেন না আপনাদের স্কলারদের এ বিষয়ক সিদ্ধান্তও। আপনাদের রিলিজিয়নের গ্রন্থ কোরান এবং হাদিস অনুযায়ী আল্লাহ সাকার, তার রয়েছে নির্দিষ্ট আকার, নির্দিষ্ট হাত পা চোখ ইত্যাদি, এও লেখা রয়েছে কেয়ামতের দিন মানুষ আল্লাহকে সরাসরি চর্মচক্ষুতে দেখতে পারবে। সকল ইসলামিক স্কলাররাই এ বিষয়ে একমত যে আল্লাহ সাকার। তারা এও বলেছেন যে সাধারণ অনেক মুসলিমরা যে মনে করে আল্লাহ নিরাকার সেটা মূলত তারা বৈদিক সনাতন ধর্মের দ্বারা কালচারালি প্রভাবিত হয়ে মনে করে কেননা বৈদিক সনাতন ধর্মে ঈশ্বর নিরাকার। আমরা সহীহ বুখারি, তাওহীদ পাব্লিকেশনের আল্লাহর হাত, পা, আঙুল, মুখমণ্ডল (সিফাত/গুণ) সম্পর্কিত ২৮ টি হাদিসের ব্যাখ্যার যে অংশটি সেখান থেকে আমরা হুবহু আপনাদের জানার জন্য টেক্সটটি তুলে দিচ্ছি-
![]() |
সাকার আল্লাহ সম্পর্কে মতামত |
![]() |
সাকার আল্লাহ সম্পর্কে মতামত |
"কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও হাদীস থেকে জানা যায়, আল্লাহর হাত আছে, পা আছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাহ হলো, আল্লাহর সিফাতকে তাঁর কোন মাখ্লুকের সাথে সাদৃশ্য না করে তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। অতএব আল্লাহ তা‘আলাকে নিরাকার বলা বা বিশ্বাস করা ঠিক নয়। যেমন উক্ত হাদীসে আল্লাহর আঙ্গুলের কথা এসেছে এবং পরের অধ্যায়ের আয়াতে তাঁর ডান হাত ও মুঠের কথাও বলা হয়েছে। সর্বপরি আল্লাহ নিরাকার কথাটি কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। বরং হিন্দু সংস্কৃতি থেকে আমদানীকৃত বটে।
কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসে আল্লাহ তা‘আলার চেহারা, হাত, পা, চক্ষু, যাত বা সত্ত্বা, সূরাত বা আকারের কথা উল্লেখ হয়েছে যার অর্থ স্পষ্ট। এর মাধ্যমে আল্লাহর নির্দিষ্ট আকার-আকৃতি আছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। কারণ যিনি নিরাকার তার এ সব কিছু থাকার কথা নয়। তবে হ্যাঁ, আকার আকৃতি কেমন তা তিনি ছাড়া কেউ জানেন না। মুমিনগণ কিয়ামতের দিন তাঁকে দেখতে পাবে।"
অর্থাৎ ইসলামিক স্কলারগণ ৩ টি কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন-
- ১। আল্লাহ সাকার, তার হাত, পা,চোখ ইত্যাদি আছে।
- ২। কেয়ামতের দিন তাকে মানুষ দেখতে পাবে, অপরদিকে পৌরাণিক হিন্দুদের মতে আগেরকালের মহামুনি-ঋষিদের দেবতারা দেখা দিয়েছেন, অর্থাৎ এই দুই মতের পার্থক্য কেবল এটাই যে একদল এখনও দেখতে পায়নি কিন্তু ভবিষ্যতে দেখতে পাবে, আরেকদলের মধ্যে অতি উচ্চলেভেলের মহাপুরুষরা অলরেডি দেখতে পেয়েছে। এখন যে দল দেখতে পেয়েছে সে দল ছবি তো আঁকবেই!
- ৩। আল্লাহ নিরাকার এই কথা মূলত বৈদিক সংস্কৃতি থেকে মুসলিম ভাইবোনরা অবচেতন মনে কপি করেছেন, কেননা জগতের একমাত্র প্রকৃত নিরাকার স্রষ্টা হলো বৈদিক ঈশ্বর, একমাত্র পবিত্র বেদ ও বৈদিক শাস্ত্র ছাড়া জগতের এমন কোন ধর্মগ্রন্থই নেই যেখানে বলা হয়েছে ঈশ্বর নিরাকার।
আব্রাহামিক সকল রিলিজিয়ন খ্রিশ্চিয়ানিটি, ইসলাম, জুডাইজম সবটিতেই গড সাকার।
তাহলে পুরো আলোচনা থেকে আমরা যে সিদ্ধান্তে আসলাম-
- ১) পৌরাণিক দেবতা ও ইসলামিক আল্লাহ উভয়েই সাকার, উভয়েরই হাত, পা, চোখ ইত্যাদি আছে।
- ২) পৌরাণিক সনাতনী ভাইবোনদের বিশ্বাস তাদের দেবতাকে তাদের মহাঋষিরা ইতিমধ্যেই দেখেছেন এবং সেই বর্ণনা তারা লিখে গেছেন সেই বর্ণনা অনুসারে তারা ছবি বা মূর্তি বানান। অপরদিকে মুসলিম ভাইবোনদের বিশ্বাস তারা আল্লাহকে ভবিষ্যতে দেখতে পাবেন কেয়ামতের দিনে। অর্থাৎ দু'পক্ষের মধ্যে পার্থক্য শুধু কখন দেখেছে তা নিয়ে, দেখা যে যায় এটা নিয়ে কোন মতভেদ নেই। তাই আসলে মুসলিম ভাইবোনরা এই বিষয়ে পৌরাণিক ভাইবোনদের নিয়ে হাসাহাসি করা বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা এই ধরনের পোস্ট দিয়ে এটা আসলেই হাস্যরসাত্মক ও বিব্রতকর কেননা আপনাদের দুইপক্ষেরই বিশ্বাস ও ধর্মগ্রন্থ এই বিষয়ে একই কথা বলছে। বরং পৌরাণিক ভাইবোনরাই এগিয়ে তারা ইতিমধ্যে দেখতে পেয়েছেন, আপনারা এখনও অপেক্ষা করে আছেন দেখার জন্য।
- ৩) জগতের একমাত্র ধর্মগ্রন্থ যা বলেছে ঈশ্বর নিরাকার তা হলো পবিত্র বেদ ও বৈদিক শাস্ত্র। পৃথিবীর আর কোন রিলিজিয়নই এই দাবী করতে পারবেনা তাদের গড নিরাকার। এজন্যই বৈদিক ধর্ম অনন্য।
আশা করি এই গঠনমূলক একাডেমিক আলোচনা থেকে সব রিলিজিয়নের ভাইবোনেরা উপকৃত হবেন। আসুন আমরা সবাই নিজের রিলিজিয়নকে জানি, নাহলে আমরা বারবার অজ্ঞতাবশত এ ধরনের ভুল পোস্ট সব পেজে পেজে করে নিজেদেরকেই ছোট করব। কেউ মনে কষ্ট পেলে আমরা দুঃখিত, আমাদের উদ্দেশ্য জ্ঞানের প্রচার, কষ্ট দেয়া নয়।
বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক
সূত্র: ফেসবুক
0 Comments