মনোরঞ্জনের শহিদি মর্যাদা - ভুঁইয়া শফিকুল ইসলাম

গল্প - মনোরঞ্জনের শহিদি মর্যাদা - ভুঁইয়া শফিকুল ইসলাম
গল্প - মনোরঞ্জনের শহিদি মর্যাদা - ভুঁইয়া শফিকুল ইসলাম

 

ডাক্তার মনোরঞ্জনকে ওরা যখন ব্রিজের উপর থেকে কুমার নদে ফেলে দেয় তখন ওদের মধ্যে দুর্দান্ত একটা হাসির রোল উঠেছিল। ব্রিজ থেকে বিশ ফিট নিচে জলের মধ্যে ঝুপ করে দেহটি পড়ার সাথে আবেদ খাঁ সজোরে বলেছিল, ডাক্তার, দেখবানি তোর বরুণ দেবের ক্ষমতা, যদি তোরে বাঁচায় দেয়, নদে যদি ভাসায় দিত্ পারে, তোরে আর মারব নানে।


টুলু রাজাকারের ছেলে রুস্তুম রাজাকার ব্রীজের উপর কুর্দন করে বিকৃত কণ্ঠে আবৃত্তি করে, ‘নিবভয়ে প্রাণ যে কববে দাণ, কয় নাই তার কয় নাই’। তারপর চিৎকার করে বলল, মালু, পানিতলে ডুবয় থাক, তোর ক্ষয় হবে নানে।


দুই রাজাকারের দুই মন্তব্যেরই পটভূমি আছে। অন্য যারা যে মন্তব্য করেছিল, তা ছিল খিস্তি-খেয়ুর, উল্লাস, ঘৃণা ও বিদ্বেষভরা বুলি। মৃত মুশরিকদের নির্ঘাত দোজখ সম্পর্কে ধর্মীয় ধারণা থেকে তা সঞ্জাত।   


   মনোরঞ্জনই ছিলেন তখন শৈলকুপার একমাত্র পাশি ডাক্তার। মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ডাক্তারদের তখন ‘পাশি ডাক্তার’ বলত লোকেরা। পিতা ব্রজমোহন জোয়াদ্দার একমাত্র ছেলেকে কোলকাতা থেকে এমডি পাশ করিয়ে এনেছিলেন। ভালো রিজাল্ট করাতে ওই মেডিক্যাল কলেজই তাঁকে চাকরির অফার দিয়েছিল, কিন্তু নিজ আত্মার স্রোতের মতো ঝিনাইদহের কুমার নদ, বর্ষার থৈ থৈ বিল, ছায়াঘেরা বাড়ির মনোহর ফল-বাগান, পুকুর, শৈলমাছ লাউ, কুষ্টিয়ায় লালন-আঁখড়া, মাঝির ভাটিয়ালি, রাখালের মেঠো সুর, এপার তাঁকে অলখ সুতায় টানে। কোলকাতা তাঁকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। সর্বোপরি নিজ এলাকার জনগণকে চিকিৎসা-সেবা একটা ব্যাকুল নেশার মতোই কাজ করত মনোরঞ্জনের মনে।


 কলেজজীবন থেকেই তিনি সাহিত্যের আড্ডা বসাতেন। ডাক্তার হয়ে দেশে ফেরার পর সেটি আরো জোরেসোরে শুরু হয়। আবৃত্তি গান আলোচনার ভিতর দিয়ে তরুণ মনে সাহিত্য বোধ, স্বদেশপ্রেম ও উন্নত রসের প্লাবন বহাতে চাইতেন তিনি সাহিত্য আড্ডার মাধ্যমে। তাতে বৃদ্ধরাও পেতেন মুক্তির স্বাদ। ররীন্দ্র লাননেন গান হতো বেশি। নিরঞ্জন গানের পটভূমি বলতেন।


   কিন্তু তরুণরা মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে আত্মবলীদানের গান গাইত। ‘নির্ভয়ে প্রাণ যে করিবে দান/ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’—আবৃত্তি করত। উদয়ের পথের এই অভয়-বাণী এলাকার তরুণেরা ডাক্তার মনোরঞ্জনের সাহিত্যসভা থেকে শিখেছিল। 


   এ মাটিতে কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারে, মনোরঞ্জন ঘুনাক্ষরেও তা বুঝতে পারেননি। ওখানে এমন কোনো ঘর নেই, তিনি রোগীর সেবা দেননি। দরিদ্র রোগীর ডাকেও ছুটে যেতেন। তাঁর ছিল ঊর্বর জমি, মাছ-ভরা পুকুর, পানবরজ, ফলবাগান, পর্যাপ্ত সহায় সম্পদ; সাথে রবীন্দ্র-লালেনের রসে জারিত হৃদয়। অর্থলোভ তাঁকে কখনো পেয়ে বসেনি।


   রাজাকার এল। ওদের কণ্ঠ ছিল শান্ত। মনে করলেন হয়ত কারো ওষুধ দরকার। স্থানীয় টুলু রাজাকারের ছেলে রুস্তুম রাজাকার বলল, ডাক্তার কাকা, ‘মারে এট্টু দেখতি যাতি হবে; দ্রুত, অবস্থা ভালো না।’


   মরোরঞ্জন বুঝলেন, রোগটা ওদের নয়, ওদের একজনের মায়ের। মনোরঞ্জন অসুস্থ রোগীর ক্ষেত্রে ‘রাজাকার’ দেখতেন না। মানুষের আদর্শ বিশ্বাস যা-ই হোক, তিনি যখন রোগী, তখন বড়ো অসহায়। ব্যধির যন্ত্রণা সর্বদেহে সমান। এক শ পাঁচ ডিগ্রি জ্বরে সংঙ্গাহারা, পেঠব্যথায় মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া-- এমন সব রোগীদের সেবায় ছুটে যেতেন মনোরঞ্জনের। দেহ ব্যথাদীর্ণ মানবসন্তানের। সেখানে রাজাকা-মুক্তিযোদ্ধার বিভেদ-বিচার নাই—উভয়েই বেদনার সন্তান।


   কিন্তু কিছু দূর যেতেই যখন রাজাকাররা ডাক্তারকে বেঁধে ফেলে, তিনি ভীত হন। তারা তাঁকে কুমার নদের ব্রীজের দিকে নিয়ে যায়। তিনি টুলুর ছেলে রুস্তুমকে বলেন, বাবা, আমাকে জোর করে এখানে আনছ কেন? কী ক্ষতি করেছি তোমাদের ?


   করিম রাজাকার বলে, ‘ডাক্তার সাব, কাউয়াগিরি চোদান, এহন বালা মানুষ সাজছেন? কাউয়ায় পাকা লঙ্কা কাইয়া বাকিটুক চালের মদ্যি গুজি রাকে। বাবে আর কেউ জানতি পারবে না। আপনি যে গোপনে মুক্তিযুদ্দা ক্যাম্পে যান, সে-খবর কি আমাদের কাছে নাই নিকি ?’


   ডাক্তার মনোরঞ্জনের দেহ কেঁপে ওঠে। খুব গোপনে তিনি যান, রাতের অন্ধকারে, ওদের চিকিৎসা দিতে। বর্ডারে নোম্যানস ল্যান্ডে বাঙ্কারে গিয়ে চিকিৎসা দিয়ে আসেন, আহতদের। এরা জানল কী করে ?

   মনোরঞ্জন বলেন, বাবা, আমি ডাক্তার মানুষ, ডাকলে যেতে হয়, এ আমার ধর্ম, তোমার ডাকে যেমন আসি। যিনি ডাকেন তাঁর ডাকে সাড়া না দিলে আমার যে অধর্ম হয় বাবা !


  তাই বলে তুই তাদের ডাকে যাবি, যারা সোনার দেশ, আল্লার দান, পাকিস্তানকে ভাগ করতে চায়? আমরা যাদের হত্যা করতি যুদ্ধ করছি, সেই মুক্তির বাচ্চাদের বাঁচাতে চাস?


   এবার আবেদ খাঁর প্রতিক্রিয়া। ডাক্তারের পেছনে গদাম করে একটা লাথি দিয়ে, শালারপুত ‘মুক্তিরে অষুদ না দিলি তোমার বরুণ দেব কষ্ট পায়, তাই না ? না কি মা দুগ্গা ? চুঁদিরপুত মালাউন, পাকিস্তান ভেঙে দিতে চাস! তোর আবার ধম্ম !’


   আবেদ খাঁ ডাক্তার মনোরঞ্জনের প্রতিবেশি। লেখাপড়া জানে না, তবে মাঝে মাঝে ডাক্তারের সাহিত্য আড্ডায় পেছনে এসে দাঁড়াত। একদিন সাহিত্য-আড্ডায় ডাক্তারের মুখে বরুণ দেবতার কথা শুনেছিল। বরুণ হচ্ছেন জলের দেবতা। 


তাই কুমার নদের সেতুর উপরে নিয়ে গলায় সিমেন্টের বস্তা বেঁধে যখন ওরা ডাক্তার মনোরঞ্জকে নদীতে ফেলে দেয়, তখন ডাক্তারকে শুনিয়ে শুনিয়েই আবিদ খাঁ, বলে ‘ডাক্তার! আপনার কিচু হইত না, রবুণদেব রক্কা করবেনে।’


   ফেলার আগের মুহূর্তগুলো ওরা ডাক্তারকে বড়ো কষ্ট দেয়। আর যে হবে হোক, আবেদ কেন তাঁকে শেষবেলা এত কষ্ট দিচ্ছে ? আবেদের বাবা হাফেজ খাঁ তাঁদের বাড়ি কাজ করতেন, বাগান পরিষ্কার, মাছ ধরা; আবেদ তাদের বাড়ির ছেলের মতো। ফলমূল ইচ্ছা মতো পেড়ে খেতো। মাছ ধরলে আবেদদের অবশ্যই দেওয়া হতো। তাঁর মা-বাবার চেয়েও মনোরঞ্জন তাকে বেশি ভালো জানত। 


   বিস্মিত মনোরঞ্জন আবিদকে বলেন, হাফেজ চাচার দুরারোগ্য বাতের চিকিৎসায় আমি কখনো একটি টাকা নেইনি৷  আর আজ তুমিই আসছ  আমাকে মেরে ফেলতে? 


   তিনি জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও অতীত হাতড়ান। কিন্তু কী করে বুঝবেন, অতীত অর্থহীন, আবিদের কাছে বর্তমানই অর্থপূর্ণ। পিতার একমাত্র ছেলে মনোরঞ্জনকে মারতে পারলে তাঁদের জমি-জিরত আবেদের হয়ে যাবে, এর নাম মালে গণিমত। 


   কুমান নদে বরুণ দেব থাকে না। সকল ধর্মের উর্ধ্বে-ওঠা মনোরঞ্জন নদীতে নিক্ষেপিত হওয়ার আগে একবারও বরুণদেবকে ডাকেনওনি। এইসব দেব-দেবতা সাহিত্যের জন্য, উপমার জন্য, অসহায়দের ভুলিয়ে রাখার জন্য; কিন্তু জীবনের জন্য নয়, সে-বোধ মানবমুখী মনোলঞ্জনের ছিল।


   এটা ছিল আগষ্টের ঘটনা, সালটা ১৯৭১। 


   মাত্র তিন মাস পর। এমন এক দারুণ দিনে কুমার নদের পাশে আল্লাকেও দেখা গেল না। মুক্তিযোদ্ধারা যখন ওই আবেদ খাঁ সহ তেরজন রাজাকারকে নদের পাশে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে, তখন তারা সবে ‘আল্লা আল্লা’ ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছিল। 


  যে-বাড়ির লোভে মনোরঞ্জনকে মারণ, আবিদ খাঁর সে স্বপ্নের বাড়ি সেখাইনেই পড়ে থাকল।  


   ডাক্তার মনোরঞ্জনের একটি মাত্র কন্যা জীবিত আছেন। তিনি ভারতে থাকেন। পিতার স্মৃতিতর্পনে শৈলকুপা এসে সেবার যখন রোদন করলেন, আমার বাবা দেশের জন্য জীবন দিয়েও শহিদের মর্যদা পেল না; তখন অভিজ্ঞজনেররা আফসোস করে বলেন, কাজটা যাদের করার কথা ছিল তারা তা করে নাই। যারা অমুক্তিযোদ্ধাকেও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে, তারা মনোরঞ্জনকে তালিকায় আনবে কেন? 


   আর বিবেক জান্নাতে বন্ধ-রাখা, অন্ধ মুমিনেরা গোপনে বলেছিল, মালাউনের ঝি, কান্দস ক্যা ? ‘শহিদ’ কি মালাউনের জন্য নাকি ? ‘শহিদের মর্যদা’ কতাডার মানে বুজিস ? ওডা শুধু মুসলমানদের জন্য।  মুশরিক জাহান্নমের কাঠ; তাদের আবার শহিদের মর্যাদা?


তবে কেউ কেউ বলেন, এটা আসলেই বড়ো বেদনার। দেশান্তপ্রাণ, মানবকল্যাণকামী  শহিদ-সন্তানকেও যখন অবজ্ঞা করা হয় শুধু ধর্মীয় কারণে।  মৃত্যুর পরে কী সত্য,  কোনো রিওয়ার্ড থাকলে সৎ ও ত্যাগীজন কেন তা পাবেন না, সে ব্যাপারে কেউ শেষ কথা বলতে না পারলেও।


সূত্র: ফেসবুক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ