নাথধর্মের কয়েকজন গুরু প্রসঙ্গে - রানা চক্রবর্তী

ইতিহাস থেকে নাথধর্মের ন’জন গুরুর কথা জানা যায়, বৌদ্ধ তান্ত্রিকেরাও সেই নাথগুরুদের পূজা করতেন। চর্যাপদে নাথগুরু ও নাথধর্মের কথা পাওয়া যায়। সেই ন’জন নাথ গুরু হলেন — পূর্বে গোরক্ষনাথ, উত্তরাপথে জলন্ধর, দক্ষিণে নাগার্জুন, পশ্চিমে দত্তাত্রেয়, দক্ষিণ-পশ্চিমে দেবদত্ত, উত্তর-পশ্চিমে জড়ভরত, কুরুক্ষেত্র ও মধ্যদেশে আদিনাথ এবং দক্ষিণ-পূর্বের সমুদ্রোপকূলে মৎস্যেন্দ্রনাথ (মীননাথ)। প্রাচীন একটি মারাঠি কাহিনীতে পাওয়া যায় যে, আদিনাথ শিবের কাছে শিবঘরণী পার্বতী, মীননাথ ও জলন্ধরিপাদ মহাজ্ঞান লাভ করেছিলেন। 


বঙ্গদেশে মীননাথের দু’জন শিষ্য ছিলেন — গোরক্ষনাথ ও চৌরঙ্গিনাথ। জলন্ধরের দুই শিষ্য ছিলেন — কানুপা ও ময়নামতী, এবং গোরক্ষনাথের দুই শিষ্য ছিলেন — গৈনীনাথ ও চর্পটিনাথ। মীননাথ, গোরক্ষনাথ, জলন্ধরিপাদ, রানী ময়নামতী ও তাঁর পুত্র গোপীচন্দ্র (গোবিন্দচন্দ্র)-কে নিয়ে অতীতে অনেক কাব্য, কাহিনী, ছড়া ইত্যাদি লেখা হয়েছিল। গোরক্ষনাথের কাহিনী ও ময়নামতী-গোপীচন্দ্রের কাহিনীর মধ্যে দিয়ে বঙ্গদেশের নাথ সাহিত্য সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। বর্তমানে ভারতের সর্বত্র নাথ সাহিত্য প্রধানতঃ এই দুই ভাগে বিভক্ত। এছাড়া নাথধর্ম, দর্শন ও তত্ত্ব সম্পর্কে প্রাচীন কিছু গান, ছড়া, পাঁচালি ইত্যাদি পাওয়া যায়। 


ঐতিহাসিকদের মতে গোরক্ষনাথ খুব সম্ভবতঃ একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন, খৃষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল। অতীতে গোরক্ষনাথকে ঘিরে ভারতের নানা প্রদেশে নানাধরণের গল্প ও জনশ্রুতির সৃষ্টি হয়েছিল। কথিত রয়েছে যে, গোরক্ষনাথ তাঁর পথভ্রষ্ট গুরুকে উদ্ধার করে পুনরায় সাধনমার্গে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গদেশে ময়নামতী ও তাঁর পুত্র গোপীচন্দ্রের কাহিনীতেও সাধনমার্গে ফিরে আসবার কথা পাওয়া যায়। আলোচ্য সময়ের ভারতের অল্পশিক্ষিত সাধারণ মানুষেরা এসব কাহিনী নিয়ে গল্প, কবিতা কাব্য রচনা করেছিলেন। আগে এসব নিয়ে গান করা হত। মুসলমান শেখ ফয়জুল্লাহ সেই গানকে কাহিনীর মধ্যে লিপিবদ্ধ করে অথবা সেটির একটি সংকলন তৈরি করে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।


নাথপন্থীরা মূলতঃ নিরীশ্বরবাদী ছিলেন, তাঁরা মনে করতেন যে — নিজের সাধনার দ্বারাই নিজের আত্মাকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। দেবদেবীদের প্রতি তাঁদের বিশেষ কোন শ্রদ্ধা ছিল না, সেই কারণে সুলতানি যুগের মুসলমান সাধকেরাও তাঁদের দলে যোগ দিতে কোনো ধরণের মানসিক বাধার সম্মুখীন হননি। অতীতে ময়নামতী ও গোপীচন্দ্রের কাহিনী বাংলা থেকে রাজপুতনা, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, বিহার ও পাঞ্জাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। ময়নামতী — ত্রিপুরার মেহারকুলের রাজার স্ত্রী ছিলেন, এবং তাঁদের পুত্রের নাম ছিল গোপীচন্দ্র। গোপীচন্দ্র কিভাবে নাথ সাধনমার্গে ফিরে এসেছিলেন — সেটাই হল এই কাহিনীর মূল বিষয়বস্তু। গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস গ্রহণ হল গোপীচন্দ্রের পাঁচালির মূল কথা। সুলতানি যুগের ভারতের যেসব মুসলমান কবিরা গোবিন্দচন্দ্রের গীত গেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে সুকুর মাহমুদ নামের একজন মুসলমান কবির নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ