জাকির তালুকদার একজন লেখক। তিনি দশ বছর বাংলা একাডেমি পুরস্কার উপভোগ করে এখন ফিরিয়ে দিয়েছেন। সেটা নিয়ে বেশ কথাবার্তা চলছে। আমিও কিছু কথাবার্তা বলেছি। এর কারণ হলো জাকির তালুকদারকে আমি পছন্দ করি না। পছন্দ না করার কারণ হলো–
১.
২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোগে যখন শাহবাগে আন্দোলন গড়ে ওঠে তখন জঙ্গী মৌলবাদীরা নাস্তিক ও যুক্তিবাদীদেরকে হত্যা করছিল। জাকির তালুকদার জঙ্গী মৌলবাদীদের সমর্থন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নাস্তিকরা ধর্ম অবমাননার মাধ্যমে ধর্মপ্রাণদের অনুভূতিকে আহত করছে। ফলে তারা পাল্টা ব্যবস্থা নিতেই পারে। অর্থাৎ জাকির তালুকদারের মতে– ভিন্ন মতালবম্বীদেরকে হত্যা জায়েজ। এভাবে অভিজিৎ রায়কে হত্যা করার পরে জাকির জঙ্গী মৌলবাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।
২.
জঙ্গীরা নাস্তিক যুক্তিবাদী বিজ্ঞান মনস্ক ব্লগারদেরদের টার্গেট করে হত্যা লিস্ট বানিয়েছিল। সে অনুযায়ী সারা দেশে তারা হত্যা খুন জখম করে যাচ্ছিল। সরকার এই টার্গেটেড নাগরিকদের রক্ষার দ্বায়িত্ব পালন করেনি। তখন প্রাণে বাঁচতে অনেক নাস্তিক ব্লগাররা দেশ ছেড়ে পালায়। তাদেরকে হত্যা করতে পারেনি জঙ্গীরা।
এই আক্রান্ত, নিরস্ত্র দেশত্যাগী ব্লগারদের উদ্দেশ্য করে জাকির তালুকদার বলেছিলেন
‘বিদেশে গিয়ে পাকা পায়খানায় পায়খানা করার জন্য ব্লগাররা ইসলামের বিরুদ্ধে লেখে।’
৩.
সারা দেশে যখন সংখ্যা লঘু নির্যাতন চলছিল তখন জাকির তালুকদার এই নির্যাতিত ক্ষতিগ্রস্থ আতঙ্কগ্রস্ত সংখ্যালঘু হিন্দুদের পক্ষে দাঁড়াননি। তখন তিনি বলেছিলেন, হিন্দু জমিদারগোষ্ঠী বাঙালি মুসলমানদের নিপীড়ণ শোষণ করেছে। রেনেসাঁস আন্দোলনে হিন্দুরা মুসলমানদের ঢুকতে দেয়নি। হিন্দুমেলার মাধ্যমে হিন্দুরা মুসলমান বিদ্বেষ জারি রেখেছে। দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রশ্নে ইতিহাসের এই সত্যগুলো সামনে আনতে হবে। অর্থাৎ সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর নির্যাতন জায়েজ। তা থামানোর দরকার নেই।
৪.
মৌলবাদীরা মেয়েদের টিপ পরাকে পছন্দ করে না। জাকির তালুকদারও তাদের সুরে গলা মিলিয়ে বলেছিলেন, বোরকাপরা মেয়েদেরকে দেখে বোঝা যায়– তারা ভালো। কিন্তু যেসব মেয়েরা কপালে টিপ পরে তারা দেহব্যবসায়ী।
৫.
মৌলবাদীদের মতোই জাকির তালুকদার নারী শিক্ষার বিরোধী। তিনি লিখেছেন– শত শত মেয়ে ঢাকা শহরে আসে নিজের জন্য একটা জায়গা করে নিতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের মূলধন হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট। এরা বিএসিএস পরীক্ষায় সঙ্গত কারণেই প্রিলিমিনারিতেই আউট হয়ে যায়। কারণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সারটিফিকেটের জন্য তো পড়াশুনা করতে হয় না। এখন তাহলে সে কী করবে? কেউ কেউ তখন একজন শিকার ধরে। শিকার হিসেবে মধ্যবয়সী পুরুষই তাদের পছন্দ। এইসব মেয়েরা তখন রক্ষিতাগিরি করে।
জাকির তালুকদার বলছেন, তারপর এই মেয়েরা কোনোভাবে একটা চলার মতো চাকরি যোগাড় করে নেয়। এবং বহুজনের কাছে দেহ বিক্রি করে।
এই ধরনের কথাবার্তাগুলো বলে থাকেন মৌলবাদীরা, তালেবানী জঙ্গীরা। বলে তারা নারীদের ঘরে আটকে রাখার ফতোয়া দেন। নারীদের জন্য শিক্ষা নিষিদ্ধ করেন। জাকির তালুকদারও নিষিদ্ধ করার কথা না বললেও ইশারাতেই জঙ্গীদের কথাটাই প্রচার করছেন।
জাকির তালুকদার নিজেকে মার্কবাদী, বামপন্থী বিপ্লবী বলে দাবী করেন। নিজেকে মস্কোপন্থী সিপিবি ওরফে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টর লোক হিসেবে পরিচিতি দেন– উদীচীর প্রশিক্ষক হিসেবে দেশের নানা জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে দিয়ে বেড়ান। প্রকৃতপক্ষে জাকির তালুকদার একজন অমানবিক, মৌলবাদী, জঙ্গীবাদী, নারী বিদ্বেষী, প্রতিক্রিয়াশীল, ঘোর সাম্প্রদায়িক, পুরুষবাদী, উন্মাদ মাত্র।
লেখক হিসেবেও তিনি তৃতীয় শ্রেণীর। সৈয়দ শামসুল হককে ধরে বাংলা একাডেমি পুরস্কার যোগাড় করেছিলেন।
২০২২ সালে কুলদা রায় বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার সম্পর্কে যা লিখেছিলেন, তা নিচে উদ্ধৃত করা হল:-
বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক জাকির তালুকদার মনে করেন, হিন্দু জমিদারগোষ্ঠী বাঙালি মুসলমানদের নিপীড়ণ শোষণ করেছে। রেনেসাঁস আন্দোলনে হিন্দুরা মুসলমানদের ঢুকতে দেয়নি। হিন্দুমেলার মাধ্যমে হিন্দুরা মুসলমান বিদ্বেষ জারি রেখেছে। দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রশ্নে ইতিহাসের এই সত্যগুলো সামনে আনতে হবে। অর্থাৎ সংখ্যালঘু নির্যাতনের দায় ভিকটিম হিন্দুরাই দায়ী বলে ঘোষণা করেন জাকির তালুকদার।
এই কথাটি জাকির তালুকদার বলছেন কোন সময়ে? বলছেন দেশে যখন ক্রমবর্ধমানভাবে সংখ্যালঘু তথা হিন্দুনিপীড়ন চলছে-- এই সময়ে। সময়টাকে মনে রাখুন।
জমিদার হলো ট্যাক্স কালেকটর। মুঘলরা ভারত রাষ্ট্রটি দখল করার পর এই হিন্দুদেরকেই ট্যাক্স কালেকটর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। বার্ষিক একটা ট্যাক্স নির্ধারণ করে দিতেন মোগল সম্রাট। প্রজাদের কাছ থেকে সেটা আদায় করতেন জমিদাররা।
বৃটিশরা এদেশ দখল করে মোগলদের নিয়োগকৃত জমিদারদেরই ট্যাক্স আদায়ের দায়িত্বে রেখেছিল।
সে সময়ে দেশে হিন্দু মুসলমানদের সংখ্যা কমবেশি আধাআধি ছিল। ধরা যাক কোনো জমিদারি এলাকায় ১০০০০টি পরিবার ছিল। তার মধ্যে ৫০০০ ছিল হিন্দু। তাদের মধ্যে মাত্র ৫% ছিল ব্রাহ্মণ। এদের মধ্যে ছিল ০.৫% ছিল ধনী ব্রাহ্মণ অর্থাৎ একটা জমিদারি এলাকায় ১০০ জনের বেশি ধনী ব্রাহ্মণ থাকার কথা নয়। তাদের মধ্য থেকে ১ জন হতো জমিদার। এই একজন হিন্দু জমিদার ট্যাক্স আদায়ের জন্য প্রজাদেরকে শোষণ, নির্যাতন ও নিপীড়ন করেছেন।
প্রথম কথা হলো ১ জন হিন্দু জমিদারের নিপীড়নের দায় বাকী ৪৯৯৯ জন হিন্দুর উপর চাপানো যায় না।
দ্বিতীয় কথাটি হলো, ঐ হিন্দু জমিদার হিন্দু মুসলমান সবার কাছ থাকেই ট্যাক্স আদায় করতেন। হিন্দু মুসলমান প্রজা উভয়েই তার নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হতো। তাহলে একজন হিন্দু জমিদারের নিপীড়নের দায় সব হিন্দুদের উপর চাপানো কি ঠিক কাজ হবে?
তৃতীয় কথা হলো, সেকালে শুধু হিন্দু নয়–অনেক মুসলমান জমিদারও ছিল। তারা কি ট্যাক্স কালেকশনের জন্য মুসলমান প্রজাদের নিপীড়ন করত না?
চতুর্থত, হিন্দুমেলা কোলকাতার উপকণ্ঠে শুধুই হয়েছে ছয় সাতবার। সেখানে মুসলমানরাও অংশ নিয়েছেন।
অন্যত্র হয়নি। এই মেলার ইমপ্যাক্ট সারা বাংলায় কোনো প্রভাবই সৃষ্টি করেনি। হিন্দু মেলায় কোনো মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানো হয়নি। দেশি হস্ত শিল্প, মৃৎ শিল্প, কৃষি বিষয়ক পণ্যের সম্প্রসারণের জন্য মেলায় সেগুলো হাজির করা হতো।
চতুর্থ কথা হলো সাত চল্লিশের দেশভাগের পর অধিকাংশ হিন্দু জমিদার পশ্চিম বঙ্গে চলে যায়। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে কোনো হিন্দু জমিদার আর প্রজানিপীড়নের সুযোগ পায়নি। কিন্তু দেশে বছরের পর পর হিন্দুদের উপর এক তরফা দাঙ্গা চাপানো হয়েছে। তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের সহায় সম্পদ লুটপাট করা হয়েছে। একাত্তরে পাকিস্তানীদের প্রথম টার্গেটই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়। লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে তারা মেরেছে। এক কোটি হিন্দুদেরকে গুলির মুখে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। হিন্দুদের উপর এই হত্যা, নিপীড়ন, লুটপাট, দেশত্যাগে বাধ্যকরা এখনো চলছে আরো ভয়ংকরভাবে। ১০০ বা ২০০ বছর আগের হিন্দু জমিদারদের নিপীড়ণের কথা এখন সামনে টেনে আনার অর্থ কী?
এরা সবাই জমিদার ছিলনা। মুসলমান নিপীড়নকারীও ছিল না। ইতিহাস তো তাই বলে জাকির তালুকদার--নয় কি? তাহলে দেশে ক্রমবর্ধমান হিন্দু নির্যাতনের ঘটনাকালে নির্যাতিত হিন্দুদের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে কেনো নির্যাতকদের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন? কেনো তিনি হিন্দু তথা সংখ্যালঘু নির্যাতনকে ন্যায়সঙ্গত মনে করছেন?
--২০২২
সূত্র: ফেসবুক পোস্ট এক এবং ফেসবুক পোস্ট দুই এর কমেন্ট
০০ জাকির তালুকদারের নারী বিদ্বেষ নিয়ে ওমেন চ্যাপ্টার ওয়েবসাইটে ২০১৮ সালের ২৩শে মে তারিখে বৈশালী রহমান লিখিত একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। আগ্রহী পাঠকগণ পড়তে ক্লিক করুন "জাকির তালুকদারকে বলছি, নারীদের অবমাননা করে আর কতদিন?
0 মন্তব্যসমূহ