অনেকদিন ধরেই বামপন্থার ছদ্মবেশে সনাতন ধর্ম বিদ্বেষীরা একটি খুব ই কৌতুককর যুক্তি শ্রীরামচন্দ্রের বিপক্ষে ব্যবহার করে আসছেন। সেটা হলো শ্রীরাম হলেন ফর্সা, গৌরবর্ণের আর্য জনগোষ্ঠীর লোক। আর রাবণ হলো স্থানীয় কালো অনার্য। রামায়ণে নাকি আর্যরা অনার্যদের উপর আক্রমণ করেছে এই কাহিনীই বর্ণিত হয়েছে। এই নিয়ে তারা সবসময় মায়াকান্না করেন যে আর্যরা এভাবে অনার্যদের উপর হামলা করল! রাবণ যে নিজ পুত্রবধু রম্ভাকে ধর্ষণ করেছিলেন, অন্যের স্ত্রী মাতা সীতার বলপূর্বক অপহরণ করেছিলেন, তাঁকে কুপ্রস্তাব দিয়েছিলেন, নিজ রাজ্যে ত্রাসের শাসন কায়েম করেছিলেন (রাবণের স্ত্রী নিজমুখেই বলেছেন রাবণ মদ্যপ,অত্যাচারী রাজা ছিলেন) সেগুলো যে দোষ এই কথা কিন্তু তাদের মুখে শুনবেন না।
এখন অনেক বিধর্মীরাও বামপন্থীদের এই হাস্যকর তত্ত্বের সাহায্য নিয়ে সনাতন ধর্ম অবমাননা করা শুরু করেছে। সিদ্দিক আহমেদ নামক এক লোক দশগ্রীব নামে একটি বই লিখেছেন সম্প্রতি। সেখানে তিনি একই মায়াকান্না দেখিয়েছেন যে কালো আদিবাসী অনার্য রাবণের উপর ফর্সা, গৌড়বর্ণ আর্য রাম আক্রমণ করেছেন। কিন্তু কথা হলো সিদ্দিক সাহেব নিজেই তো নিজের পূর্বপুরুষ সেই তথাকথিত আদিবাসী অনার্যদের সংস্কৃতি ত্যাগ করে বহিরাগত আরবের সংস্কৃতি গ্রহণ করেছেন, অনার্য আদিবাসীদের ভাষা ত্যাগ করে নিজের নামও বহিরাগত আরবী ভাষায় রেখেছেন সিদ্দিক আহমেদ। তাহলে আদিবাসী অনার্যদের সংস্কৃতি নিয়ে মায়াকান্না কি তার মানায়?
এখন আসি তাদের দাবী প্রসঙ্গে।
আর্যরা বহিরাগত একটি জাতি, অনার্য মানে দেশীয় কালো মানুষের জাতি; এ ধরনের কোন জাতিভেদ বেদশাস্ত্রে নেই। বেদশাস্ত্রে পৃথিবীর সকল মানুষকে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে- ভালো মানুষ বা আর্য (মহৎ,Noble), খারাপ মানুষ বা অনার্য।
যে কোন ব্যক্তি সে যদি ভালো চরিত্রের অধিকারী, সৎ, সত্যবাদী, সমাজ সেবক প্রভৃতি হয় সে আর্য। আর যে খারাপ কর্ম করে বেড়ায় সে অনার্য। অনার্য ব্যক্তিকে মোটাদাগে তার খারাপ চরিত্রের বৈশিষ্ট্য অনুসারে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন দস্যু, পিশাচ, রাক্ষস ইত্যাদি। যেমন যারা সাধারণ মানুষের উপর হামলা করত, ডাকাতি ইত্যাদি করত তারা দস্যু। যারা মদ পান, অত্যাচার, নারীলিপ্সা ইত্যাদি করত তারা রাক্ষস। যারা সবধরনের ভক্ষ্য অভক্ষ্য সব খাবার গ্রহণ করত, নারীদের অপহরণ করত ইত্যাদি তারা পিশাচ এরকম।
এখন আপাতত তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম যে আর্যরা হলো বাইরে থেকে আসা ফর্সা, গৌড়বর্ণের জাতি, এরা বেদ ইত্যাদি লিখেছে, অনার্যরা এই দেশের আদিবাসী কালো লোক। এই বেদ তথা আর্যদের ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৭ টি ঋষিকে ( মানে অপপ্রচারকারীদের ভাষায় এরাই বেদের লেখক, আর্যদের নেতা, আর্যধর্মের প্রবর্তক এই ধরনের) একত্রে বলা হয় সপ্তর্ষি। এই ৭ জন ঋষির একজনের নাম হলো পুলস্ত্য, পৌরাণিক কথায় পুলস্ত্য ব্রহ্মার ১০ মানসপুত্রের ১ জন। অর্থাৎ পুলস্ত্য নিঃসন্দেহে আর্য, একদম আর্যদের বড় নেতা!
তো রাবণ কে ছিল? রাবণ হলো এই ঋষি পুলস্ত্যের নাতি, পুলস্ত্যের ছেলে ঋষি বিশ্রবার পুত্র! এত বড় আর্য ঋষির নাতি কীভাবে আদিবাসী কালো অনার্য হলো? এই অদ্ভুত পাগলদের মতে ঋষিরা নাকি বহিরাগত আর্যগোত্রের নেতা অথচ সেই ঋষির পুত্র, নাতি নাকি অনার্য আদিবাসী! এজন্যেই ঘুমের ঘোরে আর নয়াদিগন্তের খবরে সিদ্দিক আহমেদরা প্রতিদিন নোবেল পুরস্কার পায়, অপরদিকে বাস্তবে সব নোবেল পান কাফের ভাই বোনেরা!
এবার আসি রাম নাকি গৌড়বর্ণের ফর্সা আর্য! অথচ রামায়ণে স্পষ্ট বলা আছে রাম ছিলেন কালো! রামায়ণের সুন্দর কাণ্ডের ৩৫ নং সর্গে হনুমান শ্রীরামের গুপ্তচর হিসেবে ছদ্মবেশে লংকায় এসেছেন যুদ্ধের আগে সব খবরাখবর নিয়ে যেতে, মা সীতার খোঁজ নিতে। মা সীতার সাথে দেখা হলে মা সীতা ভাবলেন এ আবার কোন রাবণের চর নয় তো? তখন হনুমান আসলেই শ্রী রামের পাঠানো দূত কিনা তা নিশ্চিত হবার জন্য বললেন তুমি যদি আসলেই রামের দূত হও তাহলে বলো তো দেখি রাম দেখতে কেমন? তখন শ্রী রাম সম্পর্কে হনুমান বললেন-
দুন্দুভি স্বন নির্ঘোষঃ স্নিগ্ধ বর্ণ প্রতাপবান্।
সমঃ সম বিভক্ত অঙ্গো বর্ণম্ শ্যামম সমাশ্রিতঃ।।
( বাল্মীকি রামায়ণ ৫.৩৫.১৬)
তাঁর কণ্ঠ দুন্দুভির ন্যায় গম্ভীর, স্নিগ্ধ বর্ণ, প্রতাপময় তিনি, তাঁর সব অঙ্গ সুনিপুণভাবে তৈরী, তাঁর গায়ের রং শ্যাম বর্ণের।
"He has a voice like the sound of a kettle-drum. He has a shining skin. He is full of splendour. He is square-built. His limbs are built symmetrically. He is endowed with a dark-brown complexion."
কোথায় গেল বাম ভাইদের কল্পিত গৌড়বর্ণের ফর্সা আর্য রাম? রামায়ণে তো দেখি শ্রী রাম ছিলেন শ্যাম বর্ণের! বাস্তব হলো সনাতন ধর্মে আর্য জাতি বলে কোন জাতি নেই। আর্য হলো গুণকর্মে শ্রেষ্ঠত্বের নাম। কালো রং এর শ্রীরাম, শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন শ্রেষ্ঠ আর্য তাঁদের গুণ ও কর্মের জন্য।
বিখ্যাত আর্য ঋষি ব্যাসদেব ছিলেন কালো এবং মহাভারতে বলা হচ্ছে ছিলেন কালো, খর্বাকার, দেখতে অত্যন্ত ভয়ানক, একদম ই সুশ্রী নন এমন (মহাভারত, আদিপর্ব, সম্ভব পর্বাধ্যায়, ১০৫ নং অধ্যায়)। অর্থাৎ বর্ণনাতেই বুঝা যাচ্ছে একদম আমাদের বামপন্থী ভাইয়েরা যাদেরকে অনার্য কালো, খাটো, কুৎসিত আদিবাসী বলতে চান ঠিক তেমন ছিলেন দেখতে ব্যাসদেব। তাহলে তিনি কীভাবে এত বড় আর্য ঋষি হলেন, এত এত শাস্ত্র রচনা করলেন আর্য ধর্মের? মহাভারত ই বলছে-
ন বৈরমুদ্দীপয়তি প্রশান্তং ন দর্পমারোহন্তি নাস্তমেতি।
ন দূর্গতোস্মীতি করোত্যকার্যং তমার্যশীলং পরমাহুরার্যাঃ।।
(মহাভারত, উদ্যোগ পর্ব-৩৩/১১২)
যে শান্ত, বৈরিতাকে উদ্দীপ্ত করেনা, গর্ব করেনা, হীনতা দেখায় না তথা 'আমি বিপত্তিতে পরেছি - এমন ভেবে অনুচিত কর্ম করেনা, সেই উত্তম আচরণকারী ব্যাক্তিকে আর্য অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ বলে।
রামায়ণে বলা হচ্ছে-
সর্বদাভিগতঃ সদ্ভিঃ সমুদ্র ইব সিন্ধুভিঃ।
আর্যসর্বসমশ্চৈব সদৈব প্রিয়দর্শন।।
(বাল্মীকি রামায়ণ ১/১/১৬)
রামচন্দ্র সদাসর্বদা সৎপুরুষদের সাহচর্যে থাকতেন যেরূপ সমুদ্র সদা নদীসমূহের সাথে মিলে থাকে তথা তিনি সমদর্শী ও সকলের প্রিয় আর্য ছিলেন।
পবিত্র বেদে বলা হচ্ছে-
• আর্যা ব্রতা বিসৃজন্তো অধি ক্ষমি।
(ঋগ্বেদ ১০/৬৫/১১)
• বি জানীহ্যার্যান্যে চ দস্যবো বর্হিষ্মতে রন্ধয়া শাসদব্রতান্।
(ঋগ্বেদ ১/৫১/৮)
অর্থাৎ সত্য, অহিংসা,ক্ষমা পবিত্রতাদি উত্তম ব্রতধারী ব্যক্তিরাই ‘আর্য’।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো বামপন্থী নামধারী এইসব বিধর্মী সনাতন ধর্মবিদ্বেষীরা রাবণ, ইন্দ্রজিৎদের অনার্য হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইলেও রামায়ণে আমরা দেখতে পাই ইন্দ্রজিৎরা কিন্তু নিজেদের অনার্য ভাবতনা, উল্টো তারা নিজেদের আর্য বলে দাবী করতো ও রামচন্দ্রকে অনার্য বলে ভৎসর্না করত। ঠিক যেমন বর্তমানে আমরা দেখি রাজনৈতিক দলের নেতারা একে অপর দলের নেতাদের দূর্নীতিবাজ বলে গালমন্দ করে তেমন।
লক্ষণ ও ইন্দ্রজিতের যুদ্ধের সময় ইন্দ্রজিৎ বলছে-
ক্ষত্রবন্ধুঃ সদানার্যং রাম পরমদুর্মতিঃ ।
ভক্তং ভ্রাতরমদ্যৈব ত্বাং দ্রক্ষ্যতি হতং ময়া ।।
বাল্মীকি রামায়ণ । যুদ্ধ কান্ড । ৮৮ সর্গ । ২৪ তম শ্লোক
ইন্দ্রজিৎ এখানে রাম সম্পর্কে বলছেন-
সর্বদাই অনার্য, দুর্মতি রাম আজই দেখবে তার ভক্ত ভাই আমার দ্বারা নিহত হয়েছে ।
অর্থাৎ ইন্দ্রজিতের দাবী রাবণ, ইন্দ্রজিৎরা আর্য এবং রাম লক্ষ্মণ অনার্য । অর্থাৎ দক্ষিণের মানুষও নিজেদের আর্য বলতো । সুতরাং আর্য কতৃক অনার্য বিজয়ের তত্ত্ব ধোপে টিকছে না । আর এটাও প্রমাণিত হয় যে আর্য শব্দটি গুণবাচক ভালো মানুষ অর্থে ও অনার্য শব্দটি গুণবাচক খারাপ অর্থে প্রযুক্ত হতো, কোন নির্দিষ্ট জাতি অর্থে নয়। তাই সবাই ই নিজেকে আর্য ও শত্রুকে বা অপছন্দের ব্যক্তিকে অনার্য বলে ভর্ৎসনা করত।
অর্থাৎ আর্যত্ব বা অনার্যত্ব জন্মে নয়, কর্মে নির্ধারিত হয়। বিখ্যাত আর্য ঋষি পুলস্ত্যের পৌত্র, ঋষি বিশ্রবার পুত্র হয়েও তাই রাবণ নিজের কুকর্মের জন্য কুখ্যাত হয়েছিলেন রাক্ষস হিসেবে। নিজের পুত্রবধুকে ধর্ষণ করা, একাধিক নারীকে জোর করে দাসী করা, সর্বক্ষণ মদ্যপ থাকা, প্রজাদের উপর অত্যাচার করা, অপরের স্ত্রীকে তুলে এনে তাকে বিয়ে করতে চাওয়া, বিয়ে না করলে হত্যা করার হুমকি দেয়া এগুলো কি আর্যত্বের লক্ষণ? এগুলো রাক্ষসের লক্ষ্মণ। রাম রাবণের যুদ্ধ তাই ছিল মহৎ আর্যের সাথে চরিত্রহীন অনার্যের যুদ্ধ, সত্যের সাথে অসত্যের, ন্যায়ের সাথে অন্যায়ের, আলোর সাথে অন্ধকারের যুদ্ধ।
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি
জয় শ্রীরাম
মূল লেখা:
বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক
0 মন্তব্যসমূহ