২০১. যারা অহেতুক অযৌক্তিক নিন্দা করে, ভেবে নিবেন তারা আপনার পর্যায়ভুক্ত নয়। আপনার অনেক নিচে। আপনাকে নিচে নামিয়ে তাদের পর্যায়ে আনতেই তাদের এ ঈর্ষান্বিত প্রয়াস। আপনার লক্ষ্য থাকবে, এগিয়ে যাওয়া। সামনের এগিয়ে থাকা মানুষটির সমপর্যায়ভুক্ত হওয়া। তাদের সংখ্যা অল্প, স্থান বেশী। তাই একবার সে স্থানে পৌঁছতে পারলে, পরে যাওয়ার আর ভয় নেই।
২০২. বিশ্ববিদ্যালয় শব্দের অর্থ হল, বিদ্যালয়ের মধ্যে যেখানে বিশ্ব থাকে, একটা প্রচণ্ড বৈশ্বিক মনন থাকতে হয়; যা মানুষকে মনুষ্যত্বে উন্নীত করে, মানবিক করে।জীবনে চিন্তার বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সহ অংসখ্য মানবিক বোধ তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়।
২০৩. একটি ঘরে অনেক দিন থেকেই অসংখ্য জীবাণুর সংক্রমণ। আমরা একটি একটি করে ঘরের সেই জীবাণুকে ধ্বংস করতে পারব না। কিন্তু একটি কাজ করলেই জীবাণু সকল নিমেষেই ধ্বংস হতে পারে; আমরা পূর্বদিকের জানালাটা খুলে দিতে পারি। এতে খোলা জানালায় ঘরে সূর্যের আলো প্রবেশ করবে। সূর্যের আলোতে সকল জীবাণু এমনিতেই পর্যায়ক্রমে ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে যদি একটি একটি করে জীবাণু ধ্বংস করতে চাই, তবে আমরা প্রচণ্ড ভুল করব। ঠিক একইভাবে বিভিন্ন কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত মতান্তরের জঞ্জালে ভরে গেছে আমাদের সম্প্রদায়ে। আমরা এই মত-মতান্তরের জঞ্জালের পেছনে লেগে এ অনৈক্যের জঞ্জাল শেষ করতে পারব না। শুধু যদি আমরা আমাদের পূর্বদিকের জানালাটা খুলে দেই, তবে বৈদিক জ্ঞান এমনিতেই সকল জঞ্জাল নাশ করে একদিন একতা এনে দিবে।
২০৪. সনাতন ধর্মে সমদর্শী হয়ে জগতের সকল জীবকে ভালবাসতে বলা হয়েছে। সনাতন ধর্ম হল বিশ্বের ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাংগঠনিক মতগুলোর বিরুদ্ধে টিকে থাকা, একমাত্র প্রকৃতি উপাসক, Pagan (মূর্তিপূজক), Animist (সর্বপ্রাণবাদী), Polytheistic , (বহু ঈশ্বরবাদী) মতের প্রতিনিধি। Pagan, Animist, Polytheistic -এ সংজ্ঞাগুলো অবশ্য পশ্চিমাদের দেয়া। শব্দগুলো অনেক সময়ে আমাদের প্রতি নিন্দার্থে তারা ব্যবহার করলেও, আমাদের এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। আমাদের ধর্ম যেমন একেশ্বরবাদী, বেদে বলা আছে 'একমেবাদ্বিতীয়্।' ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়, আমাদের ঈশ্বরের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। জগতের ভাল মন্দ সকল ভাবই তাঁর থেকে উদ্ভূত। আমাদের ধর্ম একেশ্বরবাদী, বহু ঈশ্বরবাদী, প্রকৃতিপূজারী, সর্বপ্রাণবাদী, মূর্তিপূজারী ; অর্থাৎ জগতের সকল ভাব এ ধর্মে আছে। এ ধর্ম কোন ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রবর্তিত এককেন্দ্রিক সাংগঠনিক ধর্ম নয়। যে প্রবর্তক ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে দিলে, ধর্ম অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যায়।
২০৫. মাতৃগর্ভে জন্ম নেয়া আমাদের স্থূলশরীর অন্নে উৎপন্ন এবং অন্নে পালিত। সাধনার ফলে সাধকের আস্তে আস্তে যখন উত্তরণ ঘটে তখন বিজ্ঞানময় কোষ এবং আনন্দময় কোষ স্ফীত হতে থাকে। ঠিক তখনই আর দেহ বা অন্নময় কোষ ভেতরের বৃহৎ সত্ত্বাটিকে বহন করতে পারে না। তখন সাধক জীবন্মুক্ত বা গীতার অনুসারে স্থিতপ্রজ্ঞ হয়, এরপরে যখন সে দেহত্যাগ করেন তখন তাকে বলে বিদেহমুক্তি। একারণেই দেখা যায় শ্রীশঙ্করাচার্য, শ্রীজ্ঞানেশ্বর, শ্রীচৈতন্যদেব, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী প্রণবানন্দ সহ অনেক সাধক মহাপুরুষেরাই পঞ্চাশ বছর আয়ুষ্কালের মধ্যেই দেহত্যাগ করেছেন।মানুষের দেহের ক্ষয়, দেহের বৃদ্ধি খালি চোখে দেখা যায়, কিন্তু অন্তঃকরণের ভেতরের বিজ্ঞানময় আনন্দময় কোষের বৃদ্ধি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়; শুধু সাধকই টের পান অতীন্দ্রিয় জগতের। আনন্দময় কোষের পরিমাণটা একবার যদি বাড়তে থাকে তবে বাড়তেই থাকে। দেহ তখন কোনমতেই ভেতরের ভাবস্তুকে যাকে চোখে দেখা যায় না, তাকে বহন করতে পারে না। শরীরে তখন বিভিন্ন প্রকারের ভাবের বিকার দেখা যায়। সাধকের আচরণে তখন উন্মত্ততাও পরিলক্ষিত হয়।
২০৬. আমাদের মনে রাখতে হবে, আগামীতে অবতাররূপে একজনই আসবেন তিনি হলেন কল্কি অবতার। তিনি কলিযুগের শেষ পাদে আসবেন। এখন চলছে কলিযুগের প্রথম পাদ। শেষপাদে অর্থাৎ আজ থেকে তিনলক্ষ একানব্বই হাজার বছর পরে ভগবান কল্কি অবতার রূপে আসবেন হিমালয়ের পাদদেশে সম্ভলপুর নামক স্থানে। তাই ভবিষ্যৎ অবতার নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, আমরা বেদবেদান্তের শরণে থাকি এবং জাতিগঠন করি। তবে আসেপাশে অবতার নামে ভণ্ডদের দেখা পেলে বিভ্রান্ত না হয়ে তাদের কল্যাণার্থে একটু যথাসম্ভব তাদের, "ঠেলার নাম বাবাজী" ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। এ মহৌষধে অবতার দেবদেবী হওয়ায় রোগ তাদের ভাল হয়ে যাবে। পূর্বে এ ওষুধের ব্যবহার না করাতে, আজ কত ভণ্ড যে অবতার, ভগবান নাম ধারণ করে মন্দিরে পূজিত হচ্ছে তার হিসেব নেই।
২০৭. জীবিত এবং সমসাময়িক ব্যক্তিদের নিয়ে লেখা একটা দূরহ কাজ, সম্পর্ক নষ্টের ভয় থাকে। কে কি মনে করবে এর একটা অজানা ভয় থাকে। এ কারণেই মানুষ যখন এ ঘটনাগুলি খেরোখাতায় লেখে, অনেক ভেবেচিন্তে লিখতে হয়। ভেবেচিন্তে লেখার কারণে সত্য ঘটনাগুলি অনেক সময়ই পালিশ করা থাকে।
২০৮. বর্তমানে আমাদের শিক্ষিত সমাজের মাঝে কয়েকটি নেতিবাচক বিষয় লক্ষ্য করা যায়, কোন বিষয়ে সম্যক জ্ঞান না থাকলেও সে বিষয়ে নিজের ইচ্ছা খুশিমত মতামত দেয়া। সকল বিষয়কে নিজের দৃষ্টিতে দেখা। নিজে যদি একটি লাল চশমা পড়ে থাকে তো, জগতের সর্বদা সকল কিছুকেই সে লাল দেখে। জোড় জবরদস্তি করে হলেও সবাইকে লাল দেখতেই হবে। কিন্তু প্রত্যেকটি ব্যক্তি এবং তত্ত্বকে দেখতে হবে, সেই তত্ত্বের দৃষ্টিতে। তত্ত্বের ফলাফলটা গ্রহণ করতে হবে, বর্ণনা রীতি নয়। বর্ণনারীতিতে হয়ত অলৌকিকতা অধিবাস্তবতা আছে, যা অবিশ্বাস্য।এ অবিশ্বাসের দোহাই দিয়ে যদি আমরা তত্ত্বের ফলাফলকেই ঝেড়ে ফেলে দেই, তবে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। তত্ত্ব তত্ত্বের স্থানেই থাকবে, এর কোন ক্ষতি হবে না।
২০৯. ভক্ত ভগবানের মিলনে অন্ধকার অমাবস্যার মত হৃদয়ে মুক্তির পূর্ণিমা আবির্ভূত হয়। তখন তার সময়কালের ভেদ থাকে না। এমনিতেই সাধারণভাবে লক্ষ্য করলে আমাদের বাস্তব জীবনেও দেখা যায় প্রিয়জনের সান্নিধ্যে তিনঘণ্টা সময়কে মাত্র তিনমিনিটের মত মনে হয়। প্রিয়জনের সান্নিধ্যে কাটানো রাত মনে হয় কয়েক মিনিটেই বুঝি শেষ হয়ে গেল।
২১০. আমাদের পারিপার্শ্বিক জগতের বাইরে এক অতীন্দ্রিয় জগতের কথা।এক অন্য ভাবজগতের কথা।
সাধকবিহীন অধিকারীহীন কেউ হঠাৎ সে জগতের কথা শুনলে মর্মে তাদের আঘাত লাগতে পারে।একমাত্র সাধক ভক্তরাই জানে জগতটির মাহাত্ম্য।এ কারণেই বাউল বৈষ্ণবেরা সর্বদাই বলেন, "আপন সাধ্যসাধন কথা, না বলিবে যথাতথা।" সারাজীবন যে রাস্তার আসেপাশে নুড়ি পাথর দেখেছে, তার কাছে হীরাকেও রাস্তার নুড়িপাথর মনে হতে পারে, এটা অসম্ভব না। কারণ সে, হীরা কোনদিন দেখেনি।
২১১. যখন কেউ পরকীয়া প্রেম করে তখন তার প্রেমিক এবং প্রেমিকা ছাড়া আর বাহ্যজ্ঞান থাকে না। দুর্বার প্রেম জাগ্রত থাকে সর্বদা। সে প্রেম পরিবার, সমাজ সংসার সকল কিছুকেই অগ্রাহ্য করে, এ দুর্বার প্রেমের দিকে চিন্তা করেই বৈষ্ণব কবিরা পরকীয়া প্রেমের কথা বারবার বলেছেন। ঈশ্বরকে পেতে হলে স্বাভাবিক প্রেম নয়, পরকীয়ার মত দুর্বার প্রেমরূপ ভক্তিই ভক্তকে ভগবানের কাছে নিয়ে যায়। এ অনন্য ভক্তিই সাধকের মুক্তির চাবিকাঠি।
২১২. শুনেছি গোল্ডফিশের মেমোরি নাকি এক সেকেন্ড থাকে, আমার মনে হয় বিভিন্ন ঘটনার ঘনঘটায় বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মেমোরি এ গোল্ডফিশের মতই হয়ে গেছে।
২১৩. প্রেম নিয়ে আলোচনা সমালোচনার অন্ত নেই। বিশ্বব্যাপী সাহিত্যেরও অন্ত নেই। বাহ্যিকভাবে মানব সভ্যতার কাঠামোগত পরিবর্তন হলেও, মানবিক অনুভব অনুভূতিগুলো এখনও সেই পূর্বের মতই আছে; শুধু প্রেমিক প্রেমিকার প্রেম প্রকাশের পদ্ধতি হয়ত পরিবর্তিত হয়েছে।কেউ প্রেম করি, কেউ আবার প্রেমে পড়ি।আমরা যখন প্রেমে পড়ি, তখন হিতাহিতজ্ঞান থাকে না, মোহাচ্ছন্নতা পেয়ে বসে আমাদের।এর বিপরীতে সচেতনভাবে যদি প্রেম করি, তবে নিজের প্রেমরূপ গাড়ির ড্রাইভার নিজেকেই হতে হবে। গাড়ির স্টিয়ারিংটা যদি অন্যের হাতে থাকে, তাহলেই সর্বনাশ। আর সেই ড্রাইভার যদি ছলাকলা এবং প্রবঞ্চনা যুক্ত মানসিকতার হয় তাহলে তো কথাই নেই।ড্রাইভারের উপরেই গাড়ির গন্তব্য নির্ভরশীল। তাই ড্রাইভার ঠিকঠাক থাকলে, আর দুর্ঘটনা ঘটে না। তা না হলে দুর্ঘটনা ঘটবেই। নারীপুরুষের সাম্যাবস্থা আকাঙ্ক্ষিত, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে আদৌ সম্ভব না।
২১৪. প্রেম শুরু হয় চোখ সহ পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে, পরে আস্তে আস্তে ভালবাসা, আরো পরে ভাললাগা, এর পরে দায়িত্ব দায়বদ্ধতা এসে সম্পর্ককে দৃঢ় করে।প্রেমকে সূত্রবদ্ধ করা যায় না। আমরা আমাদের আশেপাশের ঘটনাবলী দেখে যতবেশি সূত্রায়িত করার চেষ্টা করি, ততই সে সূত্রকে ভেঙে নতুন নতুন রূপে আবির্ভূত হয়। এ জগত একটি নাট্যমঞ্চ, এ নাট্যমঞ্চে আমরা সবাই এক একজন অভিনেতা। এ বিচিত্র জগতের কেউ কারো নয়। এরপরেও আমরা আপন আপন ভাব করে যাচ্ছি, সম্পর্কে নামক খেলা খেলে যাচ্ছি। কখনো শান্তি পাচ্ছি, কখনও ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি।
২১৫. প্রেম বিশেষ করে টিনএজ বয়সের প্রেম যতটা না প্রেম, এর থেকে বেশী আবেগের বশীভূত থাকে। এ আবেগের তীব্রতা বাড়তেই আসে মোহাচ্ছন্নতা। তখন মানুষের হিতাহিতজ্ঞান থাকে না। আকাশে মেঘ আসলে হঠাৎ যেমন, সূর্য ঢেকে যায়। কিছু সময়ের জন্যে আলো কমে যায়। আবার যখন মেঘ কেটে যায়, তখন চারিদিকে আলো জ্বলজ্বল করে উঠে। ভাল করে তখন পর্যবেক্ষণ করলে মেঘের খপ্পর টের পাওয়া যায়। আবেগের বশীভূত অবস্থায় মা-বাবার কারো কথাই ভাল লাগে না। একটু সময় চলে গেলে এই ছেলেমেয়েরাই বুঝতে পারে যে, তারা বিপদে ছিল, পাহাড়ের চূড়ার খাদে ছিল, যে কোন সময়ে পড়ে যেতে পারত। বিষয়টি পতঙ্গের আগুনে ঝাঁপ দেয়ার মত। পরিবারগুলিতে প্রেমের নামে দুর্ঘটনাগুলি এ টিনএজ সময়েই বেশী ঘটে। পতঙ্গরা চোখের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে, আগুনকে প্রিয় মনে করে আগুনে ঝাঁপ দেয়। পরিণামে তাদের কি হয়, তা আমরা সকলেই জানি। এ কাণ্ডজ্ঞানহীন আত্মঘাতী ভালবাসার কথাগুলি সাহিত্যে শুনতে হয়ত ভাল লাগে, চরিত্রগুলিকে অমর করে; কিন্তু বাস্তবে অনেকটাই অপ্রয়োজনীয়।
২১৬. যেখানেই ব্যক্তিগত কুৎসা, সেখানেই অসত্য। যেখানেই অসত্য, সেখানেই অধর্ম। যেখানেই অধর্ম, সেখানেই বিনাশ।
২১৭. নারী এবং পুরুষদের এ দৈহিক মানসিক প্রকারভেদকে উপলক্ষ করে, সংস্কৃত আলঙ্কারিকরা বিশেষ করে শ্রীবিশ্বনাথ কবিরাজ তাঁর "সাহিত্যদর্পণ" গ্রন্থে নায়ক বা পুরুষদের ৪৮ প্রকারে এবং নায়িকা বা নারীদের ৩৮৪ প্রকারে ভাগ করেছেন।এখানে অবাক হওয়ার বিষয়, একজন নারীর মনজগতের প্রকারভেদ পুরুষের থেকে ৮ গুন বেশী। এ কারণেই নারীকে বুঝতে বহু পুরুষেরা ধোঁকা খেয়ে যায়। সৌন্দর্য দেখে এগিয়ে পরে বিপদগ্রস্ত হয়ে যায়। অনেকে কাটিয়ে উঠতে পারে আবার অনেকে ত্রিশঙ্কুর মত মধ্যগগনে ঝুলে থাকে, উপরে নিচে কোথাও যেতে পারে না।
২১৮. আমাদের ভালবাসা যখন ব্লিডিং হার্টের মত পঞ্চেন্দ্রিয় সর্বস্ব হয়ে যায় তখন নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম প্যারাসাইটের মত আমাদের দুর্ঘটনায় প্ররোচিত করে। সৌন্দর্য দেখে আমরা অনেকেই ব্লিডিং হার্টের কাছে যাই, আর বিষগ্রস্থ হই। কেউ যদি আগে থেকে সাবধান করে আমরা তাদের শত্রুর মত মনে করি। এ সময়ে বাবা-মা আত্মীয় পরিজন সহ যারা সাবধান করে, সকলই তখন শত্রুর মত মনে হয়। জীবন চলার পথে কোথায় কোথায় লাগাম দিতে হয়, তা আমরা অনেকেই জানি না।
২১৯. হনুমানজির মত নিঃস্বার্থ ভক্ত বা কর্মী হতে আমরা কয়জনে চাই? ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের পাশে থেকেও যিনি সামান্যতম ব্যক্তিগত স্বার্থ গ্রহণ করেননি। বিভীষণ, সুগ্রীব শ্রীরামচন্দ্রের সাথে থেকে পরবর্তীতে রাজা হয়েছিলেন।ব্যতিক্রম ছিলেন হনুমান। তিনি শুধুমাত্র শ্রীরামকেই চেয়েছিলেন এবং ভালোবেসেছিলেন। শ্রীরামই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান এবং ভালবাসা; তাঁর এ নিঃস্বার্থ ভালবাসা তাকে অমর করে দিয়েছে। তাই আজও যেখানেই শ্রীরামচন্দ্রের কথা, সেখানেই উচ্চারিত হয় ভক্ত হনুমানের নাম।
২২০. শেখালেই কি সবাই শিখতে পারে? কেউ সামান্যতেই শিখে যায়, কাউকে ধরে বেঁধে জোর করে শিখাতে হয়। কেউ অমূল্য সম্পদ হারিয়ে ফেলে তবেই শিখতে পারে।
২২১. জগতকে পরিবর্তন করার আগে নিজেকে পরিবর্তন করা প্রয়োজন। আমি চাইলেও জগতকে রাতারাতি পরিবর্তন করতে পারব না। তবে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকতে হবে। কিন্তু যার ইশারাতে এ জগত চলছে, তাঁর ইশারা ছাড়া সকল প্রচেষ্টাই নিস্ফল লবডঙ্কা।
২২২. যন্ত্র যে আবিষ্কার করে এর প্রয়োগ অপপ্রয়োগের দায়বদ্ধতা আবিষ্কর্তার উপরে নয়। যারা যন্ত্রটি ব্যবহার করছে দায়বদ্ধতা তাদের উপরেই বর্তায়।
২২৩. ভয়ংকর ভল্লুক এবং উন্মত্ত হাতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ। চাইলে সিংহের পিঠেও বসা যায়। বিষাক্ত সাপকেও বশীকরণ করা যায়। অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা গেলেও, কখনও সম্ভব হয় না; ভালবাসাহীন দুজনের একসাথে থাকা।
২২৪. ভগবান শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তির প্রতীক শ্রীমতী রাধারাণী বা রাধাকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনার অন্ত নেই। বাংলায় রাধা মানুষের মুখে মুখে অন্তরে অন্তরে। মধ্যযুগে বাংলা ভাষাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত এবং ভাব মাধুর্যময় করেছে রাধা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনে রাধা যতটা না চরিত্র, এরথেকেও বেশী তিনি তত্ত্ব। ভক্তের স্বরূপ রাধা।রাধা শব্দকে উল্টা করলে হয় ধারা ; অর্থাৎ প্রেমের ধারা ভাবের ধারা। সাধকের ভাষায় এ ধারাতেই ভক্ত এবং ভগবানের মিলন হয়, সে মিলনে ভক্তের অন্ধকার হৃদয়ে আলো আসে। তখন অমাবস্যায় পূর্ণিমা হয়। মধ্যযুগের কবি শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ বলেছেন, রাধা তাকেই বলে যার ভিতরে বাহিরে কৃষ্ণময়ী কৃষ্ণ ভাব এবং চোখ দিয়ে তাকিয়ে সর্বত্র যে সর্বদা শ্রীকৃষ্ণকেই দেখে। কঠোর আরাধনা করে যিনি, চির আকাঙ্ক্ষিত ধন শ্রীকৃষ্ণকে পেয়েছেন এবং জগতমোহন শ্রীকৃষ্ণের যিনি পরাশক্তি, তিনিই রাধা।রাধাকৃষ্ণ প্রধানত একই স্বরূপ, আপাত দুইজন মনে হলেও তারা অভেদ; রাধা পূর্ণ শক্তি কৃষ্ণ পূর্ণ শক্তিমান। যেমন করে মৃগমদ এবং তার গন্ধ অবিচ্ছেদ্য; অগ্নি এবং তার প্রজ্জ্বলিত শিখা অবিচ্ছেদ্য; ঠিক একইভাবে রাধাকৃষ্ণ অভেদ।
২২৫. বনের গাছকে কাটতে সহায়তা করে, এই গাছেরই স্বজাতি কুড়ালের হাতল। গাছ যতই তাদের আপনজন মনে করে স্বগোত্র মনে করে ভরসা করে; দিনশেষে কুড়াল গাছের বুকেই আঘাত করে।বিশ্বাসভঙ্গ করে,ক্ষত-বিক্ষত করে।এ গাছের মতই দশা অনেকটা আমাদের মানুষের; আমাদের আশেপাশে প্রায়শই দেখি, আপন স্বগোত্রদের দ্বারাই নির্মমভাবে প্রতারিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হই।
২২৬. মানুষের ঘরে জন্ম হলেই সবাই মানুষ হয় না। মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়, তবেই তাকে মানুষ বলে। তাই মানুষকে গুরুজনেরা আশীর্বাদ করে বলে, "মানুষ হও।" কিন্তু একটি কুকুরের বাচ্চাকে বলে না, তুমি কুকুর হও। তার কুকুরত্ব জন্মগত, কিন্তু পক্ষান্তরে মানুষের মনুষ্যত্ব জন্মগত নয়; ব্যক্তির স্বোপার্জিত।
২২৭. ধর্ম একটি বিমূর্ত সত্ত্বা। এ সত্ত্বা মূর্তিমান হয় ব্যক্তি গোষ্ঠীর সদাচারে। জগতকে ধারণ করে আছে ধর্ম। তাই জগতের সকল সুখের প্রধান উৎস ধর্ম। ধর্মের শুদ্ধ আচরণে মানুষ কীর্তিমান হয়ে সুখ লাভ করে এবং পরিশেষে মুক্তি লাভ করে। বিপরীতে অর্ধমের আচরণে জগত পাপ দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে সর্বদা নিম্নগামী হয়। ধর্মের দুটি সত্ত্বা, একটি আধ্যাত্মিক ; অন্যটি ব্যবহারিক। ধর্মের আধ্যাত্মিক অংশটিই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং শাশ্বত। কিন্তু আধ্যাত্মিক অংশে পৌঁছাতে হলে ব্যবহারিক অংশ সাধারণত অতিক্রম করে যেতে হয়। বিষয়টি উপরে ওঠাতে সিঁড়ির এক একটা ধাপের মত; একটি ধাপকে অতিক্রম করেই, তবে অন্য ধাপটিতে যেতে হয়। আধ্যাত্মিকতায় অর্থ এবং রাজশক্তি প্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু ব্যবহারিক বা আনুষ্ঠানিক ধর্মের আয়োজনে অর্থ এবং রাজশক্তির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অর্থ না থাকলে মানবের সংসারযাত্রা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে যায়। অর্থদ্বারা ধর্মের বিভিন্ন ব্যবহারিক সদাচার দান, তীর্থযাত্রা, সেবা সহ বিবিধ লোককল্যাণ অনায়াসে করা যায়। তবে অর্থের সাথে সাথে আর একটি বিষয় অত্যন্ত জরুরী, তা হল রাজশক্তি বা রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদারি হওয়া। জগতের অধিকাংশ মতবাদই অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচারিত। অর্থ এবং রাজশক্তি এ দুটি মুখ্য ক্ষমতা মানুষের অন্যান্য গৌণ সকল ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রিত করে।
২২৮. পৃথিবীর অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী যখন পরিমাণগত (quantitative) মানের দিকে সম্পূর্ণ ঝুঁকে ছিল ; তখন এদেশের প্রাজ্ঞজনেরা গুণগত (qualitative) মানের দিকেই তাদের সম্পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল। পরিণতিতে যা হওয়ার, তাই হয়েছে। সংখ্যাধিক্যের জোরে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনাই হয়েছে, যা কাম্য ছিল না। এদেশীয় ইতিহাস তার সাক্ষী। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, ক্ষমতার চাকা গুণগত এবং পরিমাণগত এ দু'ভাবেই জগতে যুগপৎ অতিক্রম করে। কখনো এ চাকা থামে না, মানুষকে এ ঘুর্নায়মান চাকার সাথেই সাধ্যমত পথ চলতে হয়। যারা চলতে পারে না তারা পিছিয়ে পরে। ইতিহাস তাদের ভুলে যায়।
ক্ষমতার তো বটেই, ধর্মের প্রসারেও পরিমাণগত আধিক্য অপরিহার্য। যত মহৎ আদর্শই হোক না কেন লোকজন বা অনুসারী না থাকলে, সে আদর্শ হারিয়ে যায়।
২২৯. শুধুমাত্র ধর্ম ধর্ম করলেই হবে না; ধর্মকে রক্ষাকারী সক্রিয় ধনুর্ধারী পার্থদেরও অত্যন্ত প্রয়োজন আছে। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায়, এমন অনেক জাতি সম্প্রদায় আছে, তাদের মধ্যে প্রচুর সংখ্যক জ্ঞানী ধর্মপ্রাণ পণ্ডিত ব্যক্তি আছেন; কিন্তু তাঁদের জনসংখ্যা নেই, অনুগামী নেই। ব্যক্তিগতভাবে তাঁরা স্মরণীয় হলেও তাঁদের মতবাদ এবং দর্শনের সিংহভাগই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। এর বড় উদাহরণ গ্রিকের সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল এ প্রখ্যাত দার্শনিকেরা। মানুষ ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের স্মরণ করলেও, প্রাচীন গ্রিক দেবদেবীদের সম্পর্কিত ধর্মদর্শনের পরিমাণগত প্রবৃদ্ধি হয় নি। আজ তাই সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল এ বিখ্যাত দার্শনিকদের পূজিত দেবতারা পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে, শুধু অনুসারীর অভাবে। সত্যদ্রষ্টা জ্ঞানী অনেকে থাকার পরেও, অনুসরণকারী অনুগামী না থাকায় জগতের অনেক মহত্তর মতবাদ লুপ্ত হয়ে গেছে। এর বিপরীতে পৃথিবীতে অনেক নৃশংস মতবাদও ধর্মের নামে স্থাপিত হয়েছে, শুধু অনুগামীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে। তাই ধর্মের ব্যবহারিক প্রাতিষ্ঠানিক রূপের জন্যে অর্থ এবং রাজশক্তি অনিবার্য।
২৩০. রাজা হতে চাইলে আগে রাজার রাজভাব গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ মানসিকভাবে একটি 'স্বয়মেব মৃগেন্দ্রতা' ভাব নিয়ে আসতে হবে। সিংহ বনে বাস করে। বনে তাকে কোন আনুষ্ঠানিক অভিষেক বা সংস্কার না করলেও সে তার আপন শক্তিবলেই বনের রাজা। তেমনিভাবে নিজের মধ্যেই অবস্থিত সুপ্ত সিংহভাবকে জাগ্রত করতে হবে। এ ভাবই তাকে একদিন ঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দিবে।
২৩১. আমরা নিজেকে সুন্দর দেখানোর জন্যে, আয়নাকে পরিষ্কার করি; অনেক সময় সাধ্য থাকার পরেও নিজেকে পরিষ্কার করার একবারও চেষ্টা করি না। কিন্তু একবারও হয়ত ভেবে দেখি না, নিজে যদি অপরিষ্কার হই, তবে দিনরাত্রি বসে আয়না পরিষ্কার করলে কিছুই হবে না। তাই নিজেকে পরিষ্কার করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন।
২৩২. যারা পরিবর্তিত হয় না, পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারে না ; তারা স্থবির। সৃষ্টি নয়, মৃত্যুই তাদের লক্ষ্য। এ মৃত্যুর জন্যেই তারা আমৃত্যু বেঁচে থাকে।
২৩৩. যাদের অভিযোজন ক্ষমতা কম, তারাই জগৎ থেকে হারিয়ে যায়। সকল পরিস্থিতিতে নিজেকে যারা মানিয়ে নিতে পারে, তারাই জীবন সংগ্রামে বিজয়ী হয়।
২৩৪. শব্দ ব্রহ্মস্বরূপ অবিনশ্বর। জগতের প্রত্যেকটি শব্দই মহাবিশ্বে রয়ে যায়। শব্দের একটি অনন্য শক্তি আছে। এ শক্তি যে কোন সময়েই ক্রিয়াশীল হতে পারে। তাই রাগে, ক্রোধে অকারণ নেতিবাচক চিন্তা এবং শব্দ সর্বদাই পরিত্যাজ্য।
২৩৫. যা প্রচণ্ড শক্তিশালী, তা সবসময়ই বিপদজনক হয় যদি তাকে ঠিকমত নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করা না হয়। সকল কিছুই নির্ভর করে নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনার উপরে। আগুন যেমন বিপদজনক, নিমেষেই সকল কিছু পুড়িয়ে শেষ করে দিতে পারে। আবার আগুন দিয়ে রান্না করে খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। তাই সতর্কতা বজায় রেখে, জীবনের প্রত্যেকটি দিন আগুনের অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা আছে। যার ক্রিয়া আছে, তার প্রতিক্রিয়াও আছে; যার কোন প্রতিক্রিয়া নেই, বুঝতে হবে তার ক্রিয়াও নেই।ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া মুদ্রার মত একটি অন্যটির পরিপূরক।
২৩৬. মনের থেকে গতিশীল জগতে কিছুই নেই, সে সেকেন্ডে যেখানে যেতে চায়, সেখানেই পৌঁছে যায়। মন একটি পাগলা ঘোড়ার মত। সে কোথা থেকে যে কোথায় নিয়ে যাবে, তার ঠিক ঠিকানা নেই; যদি সারথি ঠিক না থাকে। মনের কাজ হল, সঙ্কল্পবিকল্পাত্মক। মনের চিন্তা প্রতি ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হয়।এখনি যা ভাল লাগে, পরক্ষণেই তার বিষের মত মনে হয়।তাই মনের রশিকে শক্ত হাতে ধরতে হয়। এ চঞ্চল মনের কথা বিস্তৃতভাবে শ্রীমদ্ভগবদগীতাতেও বলা হয়েছে।
২৩৭. সঙ্কল্পবিকল্পাত্মক মনের মত ভবঘুরে আর নেই; এ মনকে তাই যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রিত করে রাখতে হয়। শুদ্ধ বুদ্ধিই মনকে পথ দেখায়। যতক্ষণ শুদ্ধবুদ্ধির উদয় না হয়, মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে চলতেই থাকে। কোথায় চলছে, কোথায় গন্তব্য সে জানে না ; এরপরেও চলতে থাকে। আগুনে ঘি দিলে যেমন আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে, তেমনি মন সহ ইন্দ্রিয়কে যদি আমরা নিয়ন্ত্রিত করে বশে আনতে না পারি; তবে দোদুল্যমান মন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে। এর পরিনাম নিশ্চিত দুর্ঘটনা।
২৩৮. বিপ্লবী স্বদেশী অধিকাংশদেরই সহায় ছিল শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বর্ণিত আত্মতত্ত্ব। ব্রিটিশরা এ কারণেই যেখানে গীতা পেতেন, মনে করতেন এখানে একটি স্বদেশী আছে। সারা পৃথিবীতে বিস্তৃত ব্রিটিশের সাম্রাজ্যের সূর্যাস্ত হত না, সেই ব্রিটিশ শুধু ক্ষুদিরাম, সূর্যসেনের মত বিপ্লবীদের কাছে অসহায় হয়ে যায় ; শুধু তাঁদের মনবলের কারণে। মানুষের শক্তি তার দেহে যতটা দৃশ্যমান ; অদৃশ্য হয়ে মনজগতে ততটাই বিস্তৃত। শুধু সাহস নিয়ে দাড়িয়ে গেলেই হয়। বিপ্লবীরা যখন উপলব্ধি করেছে, আত্মা অবিনাশী, দেহের মৃত্যুতেও আত্মার বিনাশ হয় না; তখন তাঁরা সামনে যতবড়ই ভয়ংকর সাম্রাজ্যবাদী হানাদার হোক, সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। এর পরিণামেই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশেরা এ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। ঘরে বসে চরকায় সুতা কেটে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়নি, হয়েছে ক্ষুদিরামদের মত অসংখ্য বিপ্লবীদের আত্মত্যাগে। শ্রীমদ্ভগবদগীতাই তাঁদের শিখিয়েছে, প্রত্যেকটি মানুষের অন্তঃস্থিত আত্মাকে শস্ত্রের দ্বারা ছেদন করা যায় না, অগ্নিতে দগ্ধ করা যায় না, জলে ভেজানো যায় না এবং বায়ু তাকে শুষ্ক করতে পারে না। আত্মাকে যেহেতু কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করা যায় না, তবে কিসের মৃত্যুভয়?
২৩৯. ভগবানকে জীবনের ধ্রুবতারা নির্দিষ্ট করে, অনন্যচিত্তে তাঁকে স্মরণ নিতে হবে, তবেই তিনি কৃপা করবেন। আমাদের সকল ভার বহন করবেন। আমাদের বামহাত ডানহাতের সাথে আরও একটি হাত আছে, তা হল অজুহাত। কিন্তু, এরপর, তারপর, বিষয়টি এমন না, আপনাকে বুঝতে হবে,আমার সমস্যাটি বুঝতে হবে, আপনাকে বোঝাতে পারছি না, আমার স্থানে আপনি থাকলে বিষয়টি বুঝতে পারতেন - এ জাতীয় শব্দ এবং বাক্যের সফল ব্যবহার করে আমরা বিভিন্ন অজুহাতকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করি। ঈশ্বরকে স্মরণ বা তাঁর পথে চলার প্রসঙ্গ আসলে। পরিনামে নিজেকেই নিজেরা প্রতারিত করি।অনন্যচিত্তে স্মরণ নিলে ভগবান কৃপা করবেনই। যেহেতু তিনি শ্রীমদভগবদগীতাতে নিজে আমাদের কথা দিয়েছেন, তাঁর কথা অব্যর্থ। এরপরেও তাঁকে ডাকার আমরা সময় পাই না।
২৪০. জীবন মানেই চলা, থেমে যাওয়ার নামই মৃত্যু। তাই মানুষকে আমৃত্যু ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছাতেই হোক চলতেই হয়।আমরা চলতে চলতে হয়ত বিভিন্ন স্টেশনে সাময়িক স্বল্প সময়ের জন্যে বিরতি দেই,পরক্ষণেই আবার চলতে হয়। ঢাকা থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম যেতে হলে সম্পূর্ণ সময়টা ট্রেনে বসেই থাকতে হবে। ট্রেন থেকে নেমে গেলে, আর গন্তব্যে যাওয়া হবে না।মানবজীবনের এ আমৃত্যু প্রবাহমানতা নিয়ে অসংখ্য বাউল কবিরা গান তৈরি করেছেন।দেহের এ আমৃত্যু নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহমানতাকে কেউ ঘড়ির সাথে, কেউ গাড়ির সাথে, কেউ আবার মাটির প্রদীপের সাথে তুলনা করেছেন।
২৪১. কর্মহীন অদৃষ্টের আশায় বসে থাকাটা অশাস্ত্রীয়। সাধ্যমত নিষ্কাম কর্ম আমাদের প্রতিনিয়ত করে যেতে হবে। এ নিষ্কাম কর্মে মানুষের ভাগ্যের গতিপথ পরিবর্তিত হয়। তাই পূর্ববর্তী জন্মজন্মান্তরের প্রারব্ধ কর্ম, এ জন্মে নিষ্কাম কর্ম এবং দৈবানুগ্রহ ; মুখ্যত এ তিনটি বিষয়ের অধিকারী ব্যক্তিই মুক্তির পথে অগ্রসর হয়ে মুক্ত হয়।জগতে চারিপাশে আমরা যা প্রতিনিয়ত দেখি, তার সকলই সত্যি নয়, আবার যা যা দেখতে পাইনা তার সকলই মিথ্যা নয়।
২৪২. বন্ধুত্বে কোন বয়স থাকে না ; বড় ছোট ভেদ থাকে না; কোন ধনী গরিবের ভেদাভেদ থাকে না; রাজা প্রজার ভেদ থাকে না এবং মানুষ প্রাণীতেও ভেদাভেদ থাকে না। মনের মিলনে উৎপন্ন ভালবাসাই এখানে বড় কথা। শ্রীরামচন্দ্রের বন্ধু ছিল নিষাদরাজ গুহক, যিনি সামাজিক মর্যাদায় শ্রীরামচন্দ্রের সমতূল্য ছিলেন না। কিন্তু ভগবান শ্রীরামচন্দ্র তাঁকেও প্রিয় বন্ধু বলে সম্মানিত করেছেন। নিষাদরাজ গুহকের রাজ্য ছিল গঙ্গার তীরস্থ শৃঙ্গবেরপুর নামক স্থানে। অযোধ্যা ত্যাগ করে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা প্রথমে এ রাজ্যে প্রবেশ করলে; নিষাদরাজ গুহক তাঁদের যথাযথ সমাদর করেন। গঙ্গা নদী পার হওয়ার জন্য নৌকার ব্যবস্থা করেন। শ্রীরামের সন্ধান করতে ভরতকে সহায়তা দিয়ে ভরতকে সসৈন্যে গঙ্গানদী পার করার ব্যবস্থা করে দেন। বন্ধুত্বের সম্পর্কের নিদর্শন স্বরূপ চৌদ্দবছর বনবাস শেষ করে শ্রীরামচন্দ্র অযোধ্যাতে ফিরে আসার সময় বন্ধু গুহককে দর্শন করে যান। শ্রীকৃষ্ণের জীবনেও আমরা একই বিষয় দেখি, অবন্তীপুরে অবস্থিত সান্দীপনি মুনির আশ্রমে শ্রীকৃষ্ণের সহপাঠী ছিলেন এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ সুদামা। প্রচণ্ড হতদরিদ্র বাল্যবন্ধু সুদামার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সর্বদা রক্ষা করেছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
২৪৩. কিছু খাবার দেখতে এক হলেও স্বাদের পার্থক্য বিস্তর। ফেনাভাত এবং মিষ্টান্ন দেখতে এক বলে তাদের একই স্বাদের খাবার মনে করলে ধোকা খেতে হবে। কথাটি চিনি এবং লবণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমাদের আশেপাশের অনেক মানুষকে চিনির মত দেখতে হলেও, কিছুকাল পরেই তাদের লবণত্বের তীব্রতা টের পাওয়া যায়।বন্ধু শব্দটা খুবই ছোট একটি শব্দ, কিন্তু বন্ধু হতে অনেক ত্যাগ করতে হয়, কাঠখড় পোড়াতে হয়। বন্ধুত্বের সবার আগে প্রয়োজন একে অন্যের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। বলা হয় প্রয়োজনেই বন্ধুকে চেনা যায়। জীবনে অনেককেই প্রথমে বন্ধু বলে মনে হলেও, পরে দেখা যায় সে বন্ধু ছিল না। সে ছলনাকারী, সে প্রতারক।
২৪৪. প্রয়োজনে যাদের সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়, তারা কখনই প্রিয়জন হয় না। যারা সত্যিকারের প্রিয়জন, তারা কখনো বিপদে এবং প্রয়োজনে হারিয়ে যায় না।
২৪৫. ভয়ংকর ভালবাসার অভিঘাতে ছেলেরা বেশী আত্মহত্যা করে না, মেয়েরা বেশী করে এটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। কিন্তু ভালবাসায় যদি একবার প্রবঞ্চনার ঘুণ ধরে, তবে আত্মহত্যা করুক বা না করুক; বহু ছেলেমেয়েরা এই ভয়ংকর স্বার্থান্বেষী অভিঘাতে জীবন্মৃত হয়ে যায়। অবশ্য সত্যিকারের ভালবাসা মানুষকে প্রেরণা দেয়, জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করে।
২৪৬. কারো সাথে ঝগড়াঝাটি হলে, মনে রাখা প্রয়োজন, পরবর্তীতে শত্রুতা যদি কখনও বন্ধুত্বে রূপান্তরিত হয় ; তবে যেন ঝগড়াঝাটির সময়ে শত্রুতাযুক্ত তিক্ত কথাগুলো মনে করে লজ্জা পেতে না হয়, মুখ লুকাতে না হয়।
২৪৭. জীবন চলার পথে কখনও কাউকে ছোট করতে নেই। কে যে কখন কোন স্থানে পৌঁছে যাবে, তা বিধাতা ছাড়া আর কেউ জানেন না।
২৪৮. গাঙ দিয়ে দলবেঁধে মাঝিমাল্লারা সারিগান গেয়ে চললে গাঙের কিছুই আসে যায় না। গাঙ গাঙের মত নির্ভীকচিত্তে কলকল ধ্বনিতে বয়ে যায়।তেমনিভাবে জীবন চলার পথে কত মানুষ কত কথা বলবে, তার সবটা শুনতে গেলে এবং কথাগুলোকে গুরুত্ব দিলে জীবনে চলা কঠিন হয়ে যায়।অবান্তর অপ্রাসঙ্গিক, কুরুচিপূর্ণ কথাগুলো গ্রহণ না করলেই হয়, তবে যার কথা তার কাছেই থেকে যায়।
২৪৯. যদি কোন দার্শনিক মতবাদকে রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা এবং রক্তচক্ষুর ভয় দেখিয়ে সুরক্ষা দিতে হয়; তবে বুঝতে হবে সে মতবাদ অসার এবং দুর্বল। রাজশক্তির প্রভাব চলে গেলে সে মতবাদ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
২৫০. মানুষের ইন্দ্রিয় সীমাবদ্ধ, এ কারণেই মানুষের জীবন এত সুন্দর স্বাচ্ছন্দ্যময়; মানুষের চোখ যদি একটি অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মত হত, তবে মানুষ একগ্লাস জলও খেতে পারত না। লক্ষ-কোটি জীব তার চোখের সামনে ভেসে উঠত। জগতে যা আমরা প্রতিনিয়ত দেখি, তার সকলই সত্যি নয়, আবার যা যা দেখতে পাইনা তার সকলই মিথ্যা নয়।
********
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
0 মন্তব্যসমূহ