সমগ্র বিশ্বব্যাপী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান প্রতীক ওঙ্কার (ॐ)। চিন্তার অতীত পরমেশ্বরকে বোঝাতে ওঙ্কার (ॐ) চিহ্নটি ব্যবহৃত হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওঙ্কারের পরে দ্বিতীয় পবিত্র প্রতীক হলো স্বস্তিকা (卐) চিহ্ন। স্বস্তিকা চিহ্নটি প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষের মঙ্গল, সেবা, শান্তি এবং কল্যাণময় ঈশ্বরের প্রতীক বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ সেবার প্রতীক স্বস্তিকা (卐) চিহ্ন শুধুমাত্র সনাতন ধর্মের নয়; বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মাবলম্বীদেরও পবিত্র প্রতীক।বৌদ্ধদের ধর্মচক্রের পর দ্বিতীয় প্রতীক। ওঙ্কার (ॐ) এবং স্বস্তিকা (卐) চিহ্নের সাথে সাথে বৃহত্তর বঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি নিজস্ব প্রতীক রয়েছে। সেই প্রতীকটি বাঙালি হিন্দু তাদের সকল যজ্ঞ, পূজা, পার্বণ, ব্রতাদি মাঙ্গলিক এবং আধ্যাত্মিক কর্মে সর্বদা ব্যবহার করে থাকে। সেই পবিত্র চিহ্নটি হলো 'পুত্তলিকা' বা 'পুত্তলি' চিহ্ন। সহজ ভাষায় বললে, পুতুলের মত দেখতে পুত্তলিকা চিহ্ন বলা হয়। বাংলার সকল পূজা সহ আধ্যাত্মিক কর্মে ঘটের বহিরাংশে এই পুত্তলিকা চিহ্নটি আঁকা হয়। ঘট যেহেতু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়।তাই ব্রহ্মাণ্ডের নিমিত্তকারণ সৃষ্টিকর্তার প্রতীক হিসেবে চিহ্নটি ঘটের উপরে দেয়া হয়। দেবীভাগবতে পুত্তলিকা চিহ্নে দেবী ষষ্ঠীকে পূজা করতে বলা হয়েছে।
ভিত্ত্যাং পুত্তলিকাং কৃত্বা পূজয়েদ্বা বিচক্ষণঃ৷
ষষ্ঠাংশাং প্রকৃতেঃ শুদ্ধাং প্রতিষ্ঠাপ্য চ সুপ্রভাম্ ॥
(দেবীভাগবত: নবমস্কন্ধ,৪৬.৫০)
"প্রকৃতির ষষ্ঠাংশরূপিণী, পবিত্রা, সুপ্রতিষ্ঠা এবং অনন্তপ্রভাযুক্ত ষষ্ঠী দেবীকে ভিত্তিতে পুত্তলিকা চিত্রিত করে পূজা করবে।"
পুত্তলিকাকে চিহ্নকে প্রকৃতি শক্তি হিসেবে 'লজ্জাগৌরী' বা প্রসবরতা নারীর প্রতীকরূপে কল্পনা করা হয়।নারীর যে মুহূর্তটি অস্তিত্বের ধারক, বাহক, সেই সন্তান প্রসবকালীন মুহূর্তটির প্রতীক লজ্জাগৌরী। মাতৃ উপাসক বাঙালির প্রাচীনকাল থেকেই প্রসবরতা মাতৃকা চিহ্নসহ বিবিধ মাতৃকা চিহ্ন অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে ব্যবহার করা হত। কামাখ্যা দেবী এবং কামরূপে অবস্থিত দেবীর মন্দির এর বড় দৃষ্টান্ত। আজও বঙ্গ এবং আসামে সৃষ্টির প্রতীকে পূজিত দেবী কামাখ্যা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। বঙ্গদেশে প্রাপ্ত প্রাচীন লজ্জাগৌরী বা পুত্তলিকা মাতৃকা চিহ্নে দেখা যায়, দেবী দুই পা ভাঁজ করে প্রসবরতা অবস্থায় অধিষ্ঠিতা। এবং সাথে দুইহাতে জগতকে ধারণ করে আছেন।সুন্দরবনে প্রাপ্ত গঙ্গারিডি যুগের একটি বসুন্ধরা মাতৃকা বা লজ্জাগৌরীর এমনি মূর্তি পাওয়া গেছে। লজ্জাগৌরী বা পুত্তলিকা মাতৃকার পাথরের দেয়ালে খোদিত একটি প্রাচীন মূর্তি পাওয়া যায় পশ্চিমবঙ্গের আদিনা মসজিদে। আদিনা মসজিদ পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার পাণ্ডুয়াতে অবস্থিত। মসজিদটি কেবল বাংলায়ই নয়, গোটা উপমহাদেশের অন্যতম বৃহত্তম মসজিদ। এর পেছনের দেয়ালে প্রাপ্ত একটি শিলালিপি অনুসারে এটি ১৩৭৩ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকান্দর শাহ কর্তৃক নির্মিত হয়েছে।তবে ভারতীয় পুরাতত্ব সর্বেক্ষণের মতে ১৩৬৪ থেকে ১৩৭৪ সালে এটি নির্মিত হয়। মসজিদটি যে এক বা একাধিক মন্দির ধংস করে সেই ভিত্তির উপরেই সম্প্রসারিত হয়েছে এটা একরকম সুস্পষ্ট। কালো পাথরের উপরে টেরাকোটার কাজে দুই রকমের স্থাপত্যশৈলী দেখা যায়। এ দুই প্রকারের এবং দুই সময়ের নির্মাণশৈলী তুর্কি-আরবীয় স্থাপত্যশৈলী এবং এর পূর্বতন হিন্দু স্থাপত্যশৈলীর স্বতন্ত্রতাকে দৃশ্যমানভাবে চিহ্নিত করে।প্রাচীন অংশ, অর্থাৎ কালো পাথরের অংশে নৃত্যরত গণেশমূর্তি, নৃত্যরত গন্ধর্বমূর্তি, কীর্তিমুখ ইত্যাদি মূর্তিসহ পবিত্র স্বস্তিকা এবং পুত্তলিকা চিহ্নের ব্যবহার আজও দেখা যায় মসজিদটিতে। বাঙালির স্বস্তিকা চিহ্ন হিসেবে পরিচিত পুত্তলিকা মাতৃকা চিহ্নের ব্যাপক ব্যবহার আদিনায় রয়েছে। বাঙালির সকল মঙ্গলঘটে অঙ্কিত থাকে পুত্তলিকা চিহ্ন। পুত্তলিকা চিহ্ন যে বর্তমানকালের মত প্রাচীনকালেও বঙ্গদেশের মন্দির, গৃহসহ সর্বত্রই ব্যবহৃত হত; এ বিষয়টি সুনির্দিষ্ট পুরাতাত্ত্বিক পাথুরে প্রমাণ এটি।লজ্জাগৌরীরূপা মাতৃকা শুধু বঙ্গ বা আসাম নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানেই দেখা যায়।দাক্ষিণ ভারতেও প্রাচীন মন্দিরে এ মূর্তি পাওয়া যায়।বাদামীর লজ্জাগৌরী মন্দির অন্যতম।পুত্তলিকা মাতৃকা শক্তির প্রতীক।বাঙালির জীবনে যেহেতু মাতৃকা উপাসনার একটি অনন্য স্বতন্ত্রতা রয়েছে, তাই বাঙালির পূজার ঘটে ঘটে মাতৃকা শক্তির প্রাচীন প্রতীকটি সর্বত্রই দেখা যায়।এই প্রতীকটিকে পৃথিবীর স্বরূপ হিসেবেও কল্পনা করা হয়।
সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ যেকোন দেবদেবী পূজার সময়ে পরমেশ্বরের সাকার স্বরূপকে যেমন পূজা করে; তেমনি নিরাকার স্বরূপকেও পূজা করেন। তাই প্রত্যেক পূজার মধ্যেই নিরাকার মানসপূজা এবং ঘটস্থাপন একান্ত আবশ্যক। ঘটস্থাপন ছাড়া পূজা অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়। সকল পূজাতেই দেবতাদের ঘটে আহ্বান করে পূজা করা হয়।এ ঘটের মধ্যে পঞ্চশস্য, পঞ্চগুড়ি,পঞ্চপল্লব, পঞ্চরত্ন, জল,মাটি, ডাব,বস্ত্র,কাণ্ডকাঠি ইত্যাদি বিবিধ উপাদান ব্যবহৃত হয়। ঘটকে আমাদের দেহের সাথে, জগতের সাথে তুলনা করা হয়। ঘটে পঞ্চপল্লব দিতে হয়। এ পঞ্চপল্লব হলো, ক্ষিতি , অপ , তেজ , মরুৎ , ব্যোম এ পঞ্চমহাভূতের প্রতীক। ঘটে দেয়া প্রত্যেকটি উপাদান অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, যা দেহতত্ত্বের সাথে এবং সাধন জগতের সাথে সম্পর্কিত। ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক হিসেবে যেহেতু ঘটকে কল্পনা করা হয়। তাই সেই ব্রহ্মাণ্ডের অধিশ্বর পরমেশ্বরকে লাল সিন্দুর দিয়ে অঙ্কিত করে দেয়া হয়। পরমেশ্বরের প্রতীক সেই সিন্দুরমূর্তিটিকে বাঙালিরা পুত্তলিকা নামে পূজা করে। গাছের মত আকৃতি হওয়ার অনেকে পুত্তলিকাকে গাছঠাকুরও বলে। পুত্তলিকার দুই হাত এবং দুইপা একই পরিমাপে উপরে এবং নিচে অবস্থিত।
দেখলে মনে হয় বুঝি নৃত্য করছে। পুত্তলিকাকে পরমেশ্বরের জগত পালনের রূপ নারায়ণ হিসেবে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ নারায়ণ রূপে জগতকে পালন করছেন, তেমনি পুত্তলিকা নারায়ণ হয়ে প্রত্যেকটি পূজার ঘটে তিনিই বিরাজিত হয়ে আছেন। তবে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের পুত্তলিকা চিহ্ন একটু আলাদা। সেখানে পুত্তলিকাকে নারায়ণের অভিন্ন শক্তি লক্ষ্মী হিসেবে পূজা করা হয়। বঙ্গের সকল পুত্তলিকা চিহ্নের দুইহাত উপরে থাকে। কিন্তু বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের পুত্তলিকা চিহ্নের হাত নিচের দিকে থাকে। তাদের বিশ্বাস, লক্ষ্মীর যদি উপরে দিকে থাকে, তবে সে ধনসম্পত্তি কি করে প্রদান করবেন? এই বিশ্বাস থেকেই বঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলের পুত্তলিকা চিহ্নটি একটু ব্যতিক্রমী। যেন লক্ষ্মীরূপে সে দুহাত দিয়ে ধনসম্পত্তি প্রদান করছে।
পূজার ঘটে পুত্তলিকা চিহ্নের নিচে পাঁচটি সিন্দুরের গোলাকার ফোঁটা আঁকা হয়। এই ফোঁটাগুলো সাকারভাবে ঈশ্বর উপাসনার শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য এবং বৈষ্ণব এ পঞ্চমতের প্রতীক। একই পরমেশ্বরকে সাকাররূপে পঞ্চমতে এবং কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি, যোগ এবং তন্ত্র এ পঞ্চপথে উপাসনা করি। তিনি বহু নন, তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। বাঙালি সংস্কৃতির প্রধানতম প্রতীকী আইকনে পরিণত হয়েছে পুত্তলিকা চিহ্নটি।বাঙালির নববর্ষ সহ সকল সার্বজনীন উৎসবে, পার্বণে ব্যবহৃত হয় চিহ্নটি। পুত্তলিকা চিহ্নটি পূজার সময়ে ঘটে ব্যবহৃত হয় একথা পূর্বেই বলা হয়েছে। এছাড়া প্রত্যেকটি বাঙালি হিন্দু পরিবারে ঘরের দরজায়, চাল রাখার পাত্রে, ধানের গোলায়, গরুর ঘরে, পূজার আসনে সহ বিবিধ স্থানে শুভ এবং মঙ্গলের স্বরূপ হিসেবে চিহ্নটি আজও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এককথায় বলতে গেলে, পুত্তলি বা পুত্তলিকা চিহ্নটি বাঙালির শাশ্বত সংস্কৃতির অদ্বিতীয় প্রতীক। তাই প্রতীকটি গর্বের এবং স্বাভিমানের।
---------------------------
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী,
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
0 মন্তব্যসমূহ