যে কোন উঠতি বয়সের তরুণ তরুণী যারা প্রগতিশীল মুক্তচিন্তার অনুরাগী তাদের কাছে রাহুল সাংকৃত্যায়নের বই একটি কমন বিষয়। রাহুল সাংকৃত্যায়নের পান্ডিত্য নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু তার ‘ইসলাম ধর্মের রূপরেখা’ বইটি নিয়ে আমাকে কথা বলতেই হচ্ছে। আমি যে বলি মার্কসবাদীরা আমাদের অনেক ক্ষতি করে ফেলেছে, তার আরো একটি প্রমাণ এখানে দেখাবো।
‘ইসলাম ধর্মের রূপরেখা’ বইতে রাহুল সাংকৃত্যায়ন শুরুতেই বলেছেন শতাব্দীর পর শতাব্দী হিন্দু মুসলমান এই দেশে পাশাপাশি বসবাস করার পরও কেউ কারোর সম্পর্কে কিছু জানে না। এই না জানার কারণে তাদের মধ্যে সদ্ভাব জন্মেনি। তিনি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে সংস্কৃতি ও হিন্দি ভাষায় বই লিখেছেন হিন্দুদের ইসলাম শিক্ষা দেয়ার জন্য। তিনি হিন্দু থেকে বৌদ্ধ হোন। বৌদ্ধ থেকে মার্কসবাদী হোন। লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতাও করেছিলেন কিছুদিন। প্রথম জীবনে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ছিলেন, গান্ধিজির অনুসারী ছিলেন, জেল খেটেছেন। পালি ও সিংহল ভাষা শিখে বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘রাহুল সাংকৃত্যায়ন’। তার পূর্বনাম ছিলো ‘কেদারনাথ পান্ডে’। পরবর্তীকালে তিনি মার্কসবাদী হয়ে উঠেন। তাকে একজন পন্ডিত হিসেবে একবাক্যে সকলেই মেনে নেন। কিন্তু তার ‘ইসলাম ধর্মের রূপরেখায়’ তিনি যেসব মন্তব্য ও বিশ্লেষণ করেছেন তাতে এই বইয়ের নিরিখে তাকে করুণাই করতে হয়! ইসলাম ধর্মকে তিনি যথাসাধ্য মহান বানাতে গিয়ে এড়িয়ে গিয়েছেন অনেক কিছু। তিনি হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য তৈরির মানসে নাকি এই বই লিখেছেন বলে দাবী করেছেন। কিন্তু বইয়ের ‘মূর্তি পুজা’ অংশে তিনি মূর্তি পুজাকে কুরআনের দৃষ্টিতে “অশুভ’ কাজ বলেছেন। তো, কেমন করে এই দুই সম্প্রদায়ের মিলন হবে যেখানে একজনের প্রার্থনাকে অন্যজন ‘অশুভ’ মনে করে? পৃথিবীর এমন ধার্মিকদের অভাব নেই যারা প্রার্থনাকে মন্দ বলে না। সেটা তার নিজ সম্প্রদায়ের বাইরে হলেও। কিন্তু এই একটি সম্প্রদায় পৌত্তলিকদের প্রার্থনাকে অশুভ মনে করে! কি করে রাহুল সাংকৃত্যায়ন তার বই পড়িয়ে হিন্দুদের এটা বুঝাবেন তোমার প্রতিবেশী মুসলমানদের একটি মহান ধর্ম আছে যা তাদেরকে শেখাচ্ছে ‘মূর্তিপুজা অশুভ কাজ’!
রাহুল সাংকৃত্যায়নের বইয়ের রিভিউ লিখতে বসিনি আমি। যে কেউ বইটি পড়ে দেখতে পারেন। আমি কেবল সামান্য কিছু অংশ বলে লেখটা শেষ করতে চাই। এই বইতে ইসলামের প্রশংসা করা হয়েছে যে আরবে যেকালে পুরুষদের একাধিক বিয়ের রীতি ছিলো সেখানে ইসলাম পুরুষকে মাত্র চারটি বিয়ে বেধে দিয়ে চরমভাবে আটকীয়ে দিয়েছে। এই রকম যুক্তি হরহামেশা আমরা ব্লগে পেতাম ইসলামিস্টদের কাছ থেকে। রাহুল সাংকৃত্যায়ন এতখানি ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন? তিনি কি জানতেন না, ইসলাম একত্রে চারটি স্ত্রী রাখতে বলেছে, তার মানে এটা নয় চারটির পর আর বিয়ে করা যাবে না। কেউ চাইলে তার চারটি স্ত্রীকে তালাক দিয়ে আবার চারটি স্ত্রী নিতে পারবে! এই অপশনে নবীর নাতি ইমাম হাসান আশিটি পর্যন্ত বিয়ে করেছিলেন। তিনি বিয়ে করতেন আর বাসরঘর করেই তালাক দিতেন। তালাক দেয়ার জন্যও কো্ন পুরুষকে কারণ উল্লেখ করতে হয় না। এভাবে একজন মুসলিম পুরুষ জীবনে হাজার হাজার বিয়ে করতে পারেন তাতে তাকে আল্লার কাছে কোন কৌফিয়ত দিতে হবে না। এছাড়া হেরেমে যে যৌনদাসী থাকবে যাদের সঙ্গে বিয়ে ছাড়া সংগম করা যাবে সেকথা রাহুল সাংকৃত্যায়ন এড়িয়ে গেছেন। রাহুল সাংকৃত্যায়ন গণিমের মাল, ডান হাতের অধিকার হয়ে অমুসলিম নারীরা যুদ্ধের মাধ্যমে দাসে পরিণত হওয়ার বিষয়গুলি চেপে গেছেন!
রাহুল সাংকৃত্যায়ন ইসলামে নারীর পর্দার বিষয়ে শুরুতে বলেছেন কুরআনের নারী বিষয়ে বিধি বিধানগুলিকে আমাদের সেকালের বাস্তবতার নিরিখে বিবেচনা করতে হবে। তিনি বলছেন তা না হলে আমরা কুরআনের প্রতি অবিচার করব! একথা কি মনু সহিংতার বেলায় ভারতের মার্কসবাদীরা বলেছেন? মনু সহিংতায় নারীদের প্রতি যে ন্যাক্কারজনক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাকে কি খন্ডন করতে গিয়ে তারা বলেছেন কয়েক হাজার বছর আগের বাস্তবতা মাথায় রেখেই আমাদের মনু সহিংতাকে বুঝতে হবে না হলে মনু সহিংতার বিষয়ে আমরা অন্যায় করব? না, মার্কসবাদীরা সেটা করেননি। রাহুল সাংকৃত্যায়ন ইসলামে নারীদের প্রতি সদয় হওয়ার বিষয়গুলি তুলে ধরেছেন রীতিমত চালাকি করে। এটা ইসলাম না জানা হিন্দুদের খাওয়ানো সম্ভব কিন্তু ইসলাম জানা কোন এক্স-মুসলিম মাত্রই সে চালাকি ধরে ফেলবে। কুরআন হাদিস যদি বলে ‘তোমরা নারীদের মুখমন্ডলে আঘাত করো না’ সেটাকে কি পজেটিভভাবে তুলে ধরব যেখানে মারধর করাটাকে জায়েজ করা হয়েছে? কুরআন অবাধ্য স্ত্রীকে গায়ে হাত তুলতে নির্দেশ দিয়েছে। এটাকে জাকির নায়েক তার লেকচারে রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতই লঘু করে দাবী করেছিলেন একটা টুথব্রাশের সাইজের লাঠি দিয়ে আল্লাহ অবাধ্য নারীদের মারতে বলেছেন! একটা টুথব্রাশ এত ছোট সেটা দিয়ে মারলে কি এমন আর ব্যথা লাগবে! কিন্তু ওটা জাকিরের পশ্চাদেশ দিয়ে ঢুকিয়ে দিলে বেশ লাগবে! পাল্টা যুক্তি এমনই হওয়া উচিত। মুখমন্ডলে না মেরে নারীদের শরীরের অন্যত্র মারতে বলা নিশ্চয় খুবই উদারতার একটি নির্দশন?
‘ইসলাম ধর্মের রূপরেখা’ বইতে রাহুল সাংকৃত্যায়ন দাবী করেছেন নারীদের পর্দা বিধানকে মুসলমান পুরুষরা নিজেরা বাড়িয়ে বাড়িয়ে বোরখা টোরখা বানিয়েছে। কুরআন নাকি পশ্চিমা নারীদের শীতের মধ্যেও বক্ষ বের করর মত বেহায়াপণা রুখতেই পর্দার কথা বলেছে। অথচ হাজার হাজার হাদিস বলছে নারীদের পুরো মুখমন্ডল ঢেকে রাখতে হবে। তাদেরকে মাহরাম ছাড়া বের হওয়া নিষিদ্ধ করেছে। নারী ঘরের বাইরে যেতে পারবে না পিতা, ভাই, স্বামীকে ছাড়! এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মুসলিম নারীদের এই পর্দার বিধানের কারণে কতখানি ভুগতে হয় তা রাহুল সাংকৃত্যায়নের বইয়ে সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
রাহুল সাংকৃত্যায়ন কতখানি ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ছিলেন তার একটি উদাহরণ দেই। তিনি ইসলামে নারী পুরুষের সমতার উদাহরণ দিতে কুরআন থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন- ‘স্ত্রীরা তোমাদের আবরণ, তোমরা তাদের আবরণ’। এটা নাকি কুরআনে বলা হয়েছে পুরুষ নারী একে অপরের উপর নির্ভরশীল বুঝানো হয়েছে। অথচ আমরা জানি কুরআনের এই আয়াত নাযিল হয়েছিলো রোজার সময় সেক্স করা যাবে কিনা সেরকম বিতর্ক উঠার পর। অনেক সাহাবী মনে করেছিলো রোজার একমাস স্ত্রী সহবাস মনে হয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা শুনে মুহাম্মদ কুরআনের আয়াত নাযিল করে জানায় ইফতার থেকে সেহরির আগ পর্যন্ত তারা সেক্স করতে পারবে শুধু রোজা রাখা অবস্থায় সেটা করা যাবে না। সেই আয়াতেই বলা হয়েছে এটা দোষের নয়। আল্লাহ এতখানি কঠর নয় যে একমাস সেক্স বন্ধ করে দিবেন। কারণ তোমরা একে অপরের আবরণের মত…। এখানে কোথাও নারী পুরুষের সমান বলা হয়নি! বরং কুরআনে নারীর উপরে পুরুষকে স্থান দেয়ার যে পরিস্কার আয়াত আছে সেটা রাহুল সাংকৃত্যায়ন নিজেও স্বীকার করেছেন। সঙ্গে এটাও বলেছেন, এসব সেকালের পেক্ষিতে আমাদের বিবেচনা করতে হবে! কতখানি তোষণ চিন্তা করেন! যে বইটিকে আজো মুসলমানরা তাদের জীবনবিধান মনে করে, যে বইটি কোটি কোটি মুসলিম নারীদের এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে তার ইমেজ বাঁচাতে তিনি বলছেন এটাকে সেকালের নিরিখে বিবেচনা করতে হবে! এটা কি যৌক্তিক দাবী? সমকালেও যার আবেদন আছে তাকে কি করে আমরা সেকালের নিরিখে বিবেচনা করব?
একটি অপ্রয়োজনীয় ও বিভ্রান্তিকর বই লিখেছেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন এটুকুই শেষে বলতে পারি।
প্রথম প্রকাশ: সুষুপ্ত পাঠক
0 মন্তব্যসমূহ