লেখক অঞ্জন আচার্যের ছেলের প্রতি ইসলামী আক্রমণ

লেখক অঞ্জন আচার্যের ছেলের প্রতি ইসলামী আক্রমণ

৭ সেপ্টেম্বর ২০২২

গদ্য যখন স্কুল থেকে ফেরে, আমি তখন অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিই। ফেরার পর প্রতিদিনই দরজায় কলিংবেল বাজায় সে। বেলের শব্দ শোনেই বুঝতে পারি, গদ্য এসেছে। কারণ, তার বেল চাপা অন্যদের মতো নয়। একাধিকবার বাজায়। বাচ্চারা যেমনটা করে। আজ বেল বাজার পর দরজার পিপ হোলে চোখ রাখতে হলো। দেখি, ওপাশে গদ্য দাঁড়ানো। মনে খটকা জাগলো। বড়দের মতো করে এক বেল তো ও চাপে না। দরজা খুলতেই মন খারাপের মেঘ নিয়ে ঘরে ঢুকলো সে। এসেই ঘরের ফ্লোরে শুয়ে পড়ে। বাইরে থেকে ফেরার পর সাধারণত ও নিজ থেকে হাত-মুখ ধোয়। আজ ফ্রেশ হতে বললাম। কথায় কোনো সায় নেই। জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছে? কোনো উত্তর নেই। তারপর সময় যেতে যেতে একসময় বলল, তার ক্লাসের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু সাইফ তাকে আজ মেরেছে। শিশুদের স্কুলে একে-অপরে মারামারি করা নতুন কিছু নয়। ওটা তাদের খেলার অংশ বলা যায়। এমন কাণ্ড অনেক দিন হয়েছে। কিন্তু আজ কেমন জানি লাগে গদ্যকে। বললাম, কেন মেরেছে? গলায় কষ্টের স্বর টেনে বলল, সাইফ তাকে বলেছে, 


“তুমি হিন্দু, হিন্দুরা খারাপ, তারা পাপী। তুমি মুসলমান হয়ে যাও।” 


এ কথার প্রতিত্তোরে গদ্য বলেছে, 


“না, আমি মুসলমান হব না।”


এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে গদ্যকে সাইফ কিল-ঘুষি দিতে শুরু করে, তাকে মুসলমান হতে জোরজবরদস্তি শুরু করে। আঘাত পেয়ে এক পর্যায়ে গদ্য ক্লাসে কান্না করে ওঠে। ক্লাস টিচার এসে জানতে চায়, কী হয়েছে? কাঁদতে কাঁদতেই গদ্য সব খুলে বলে তার টিচারকে। অথচ তার এই বন্ধুটির জন্য গতরাতে আনা মিষ্টি আঁখটি নিজে না খেয়ে কেটে টুকরো করে নিয়ে গিয়েছিল একসঙ্গে খাবে বলে। এর আগে তাকে গিফট করা চকলেট, লিচু, আম, জন্মদিনের কেক, টিফিরের জন্য ঘরে বানানো খাবার, বিশেষ করে চিকেন আইটেম—প্রায় প্রতিদিনই নিজের পছন্দের কিছু না কিছু খাবার সাইফের জন্য নিয়ে যায় গদ্য। আজ সে বলছে, এখন থেকে সে আর সাইফের জন্য কিছু নেবে না। সাইফ তাকে মেরেছে। কিন্তু এই গদ্যই আজকের আগ পর্যন্ত ‘সাইফ’ বলতে ছিল অজ্ঞান।


পশ্চিম ধানমণ্ডির বেসরকারি একটি স্কুলে ক্লাস টু-তে পড়ে গদ্য। বয়স ৮ বছর। সাইফও একই ক্লাসে পড়ে। তার বয়সও একই। সাইফের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ বা বক্তব্য নেই। ও তো শিশু। কিন্তু কথা হলো, এই শিক্ষা তাকে দিলো কে? কেন এইটুকু বয়সেই তার কোমল মগজে কাজ করলো, অন্য ধর্ম খারাপ, সেই সঙ্গে ধর্মান্তর করার চেতনা? কে তাকে শেখালো অন্য ধর্মের প্রতি এমন ঘৃণা ও বিদ্বেষ? কোমলমতি একটি শিশুর মুখে এমন ধর্মান্ধ কথা কে শিখিয়েছে তাকে? আমাদেরও তো ছেলেবেলা ছিল। আমাদের পাড়াটি হিন্দু অধ্যুষিত হলেও সেখানে বাস ছিল কয়েকটি মুসলিম পরিবারের। টিটু, টিপু, অমি আমাদের ছেলেবেলার বন্ধু। প্রতি ঈদের সকালে নতুন জামা-কাপড় পরে টিপুদের বাসায় সেমাই খাওয়া, অমিদের বাসায় পোলাও-মাংস খাওয়া ছিল ধরাবাঁধা। প্রতি দুর্গাপূজায় বা শ্যামাপূজায় টিপু আমাদের সঙ্গে নতুন জামা-কাপড় পরে পূজার মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়াতো। আমরা কখনও ধর্ম দিয়ে একে অপরকে চিনিনি। এমনকি ধর্ম বিষয়টি কখনও আমাদের মাথায় কাজও করেনি। তবে আজ কেন গদ্যকে কাঁদতে হলো? তার প্রিয়তম বন্ধু সাইফের মুখে এ কথা কেন তাকে শুনতে হলো? আগামীকাল আবার গদ্য স্কুলে যাবে, সাইফের সঙ্গে দেখাও হবে। জানি না, কী হবে? কিন্তু এমন অঙ্কুরেই ধর্ম এসে তাদের নির্মল বন্ধুত্বের মাঝে দেয়াল তুলে দেবে, তা কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি গদ্য, আমিও ভাবতে পারছি না।



https://www.facebook.com/anjon.acharya/posts/pfbid0uc8nyZ4WTSCFpkdK3SoYX8PXkDg3TrDNirpJkkr44UT8ta2YuEMdgCjcZPG5vvbTl

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ