মা দুর্গার উপাসনা কত প্রাচীন? - তমাল দাশগুপ্ত

পালযুগের দুর্গা প্রতিমা
পালযুগের দুর্গা প্রতিমা


৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২


১. জগৎপ্রসবিনী জগদকারণ জগন্মাতা বা পৃথিবীমাতার আদি মূর্তি অন্তত ৩০০০০ বছর পুরোনো, প্রস্তর যুগের। ইনিই অনেক সহস্র বছর পরে তন্ত্রের জগদকারণ। গুগল করুন Venus of Willendorf


Venus of Willendorf
Venus of Willendorf # imagesource

এই মাতৃমূর্তি পৃথুলা, গর্ভবতী। মূর্তিটি সিঁদুরচর্চিত।


২. আদি সিংহবাহিনী মূর্তি নব্য প্রস্তর যুগের। আনাতোলিয়া অঞ্চলে পাওয়া গেছে। ইনিও পৃথুলা এবং দুটি সিংহ পরিবেষ্টিত সিংহাসনে উপবিষ্ট। তন্ত্রের ইড়া পিঙ্গলার মধ্যে সুষুম্নার প্রতীক এই মূর্তি। 

Seated Woman of Çatalhöyük
Seated Woman of Çatalhöyük # imagesource


এই মূর্তির চিত্র দেখতে গুগল করুন Seated Woman of Çatalhöyük


৩. সাড়ে চার হাজার বছর আগে পরিণত হরপ্পা সভ্যতার ব্যাঘ্রধারিণী মূর্তি। দুদিকে দুটি বাঘকে টুঁটি চেপে শমিত করছেন। এঁর মাথায় বিচ্ছুরিত আভার মত চুলের কাঁটা। প্রসঙ্গত ঊষা হরপ্পা সভ্যতার মাতৃকা ছিলেন (ডি ডি কোসাম্বি) , তাঁর উপাসনা ও বোধন শরৎকালে হত (সুকুমার সেন) এবং ঊষাকে একটি বৈদিক স্তোত্রে দশভুজা বলা হয়েছে।


প্রসঙ্গত এই মূর্তির নানা ভ্যারিয়েন্ট প্রাচীন যুগের মিশর থেকে সুমের অবধি পাওয়া গেছে। হরপ্পা সভ্যতায় যিনি মধ্যিখানে একজন মাতৃকা, দুদিকে দুটি বাঘ, তিনিই মিশরে প্রিস্ট কিং, দুদিকে দুটি সিংহ। 


তন্ত্র প্রথম বিশ্বজনীন ধর্ম।


৪. বাইশ শো বছর আগে চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গারিডাই সভ্যতায় চার সন্তানসহ পূজিত হতেন এক মাতৃমূর্তি। তাঁর মাথার পেছনে দশটি চুলের কাঁটা দশটি আয়ুধ। তাঁকে দশায়ুধা বলি। এঁর পুজোয় আজকের মতোই ছাগবলি হত, এবং ঢাক বাজত। 


প্রসঙ্গত সাড়ে চার হাজার বছর আগে হরপ্পা সভ্যতায় মহিষমেধ প্ৰচলিত ছিল। এছাড়া ছাগবলি হত। দুটিই হরপ্পা সভ্যতার তন্ত্রাশ্রয়ী মাতৃকা উপাসনার হলমার্ক। 


আজ সন্ধিপূজায় আমরা সেই সুপ্রাচীন প্রথাকে অনুসরণ করি।


৫. মোটামুটি খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতক অবধি মহিষমর্দিনী মূর্তি পাওয়া যাচ্ছে নিয়মিত। পেজে আগে অনেকবার ছবি দিয়েছি। এখানে মা স্বহস্তে মহিষটিকে নিহত করছেন। প্রসঙ্গত মহাভারতের দুর্গাস্তব, যার রচনাকাল খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যে, মা দুর্গাকে মহিষসৃকপ্রিয়ে বলে সম্বোধন করে অর্থাৎ মহিষের রক্ত যাঁর প্রিয়। নিঃসন্দেহে মা দুর্গা বলিপ্রিয়া।


৬. কুষাণ যুগ থেকে নিয়মিত সিংহবাহিনী মূর্তি পাওয়া যাচ্ছে। ছবি দিয়েছি আগে এই পেজেই। ষষ্ঠ শতকে গৌড়ের উত্থানের সঙ্গে শ্রীশ্রীচণ্ডী (মহিষটি এখানে মহিষাসুর রূপে বিবর্তিত, anthropomorphism ঘটার ফলে) রচনার যোগসূত্র আছে। এই সময় থেকেই তন্ত্রধর্মের ইতিহাস নথিবদ্ধ। তন্ত্রকে গৌড়ে প্রকাশিতা বিদ্যা বলা হয়। আসলে তন্ত্র আবহমান, সুপ্রাচীন, কিন্তু বাঙালি জাতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গেই তার পুনর্জাগরণ ও পুনঃপ্রকাশ ঘটে। বস্তুত এ দুটি পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। তন্ত্রের নবজাগরণ ছাড়া বাঙালির নবজাগরণ হয় না, এবং বাঙালির নবজাগরণ ব্যতীত তন্ত্রের পুনরুত্থান ঘটে না।


৭. পালযুগে এসে দেখি মা দুর্গা নানা রূপে বাঙালির মধ্যে ক্রমে প্রবল। গোপাল ছিলেন চুন্দার উপাসক। চুন্দা সম্পর্কে পেজে আগে লিখেছি। পালযুগে অষ্টম নবম শতক থেকেই বাংলায় বর্তমান আকারে সিংহবাহিনী মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি পাওয়া যাচ্ছে এবং দশম শতকে এসে দেখি আজকের মতোই দশভুজা মা দুর্গা। এই সময় সম্রাট মহীপাল ভবানী মন্দির স্থাপনা করেন। দ্বাদশ শতকে সম্রাট রামপালের সময় শরৎকালে উমা পুজোয় মহা ধুমধাম হচ্ছে গৌড়ে। এরপর সেনরা মূলত শাক্ত ছিলেন, দুর্গাপূজায় উৎসাহ দিতেন বলা বাহুল্য।


ইসলামিক হানাদারির পরে মধ্যযুগে ১৪১৭-১৯ সালে প্রথম যে মুদ্রা কোনও বাঙালি সম্রাট প্রচলন করেন, সেখানে চণ্ডীচরণপরায়ণ লিখিত আছে (দনুজমর্দন দেব ও মহেন্দ্র দেব)। এর অর্ধ শতক পরে তাহেরপুরের রাজা (বারো ভুঁইয়ার অন্যতম) কংসনারায়ণ দুর্গাপুজো পুনরায় মহা ধুমধামের সঙ্গে শুরু করেন, তবে ইতিহাসবিস্মৃত অন্ধকার মধ্যযুগে ও পরবর্তী আধুনিক যুগে অনেকেই পুরোনো শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন, ফলে সেটাই প্রথম দুর্গাপুজো বলে নিজেদের অজ্ঞানতার প্রকাশ ঘটান। বাংলায় ও বিশ্বে নথিবদ্ধ পাথুরে প্রমাণ অনুযায়ী দুর্গাপুজো বহু প্রাচীন। প্রসঙ্গত এই কংসনারায়ণের সময়েই কৃত্তিবাস তাঁর বাংলা রামায়ণে অকাল বোধনের কাহিনী প্রচার করেন, যা মূল বাল্মীকি রামায়ণে নেই। 


শরৎকালে মায়ের বোধন অতি প্রাচীন। শারদীয়া দুর্গাপুজো বেশি প্রাচীন, বাসন্তী পূজার থেকেও প্রাচীন, সুকুমার সেন দ্রষ্টব্য। এবং ষষ্ঠ শতকের শ্রীশ্রীচণ্ডীতেও শরৎকালে দুর্গাপুজোর উল্লেখ আছে।


যারা বলেন যে বাঙালির শারদোৎসব আর্য আগ্রাসনের প্রতীক এবং মহিষাসুর একজন শহীদ, পৃথিবীর হিন্দুদের বৃহত্তম উৎসব এবং বাঙালির শ্রেষ্ঠতম উৎসব দুর্গাপুজো সম্পর্কে জঘন্য মিথ্যাচারিতা ও কালিমা লেপনের অপরাধে এদের কারাদণ্ড হওয়া উচিত। এবং পলাশীর যুদ্ধের পরে কিছু রাজা জমিদার প্রথম দুর্গাপুজো করেন, তার আগে ছিল না, এরকম যারা বলেন, তাদের মাথায় বজ্রাঘাত হোক, তারা ভয়ানক মিথ্যা বলছেন। কলকাতায় চিৎপুরে চিত্তেশ্বরী দুর্গাই তো পলাশীর দেড়শো বছর আগে থেকে পূজিত, এছাড়া সাবর্ণদের বাড়ির পুজো।


সন্দেহ নেই, অত্যাচারী মুসলমান শাসক সিরাজের পতনে আনন্দ করতে কৃষ্ণচন্দ্র ও নবকৃষ্ণ নতুন করে ধুমধামের সঙ্গে দুর্গাপুজো করেন। কিন্তু তার আগে দুর্গাপুজো ছিল না? এমন মিথ্যাভাষণ ও নিজের জাতির ইতিহাস এভাবে বিকৃত করা মহাপাপ। 


© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta 


এদের পাপের শাস্তি মহাকাল স্বয়ং দেবেন। দুর্গাপুজোর প্রকৃত ইতিহাস ছড়িয়ে দিন, আমার পেজের এই লেখা সাধ্যমত শেয়ার করুন। জয় মা দুর্গা।


দেখছেন পালযুগের দুর্গা প্রতিমা। বর্তমান অবস্থান মেট মিউজিয়াম।

জয় জয় মা।


Link


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ