ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির অধিবাসী শাহ সৈয়দ আহমদ (১৭৮৬ - ১৮১৩ খ্রি.) এবং তাঁর অনুগামীদের নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলন অচিরেই একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। সৈয়দ আহমদ বলতেন, ইংরেজ শাসনের ফলে ভারতবর্ষ ‘দার-উল-হার্ব’ বা বিধর্মীর দেশে পরিণত হয়েছে, একে ‘দার-উল-ইসলাম’ অর্থাৎ ইসলামের দেশে পরিণত করতে হবে । এই আন্দোলনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল বিধর্মী ইংরেজ শাসন উচ্ছেদ করে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
প্রায় একই সময়ে বাংলায়ও ওয়াহাবি আন্দোলন হয়েছিল। ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মীর নিশার আলি বা তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১খ্রি.) । তিনি কিছুদিন মুসলিম তীর্থস্থান মক্কায় অবস্থান করেন । সেখানেই তিনি রায়বেরিলির সৈয়দ আহমদের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । মক্কা থেকে দেশে ফিরে তিনি ওয়াহাবি আদর্শ অনুসারে ইসলাম ধর্মের সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন। তিতুমীরের লড়াই ছিল ইসলামের জন্য।
"দার-উল-হার্ব" কে "দার উল ইসলাম"-এ পরিণত করার জন্য। যা পরবর্তীকালে অক্ষয়বাবুর মতো ইতিহাসবিদদের কলমে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে বর্ণীত হয়েছিল৷ ঠিক যেমন 'খলিফা'-র মর্যাদা ও অধিকার পাওয়ার লড়াই 'খিলাফৎ আন্দোলন'-কে গান্ধীজী জুড়ে দিয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে৷
ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তিতুমীর এবং ওয়াহাবি আন্দোলন নিয়ে কী বলছেন? R C Mazumder লিখেছেন,
'ওয়াহাবি আন্দোলন কখনই জাতীয় আন্দোলন ছিল না এবং এই আন্দোলনের চরিত্র সাম্প্রদায়িকতামুক্তও ছিল না । ইংরেজ শাসনের পরিবর্তে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করাই ছিল ওয়াহাবি আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য।'
ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে ১৬ আনা বাঙালিয়ানার একটি বড় পার্থক্য হল বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হল মূর্তি পুজো৷ এবং বাঙালিরা মাতৃআরাধনা করে আসছে প্রাচীনকাল থেকেই ৷ যে দুটিই কার্যত ইসলাম অবমাননার সামিল এবং কঠোর ভাবে ব্যান করা রয়েছে ইসলামে৷ তিতুমীর বা মীর নিশার আলি একজন 'সচ্চা' মুসলমান ছিলেন৷ তাঁর লড়াই আন্দোলন সে সময় ইংরেজ শাসকদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিল এ কথা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই৷ কিন্তু একই সঙ্গে এটাও অস্বীকার করার জায়গা নেই যে একজন 'সচ্চা মুসলমান' হিসেবে তিনি মূর্তিপুজো এবং মাতৃ আরাধনার ঘোর বিরোধী ছিলেন৷ তাই তাঁর মৃত্যুর বহু বছর পর তাঁরাই নাম ও কাজ দূর্গা পুজোর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া আদপে তিতুমীরকে অপমান করা নয় কি?
বিষয়টা কিছুটা এরকম, যে এক ব্যক্তি জীবদ্দশায় সারাজীবন মূর্তিপুজো পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করল। এবার তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছবি সামনে রেখেই তাঁর নাম জুড়ে মূর্তিপুজো করছে কিছু ব্যক্তি! এতে কি সেই মৃত ব্যক্তিকে সম্মান জানানো হল? না সঠিক ভাবে মূর্তিপুজা করা হল?
শুনলাম বেলপাহাড়িতে ঠিক এই কাজটিই করছেন একদল লোক৷ সেখানে একটি দূর্গা পুজো মন্ডপের থিমে রয়েছেন তিতুমীর! কিন্তু কেন? বেলপাহাড়ির বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কিছু থিম তৈরি করা যেত না? ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধরা তিতুমীরকে অপমান না করলেই চলছিল না? না অপমান করলেই চলছিল না দূর্গা পুজোটাকে?
আমাদের সিধু-কানহো ছিল না? রাণী শিরোমণি? আমাদের না পাওয়া, আমরা লড়াই করে উঠে দাঁড়ানো, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা, শিক্ষার জন্য ছেলেমেয়েদের মাইলের পর মাইল হেঁটে যাওয়া, আমাদের বাঁদনা পরব, আমার টুসু, ঝুমুর ছিল না? নিজেদের সংস্কৃতিকে কার্যত অপমান করে দূর্গা পুজোর মতো একটি বিষয়ের সঙ্গে মশলাদার বিতর্ক জুড়ে দিয়ে ঠিক কী পেলেন এই উদ্যোক্তারা?
এ যেন কিছু অর্ধশিক্ষিতের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে বখতিয়ার খিলজির নামে ভবন তৈরির মতো...
শে খ র ভা র তী য়।।
https://www.facebook.com/Hypocritebengalibabu.in/posts/pfbid0dYZ9NvJiCXWWUyQJRWsWvKdwqCYDhx9r7ncEeRLWAtmxe845Kx5v2f9RgRM5qBd4l
0 মন্তব্যসমূহ