এবার চট্টগ্রামের স্কুলে হিজাব নিয়ে ভুয়া অভিযোগ

জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়। ছবি: নিউজবাংলা
জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়। ছবি: নিউজবাংলা

 এবার চট্টগ্রামের স্কুলে হিজাব নিয়ে ভুয়া অভিযোগ


    আরাফাত বিন হাসান আরাফাত বিন হাসান, চট্টগ্রাম ১০ এপ্রিল, ২০২২ ২২:৩৪ 


এরই মধ্যে সেই প্রধান শিক্ষককে পদত্যাগপত্র জমা দিতে বলার পর তিনি তা জমা দিয়েছেন। এখন বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ বলছে, তারা বিষয়টি নিয়ে আবার বসবে।


ঠিক যেন নওগাঁর দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের কাহিনি। হিজাব পরার কারণে মারধরের অভিযোগ তোলার পর তোলপাড়। পরে জানা যায়, স্কুলের পোশাক না পরে আসায় সেদিন মার খেয়েছে হিন্দু শিক্ষার্থী ও ছাত্ররাও।


ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ে।


স্কুলের প্রধান শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে সঠিক পোশাক পরে আসতে বলার পর কয়েকজন মেয়ে অভিযোগ তোলে, তাদের হিজাব খুলে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। মারধর করা হয়েছে। তবে পরে তদন্তে দেখা গেল, এর কিছুই হয়নি।


এক ছাত্রী লিখিত অভিযোগ তোলার পর বিষয়টি তদন্ত করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিজানুর রহমান।


নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অষ্টম শ্রেণির ওই ছাত্রীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে এসি ল্যান্ড, জোরারগঞ্জ থানার ওসি, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তারা মারধরের কোনো সত্যতা পাননি।’


স্কুলটিতে মোট ৭০টি সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। সেদিন স্কুলে যা ঘটেছিল, তার সবই সেসব ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। এর মধ্যে একটিতেও সেই মেয়েটির তোলা অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।


ক্যামেরায় দেখা গেছে, তিন ছাত্রীর সঙ্গে প্রধান শিক্ষক কথা বলেছেন। কিন্তু মারধরের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এখন অভিযোগকারী মেয়েটি বলছে, তাকে আলাদা ডেকে মারধর করা হয়েছে।


তবে এরই মধ্যে সেই প্রধান শিক্ষককে পদত্যাগপত্র জমা দিতে বলার পর তিনি তা জমা দিয়েছেন। এখন বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ বলছে, তারা বিষয়টি নিয়ে আবার বসবে।


কী ছিল অভিযোগে?


ইউএনও জানান, অভিযোগ ছিল তিন ছাত্রীর। তাদের মধ্যে দুজন অভিযোগ প্রত্যাহার করলেও একজন তার সিদ্ধান্তে এখনও অটল। তাদের অভিযোগ ছিল, পিটি শেষে স্কুলের তিন ছাত্রীকে ডেকে হিজাব খুলতে বলেন জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়া। হিজাব খুলতে অস্বীকৃতি জানানোয় মারধর করা হয়।


ইউএনওর কাছে পাঠানো দরখাস্তে ওই ছাত্রী উল্লেখ করেন, অ্যাসেম্বলির পরে তাকে প্রধান শিক্ষক সবার সামনে খোলা মাঠে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করেন। এর আগেও হিজাব পরা নিয়ে তাকে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এছাড়াও ছাত্রীদের হাফ হাতা পোশাক পরতে বাধ্য করা হচ্ছে। এতে মুসলিম ছাত্রীদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।


তদন্তে কী পাওয়া গেছে?


অভিযোগের পরদিন মিরসরাই উপজেলার এসিল্যান্ড এস এম এন জামিউল হিকমা, জোরারগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূর হোসেন মামুন এবং উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির খান ঘটনাস্থলে যান।


মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির খান বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছি। তার বাসায়ও গিয়েছিলাম। তার দাবি, পিটি সেশনের পর প্রধান শিক্ষক তাকে হিজাব পরায় মারধর এবং মানসিকভাবে হেনস্থা করেছেন।


‘আমরা সিসিটিভি ফুটেজে অ্যাসেম্বলির পর শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে ঢোকার সময় প্রধান শিক্ষককে স্কুল ড্রেসের সঙ্গে স্কার্ফ পরা তিন ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, প্রধান শিক্ষক বেশ উত্তেজিত হয়ে তাদের কিছু একটা বলেছেন।


‘প্রধান শিক্ষক আমাদের জানিয়েছেন, ওই তিন ছাত্রীকে তিনি স্কুলের ড্রেস কোডের কথা বলেছিলেন। স্কুলের বাইরে হিজাব পরে আসলেও ভেতরে অবস্থানের সময় স্কুলের ড্রেস কোড মেনে পোশাক পরার কথা বলেছিলেন।


‘সেই সিসিটিভি ফুটেজ দেখানোর পর অভিযোগকারী লামিয়া কথা পাল্টায়। সে জানায়, সে সিসিটিভি ফুটেজের তিনজনের মধ্যে ছিল না। সে একা ছিল, প্রধান শিক্ষক তাকে একা ডেকে মারধর ও হেনস্থা করেছেন।’


শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যতটুকু সত্যতা পেয়েছি, তার প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নিয়েছি। ওই ছাত্রী হিজাব পরতে পারবে বলে জানিয়ে এসেছি।’


জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়। ছবি: নিউজবাংলা

কী আছে সিসিটিভি ফুটেজে?


মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ের চারপাশে সংযুক্ত ৭০টি সিসি ক্যামেরা। ঘটনার দিন পিটি সেশনের পরের সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ এসেছে নিউজবাংলার হাতে।


ফুটেজে দেখা যায়, ২৯ মার্চ সকাল ১০টা ৫৪ মিনিটে পিটি শেষ হয়। এক মিনিট পর ছাত্রীরা স্কুল মাঠ থেকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকছে। ১০টা ৫৫ মিনিট ৩২ সেকেন্ডের সময় স্কুল ড্রেসের সঙ্গে স্কার্ফ পরা তিন ছাত্রীকে ডেকে কথা বলেন সাদা শার্ট পরা প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়া। এরপর ১০টা মিনিট ৩৪ সেকেন্ডের সময় ওই তিন ছাত্রী শ্রেণিকক্ষে চলে যায়।


সব শিক্ষার্থীর শ্রেণিকক্ষে ঢোকা শেষ হয় বেলা ১১টায়। এর দুই মিনিট পর আরেকটা ক্যামেরায় শিক্ষককে বিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকতে দেখা যায়। তিনি প্রথমে শিক্ষক মিলনায়তনে ও পরে নিজ কক্ষের দিকে যান। এ সময় তার হাতে একটি বেত ছিল।


এরপর ১১টা ৮ মিনিটে অভিযোগকারী লামিয়া আরেক ছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে শিক্ষক মিলনায়তনে গিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষক রবিউল ইসলামের কাছে যান। এক মিনিট পর শিক্ষক রবিউলকে সঙ্গে নিয়ে শ্রেণিকক্ষের সামনে যান।


শ্রেণিকক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে শিক্ষক রবিউলের মোবাইল দিয়ে লামিয়া তার কথিত চাচার সঙ্গে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেন। এই সময় রবিউল অন্য একটি শ্রেণিকক্ষে ঢোকেন। এর মধ্যে লামিয়া তার সেই কথিত চাচর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে না পেরে ১১ টা ১৩ মিনিটে ফোনটা ফেরত দিয়ে যান।


এরপর ১১ টা ১৪ মিনিট ৫৪ সেকেন্ডে শিক্ষক রবিউলে ফোনে লামিয়া সেই কথিত চাচার কল আসলে তিনি ফোনটি রিসিভ করে লামিয়াকে তার শ্রেণিকক্ষে দিয়ে আসেন। সে শ্রেণিকক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলেন। এর ঘণ্টা দুয়েক পর ১টা ২১ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে বাইরে থেকে আবার স্কুলে আসে লামিয়া। তার পেছনে তিন যুবককেও ভেতরে ঢুকতে দেখা যায়। বেলা ১টা ২৮ মিনিট ৫৪ সেকেন্ডে প্রধান শিক্ষকের অফিসে যান ওই তিন যুবক। তারা শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেন। বেলা ১টা ৩৫ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢোকেন আরও এক যুবক। তিনিই লামিয়ার কথিত চাচা মুহিব বিল্লাহ।


চার যুবককে মারমুখী ভঙ্গীতে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। এরপর ২ টা ৫৯ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের সময় প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে বের হয়ে যান তারা।


যা বললেন প্রধান শিক্ষক


প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়া বলেন, 

‘শুরুতে আমি বুঝতে পারিনি কোন ছাত্রী। পরে যখন তাকে পেলাম, তখন বুঝতে পারি তার সঙ্গে আমার দেখাই হয়নি। যে তিনজন ছাত্রীকে দেখা যাচ্ছে ফুটেজে, তাদের মধ্যে একজন অষ্টম শ্রেণির এবং বাকি দুই জন সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। অভিযোগকারী লামিয়া বিনতিহাও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। কিন্তু ওইখানে অষ্টম শ্রেণির যে ছাত্রী ছিল, তার নাম ফাতেমা তুজ জোহরা। এগুলো আসলে পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। অভিযোগে যা বলা হয়েছে তার কিছুই হয়নি।’


তিনি বলেন,

 ‘পিটির কিছুক্ষণ পর চারজন ছেলে অন্যান্য শিক্ষকসহ আমার সঙ্গে মারমুখি আচরণ করেছে। এর মধ্যে একজন মেয়ের কথিত চাচা, আরেকজন নাকি এমইএস কলেজে পড়ে। বাকি দুই জনকে আমি চিনি না।’


লামিয়ার কথিত চাচার বক্তব্য


লামিয়া যাকে চাচা উল্লেখ করেছে, তার নাম মহিব বিল্লাহ। তিনি স্কুলের কাছে একটি দোকান করেন এবং লামিয়ার দূর সম্পর্কীয় চাচা।


তিনি নিউজবাংলাকে বলেন,

 ‘তার বাবা বিদেশ থাকায় স্কুলে তার অভিবাবক আমিই। ঘটনার পর লামিয়া আমাকে ফোনে জানায় বিষয়টা। আমি গিয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছে বিষয়টি জানতে চাই। তিনি তার কথা বলেছেন। পরদিন তিনি হিজাব পরতে আর কোনো বাধা নাই বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এটা সমাধান হয়ে গেছে।’


শিক্ষকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, 

‘আমরা চার জন গিয়েছিলাম, সবাই সম্পর্কে ওর চাচা। আমরা শুধু হেড স্যারকে বিষয়টা জিজ্ঞেস করেছিলাম। আমিই কথা বলেছিলাম, বাকিরা চুপ ছিল।’


অভিযোগকারীর বক্তব্য


অভিযোগকারী লামিয়া বিনতিহা বলেন,

 ‘ওইদিন হেডস্যার অ্যাসেম্বলির পর আমাকে ডেকে হিজাব পরার কারণে মারধর করেন। পরে আমি রবিউল স্যারের কাছ থেকে ফোন নিয়ে বিষয়টি বাসায় জানাই। দুপুরে আমার চাচা এসে স্যারদের সঙ্গে কথা বলেছেন।’


সিসিটিভিতে কাউকে মারতে দেখা যায়নি জানালে সে বলে, 

‘ওই তিনজনের মধ্যে আমি ছিলাম না। আমাকে একা ডেকেছিল স্যার।’


তাহলে সিসিটিভি ফটেজে নেই কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না।’


তদন্ত করছে জেলা প্রশাসন


গত ২৯ মার্চ অভিযোগকারী শিক্ষার্থীর ইউএনওকে পাঠানো দরখাস্ত গ্রহণ করেন মিরসরাই উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) এস এম এন জামিউল হিকমা। পরদিন জোরারগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূর হোসেন মামুন এবং উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির খানসহ ঘটনাস্থলে যান।


এর মধ্যে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে লামিয়ার অভিযোগ। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধান শিক্ষককে পদত্যাগপত্র দিতে বাধ্য করে স্কুল পরিচালনা কমিটি। পরে বিষয়টি নিয়ে অধিকতর তদন্ত করতে অভ্যন্তরীণ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।


এর বাইরে অধিকতর তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষেও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (শিক্ষা) প্রধান করে অরেকটি কমিটি করা হয়।


তদন্তের বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) মো. আবু রায়হান দোলনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।


চাকরি নেই প্রধান শিক্ষকের


প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়া বলেন, 

‘ঘটনার পরদিনই তাকে পদত্যাগপত্র জমা দিতে বলেছেন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মাকসুদ চৌধুরী। তাকে ডিসি সাহেব নাকি বলেছেন পদত্যাগপত্র নিতে, তাই তিনি আমাকে বলেছেন।’


মাকসুদ চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, 

‘আসলে সেসময় পরিস্থিতি বিবেচনায় ওনাকে এটা বলা হয়েছে। যেহেতু একটি সেনসিটিভ ইস্যু, তাই। আসলে আমরা তদন্ত করেছি, তার কোনো দোষ নেই। তার সঙ্গে অভিযোগকারী ছাত্রীর কোনো কথাই হয়নি। আমরা এটা নিয়ে আবার বসব।’


সূত্র: নি্উজবাংলা ২৪

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ