কোরআন রাখতে আরেকটি মন্দিরেও গিয়েছিলেন ইকবাল

নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে কোরআন রাখায় অভিযুক্ত ইকবাল ওই রাতে কিছুটা দূরের এই গুপ্ত জগন্নাথ মন্দিরেও গিয়েছিলেন। ছবি: নিউজবাংলা
নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে কোরআন রাখায় অভিযুক্ত ইকবাল ওই রাতে কিছুটা দূরের এই গুপ্ত জগন্নাথ মন্দিরেও গিয়েছিলেন। ছবি: নিউজবাংলা

মাহফুজ নান্টু মাহফুজ নান্টু, কুমিল্লা ২১ অক্টোবর, ২০২১ ২১:৫৩ আপডেট: ২২ অক্টোবর, ২০২১ ১৩:২১


কোরআন রাখতে আরেকটি মন্দিরেও গিয়েছিলেন ইকবাল

তদন্তসংশ্লিষ্টরা নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন, একটি সংঘবদ্ধ চক্র মণ্ডপে কোরআন রাখতে ইকবালকে কাজে লাগিয়েছে। নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপটিতে শুরুতে ইকবাল গেলেও লোকজন দেখে ফিরে আসেন। এরপর তিনি যান কিছুটা দূরের গুপ্ত জগন্নাথ মন্দিরে। সেখানে গেটের তালা ভাঙতে ব্যর্থ হন ইকবাল।


কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের যে অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ পাওয়া যায়, সেখানে শুরুতে প্রবেশে ব্যর্থ হয়েছিলেন প্রধান অভিযুক্ত ইকবাল হোসেন। এরপর তিনি গিয়েছিলেন ওই মণ্ডপ থেকে কিছুটা দূরে দিগম্বরীতলার গুপ্ত জগন্নাথ মন্দিরে।


মন্দিরটির গেটের তালা লাঠি দিয়ে ভাঙতে ব্যর্থ হন ইকবাল। এরপর আবার ফিরে আসেন নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে। এ সময় পূজাসংশ্লিষ্টদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তিনি কোরআন শরিফটি হনুমানের ওপর রাখেন। মসজিদ থেকে বের হওয়ার প্রায় এক ঘণ্টা পর কোরআন রেখে হনুমানের গদা হাতে ফিরে আসেন ইকবাল।


ওই এলাকার বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ এবং ইকবালের সহযোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এমন তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।


প্রধান অভিযুক্ত ইকবাল হোসেন মাজারের মসজিদ থেকে কোরআন শরিফ নিয়ে রওনা হন মণ্ডপের দিকে। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে নেয়া ছবি।
প্রধান অভিযুক্ত ইকবাল হোসেন মাজারের মসজিদ থেকে কোরআন শরিফ নিয়ে রওনা হন মণ্ডপের দিকে। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে নেয়া ছবি।

নিউজবাংলার হাতে আসা সিসিটিভির নতুন ফুটেজেও বিষয়টি দেখা গেছে। এসব ফুটেজে পরিষ্কার ওই মণ্ডপের পাশের শাহ আবদুল্লাহ গাজীপুরি (রা.)-এর মাজারের মসজিদে নিয়মিত যেতেন ইকবাল। সেখানকার অনেকে তার পরিচিত।


শাহ আবদুল্লাহ গাজীপুরি (রা.)-এর মাজারটি থেকে আলোচিত মণ্ডপে হেঁটে যেতে সময় লাগে ২ থেকে ৩ মিনিট। দারোগাবাড়ী মাজার নামে কুমিল্লাবাসীর কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিতি রয়েছে মাজারটির। আর এই মাজারটি থেকে দিগম্বরীতলার গুপ্ত জগন্নাথ মন্দিরে হেঁটে যেতে সময় লাগে প্রায় ১০ মিনিট।


তদন্তসংশ্লিষ্ট কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেছে, একটি সংঘবদ্ধ চক্র মণ্ডপে কোরআন রাখতে ইকবালকে কাজে লাগিয়েছে। নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপটিই ছিল তাদের লক্ষ্য। তবে ইকবাল যখন মসজিদ থেকে কোরআন নিয়ে সেখানে যান, তখন মণ্ডপ পুরোপুরি জনশূন্য হয়নি। এ জন্য তিনি চলে যান মণ্ডপ থেকে কিছুটা দূরের গুপ্ত জগন্নাথ মন্দিরে। ওই মন্দিরটির গেটের তালা ভাঙতে তিনি একটি লাঠিও জোগাড় করেন। তবে সেটি তালা ভাঙার মতো মজবুত না হওয়ায় ব্যর্থ হন ইকবাল। এরপর আবার নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে যান।

নানুয়ার দিঘির পাড়ের মণ্ডপে কীভাবে উত্তেজনার শুরু এবং মূল মণ্ডপের বাইরে পূজার থিম হিসেবে রাখা হনুমানের মূর্তির ওপর পবিত্র কোরআন শরিফ কী করে এলো, সে বিষয়ে মঙ্গলবার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিউজবাংলা।


এই জগন্নাথ মন্দিরের তালা ভাঙতে ব্যর্থ হন ইকবাল
এই মন্দিরের তালা ভাঙতে ব্যর্থ হন ইকবাল

পূজার আয়োজক, এলাকাবাসী, তদন্তকারী কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার আগের রাত আড়াইটা পর্যন্ত মন্দিরে পূজাসংশ্লিষ্টদের উপস্থিতি ছিল। এরপর বুধবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে দুজন নারী ভক্ত মণ্ডপে এসে হনুমানের মূর্তিতে প্রথম কোরআন শরিফটি দেখতে পান।


পূজার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন দিঘির পাড়ের বাসিন্দা তরুণ কান্তি মোদক। স্থানীয়রা তাকে মিথুন নামে চেনেন। মিথুন নিউজবাংলাকে জানান, রাত আড়াইটা পর্যন্ত তিনি মণ্ডপে ছিলেন। তখন পর্যন্ত সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। এরপর তিনি নৈশপ্রহরী শাহিনের কাছে মণ্ডপের নিরাপত্তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় ফেরেন। সহিংসতার পর নৈশপ্রহরী শাহিনকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।


নিউজবাংলার হাতে আসা নতুন সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, কোরআন নেয়ার আগের রাতেও মাজারের মসজিদে গিয়েছিলেন ইকবাল। তখন মধ্যরাত পেরিয়ে ক্যালেন্ডারের পাতায় ১২ অক্টোবর। রাত ৩টা ৪২ মিনিটে মসজিদে যান ইকবাল।

এই ফুটেজে মসজিদের বারান্দায় হাঁটতে দেখা যায় ইকবালকে।


মসজিদ থেকে কোরআন নিয়ে মণ্ডপে রাখায় প্রধান অভিযুক্ত ইকবাল
মসজিদ থেকে কোরআন নিয়ে মণ্ডপে রাখায় প্রধান অভিযুক্ত ইকবাল

পরের ফুটেজটি মঙ্গলবার রাত ১০টা ৩৮ মিনিটের। মসজিদের বারান্দায় দুজনকে বসে থাকতে দেখা যায়। রাত ১০টা ৫৮ মিনিটে ইকবাল এসে ওই দুজনের সঙ্গে বসে কথা বলেন। এই দুজন হলেন মাজারের সহকারী খাদেম হিসেবে পরিচিত হুমায়ুন আহমেদ ও ফয়সাল আহমেদ।


ঠিক ১১টায় তিনজনই সেখান থেকে উঠে পড়েন। ইকবাল পলাতক থাকলেও মসজিদে তার সঙ্গে কথা বলা হুমায়ুন ও ফয়সালকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।


ওই রাত ২টা ১২ মিনিটের একটি ফুটেজে ইকবালকে মসজিদের বারান্দায় কোরআন শরিফ রাখার শেলফের সামনে দেখা যায়। সে সময় বারান্দায় একজন নামাজ পড়ছিলেন এবং একজন শুয়ে ছিলেন। ইকবাল একটি কোরআন শরিফ নিয়ে বারান্দায় বসেন। রাত ২টা ১৪ মিনিটে কোরআনটি বারান্দায় রেখে খালি হাতে তিনি উঠে পড়েন।


এর ৩ মিনিট পর ইকবাল আবার ফিরে এসে কোরআন তুলে নিয়ে বারান্দায় ঘোরাঘুরি করেন। এ সময় নামাজরত সেই ব্যক্তি সেখানে ছিলেন না।


এর পরের ফুটেজটি মাজারের পুকুরের পূর্ব পাড়ের একটি বাসার সিসিটিভি ক্যামেরার। উন্নত প্রযুক্তির এই সিসিটিভি ক্যামেরা ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলের। ক্যামেরাটি প্রতি ৪ মিনিট অন্তর মুভ করে।


এই সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ে মসজিদ থেকে ইকবালের কোরআন নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য
এই সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ে মসজিদ থেকে ইকবালের কোরআন নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য

এতে দেখা যায়, ডান হাতে কোরআন নিয়ে মসজিদের পুকুরের পাড় দিয়ে ইকবাল হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছেন।


এর পরের আরেকটি ফুটেজে দেখা যায়, ইকবালের বাম হাতে রয়েছে কোরআনটি। এলাকার একটি রাস্তা দিয়ে তিনি হেঁটে যাচ্ছেন।


পরের ক্যামেরার ফুটেজে ইকবালকে জগন্নাথপুর মন্দির রোড ধরে হেঁটে যেতে দেখা যায়। একপর্যায়ে তিনি গুপ্ত জগন্নাথ মন্দিরের সামনে প্রায় ২৭ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার ডান হাতে দেখা যায় ছোট একটি লাঠি এবং বাম হাতে কোরআন। তদন্তকারীরা বলছেন, এই লাঠিটি দিয়ে মন্দিরের গেটের তালা ভাঙতে ব্যর্থ হন ইকবাল।


এর পরের ফুটেজে তাকে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের চকবাজার শাখার দিকে যেতে এবং পরেরটিতে পূবালী ব্যাংক মোড়ের পাশের গলিতে ঢোকার মুখে দাঁড়াতে দেখা যায়। এই ফুটেজে সময় দেখা যাচ্ছিল রাত ২টা ৪২ মিনিট।


পরের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ইকবালকে একজন নৈশপ্রহরী ও আরেক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। সে সময়ও তার হাতে কোরআন শরিফ দেখা যায়।


তারপর ইকবালকে দেখা যায় সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সামনে দিয়ে যেতে। এর পরের ক্যামেরার ফুটেজে আবারও তাকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চকবাজার শাখার দিকে যেতে দেখা যায়। অন্য ক্যামেরায় গুপ্ত জগন্নাথ মন্দিরের সামনে দিয়ে যেতে দেখা যায় এই যুবককে।


ইকবালকে পরের ফুটেজে এলাকার আরেকটি রাস্তায় কোরআন হাতে হাঁটতে দেখা যায়। পরেরটি ছিল জগন্নাথ মন্দিরের সামনের রাস্তার।


এরপর কোরআন হাতে ইকবালের আর কোনো ফুটেজ পাওয়া যায়নি।


তবে মাজার কানেক্টিং রোডে ৩টা ১২ মিনিটের ফুটেজে দেখা যায়, মণ্ডপে কোরআন রেখে গদা হাতে ফিরে আসছেন ইকবাল। এই ফুটেজটি সব মিলিয়ে ২ মিনিট ২৫ সেকেন্ডের।


মণ্ডপে কোরআন শরিফ রাখার পর হনুমানের গদা হাতে হেঁটে যাওয়া ইকবাল
মণ্ডপে কোরআন শরিফ রাখার পর হনুমানের গদা হাতে হেঁটে যাওয়া ইকবাল

এরপর রাত ৩টা ১৩ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে ওই রাস্তায় একজনকে দেখা গেছে, যাকে ইকরাম হোসেন বলে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।


তদন্তসংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, মণ্ডপে কোরআন রাখায় যে চক্রটি জড়িত, ইকবাল তাদের একজন। তিনি কোরআন রাখার পর ভোরে আরেক অভিযুক্ত ইকরাম হোসেন ঘটনাস্থল থেকে ৯৯৯-এ কল করেন। তারপর ওসি আনওয়ারুল আজিম ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি কোরআন শরিফটি উদ্ধারের পাশাপাশি ইকরামকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে থানায় নিয়ে যান।


কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ পাওয়ার পর চলে ভাঙচুর
কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ পাওয়ার পর চলে ভাঙচুর

নিউজবাংলার হাতে আসা শেষ ফুটেজটি মসজিদের বারান্দার। ইকবাল রাত ৩টা ২২ মিনিটে আবার মসজিদে ফিরে যান। তবে তখন তার হাতে গদাটি ছিল না।


এসব ফুটেজ নিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম তানভীর আহমেদ নিউজবাংলাকে এর আগে আরেকটি ফুটেজের প্রসঙ্গে বলেন, ‘কুমিল্লার ঘটনাটির পেছনে কারা দায়ী, তা জানতে আমরা সবকিছু নিখুঁতভাবে মনিটর করছি। ঘটনার আগের রাতে কুমিল্লা শহরে যতগুলো সিসিটিভি ক্যামেরায় ইকবালকে দেখা গেছে, সব আমরা সংগ্রহ করেছি। আমরা সব ক্যামেরার পুরো হার্ডড্রাইভ নিয়ে এসেছি, যাতে কেউ কোনো ফুটেজ ডিলিট করে দিলেও আমরা উদ্ধার করতে পারি। আমাদের এক্সপার্ট ফরেনসিক টিম সিসিটিভি ফুটেজগুলো নিয়ে কাজ করেছে।’

কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখায় প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে শনাক্ত ইকবাল হোসেনের মসজিদে যাওয়া, সেখান থেকে কোরআন শরীফ নেয়া, গদা হাতে ফিরে যাওয়া এবং খালি হাতে আবারও ওই মসজিদে যাওয়ার পর্যায়ক্রমিক সিসিটিভি ফুটেজ এসেছে নিউজবাংলার কাছে।


সূত্র: নিউজবাংলা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ