ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা দেশজ নয়

ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা দেশজ নয়
 


    ৮ ডিসেম্বর, ২০২০ ১৪:৩৭ 



নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে মুসলিম হিন্দু খ্রিস্টান বৌদ্ধ আদিবাসী সবাই অংশ নিয়েছে। ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা। বাংলাদেশের আদর্শই হলো পাকিস্তানিজমের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানিজম হলো মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের বিপরীত।


চল্লিশের দশকে ঢাকা শহর সাম্প্রদায়িক শহরে পরিণত হয়। চিরকালের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি পরিণত হয় সাম্প্রদায়িক মানুষে। বাঙালি আর বাঙালি থাকে না, হিন্দু মুসলিমে পরিণত হয়। এ পাড়ার মানুষ ওপাড়ায় যেতে পারে না। ওপাড়ার মানুষ এপাড়ায় আসতে পারে না। মানুষ নামের মানবিক প্রাণী মানবেতর প্রাণীতে পরিণত হয়।


বিপন্ন মানুষের আর্থ-সামাজিক এবং মানস কাঠামোতে চরম আঘাত হানে সাম্প্রদায়িকতা। হিংসা বিদ্বেষ জিংঘাসা সমাজে স্থায়ী রূপ নেয়। সরদার ফজলুল করিম লিখেছেন, ‘ঢাকার দাঙ্গা সেকালের ম্যালেরিয়ার মতো আমরা সহ্য করেছি। তা নিয়ে জীবনযাপন করেছি। মহামারি আকারে ঢাকায় কখনো দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েনি। গণহত্যা ঘটেনি। দাঙ্গা বাঁধলে তার শিকার অবশ্য নিরীহ পথচারীরা হয়েছে। যারা গ্রাম থেকে হঠাৎ শহরে এসেছে। কোনটা প্রধানত হিন্দু পাড়া, কোনটা মুসলমান পাড়া, তা যার জানা নেই।’


মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ নিরীহ শ্রমজীবী মানুষ। নিম্ন এবং সীমিত আয়ের মানুষের জীবন জীবিকা বিপন্ন হয়। বস্তুচ্যুত হয় সাধারণ মানুষ। সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। বস্তুচ্যুত মানুষের মধ্যে নীতি আদর্শ ন্যায়পরায়ণতার চেয়ে জীবন সংগ্রাম বড় হয়ে সামনে আসে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বৃদ্ধি পায়। সমাজ রাষ্ট্র হয়ে ওঠে অস্থির। আদর্শিক অবস্থানহীন মানুষের নিয়ন্ত্রিত সমাজ ‘লিক্যুইড’ আকার ধারণ করে। ‘লিক্যুইড’ সমাজে স্থায়ী আদর্শ স্থাপনের চেষ্টা অলিক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।


চল্লিশের দশকের ঢাকা কেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মুসলিম লীগের উত্থানপর্বে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ব বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা করোনার মতো ছড়ালেও মহামারি আকার ধারণ করেনি।


সাম্প্রদায়িকতার কারণে বাংলাদেশে কখনোই গণহত্যা হয়নি। সামরিক স্বৈরশাসকদের নির্মম শোষণ শাসন টিকিয়ে রাখার জন্যে বাংলাদেশের চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির উপর সাম্প্রদায়িকতার প্রলেপ দেয়া হয়। পাকিস্তানের ২৪ বছর সাম্প্রদাকিতার চারণ ভূমি ছিল বাংলাদেশ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রেসক্রিপশনে পাকিস্তানের শাসকেরা ধর্মীয় বিভাজনকে আশ্রয় করে শাসন এবং শোষণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশকে উপনিবেশে পরিণত করে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার করার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে শুধু ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠনের শক্তি বৃদ্ধি হয়নি, পাকিস্তানি স্টাইলে সাম্প্রদাকিতার চাষ হয়।


নব্বইয়ের পর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা হ্রাস পায়নি। মুসলিম লীগের আদর্শিক দায়িত্ব পালন করে জামায়াত-বিএনপি জোট সরকার। মুসলিম লীগের অনুরাগী অনুসারী বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী শক্তির পরিণতি পূর্বসূরীর পথ অনুসরণ করছে, এমন মন্তব্য কেউ করলে অন্যায় হবে না। কিন্তু মুসলিম লীগের অনুসারী অনুরাগী সমাজ মানসে কমে না। ভিন্ন নামে ভিন্ন রূপে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি সমাজে বিষ ফোঁরার মতো থেকে যায়।


ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা দেশজ নয়। আমদানি করা। কখনও কখনও আমদানি পণ্য দেশজ উপাদানকে হারিয়ে দেয়। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির উপর আমদানি করা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা উগ্রভাবে চেপে বসেছে। কোনো মন্ত্রের সাহায্যে একদিনে একা সমাজের মধ্যে গড়ে উঠা এই বিষফোঁরা হঠাৎ করে অপসারণ করা সম্ভব নয়। এ জন্যে পরিকল্পনা প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অসাম্প্রদায়িকরণ সবার আগে প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠান প্রধানে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি শুধু দেশে মুসলিম লীগের আদর্শ প্রচারে সহযোগিতা করে না, অসাম্প্রদায়িক চেতনার উপর আঘাত হানে। এ ধরনের লেবাসধারী আত্মকেন্দ্রিক নীতি আদর্শহীন সুবিধাবাদীরা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করে এবং এদের দ্বারা বাংলাদেশের পক্ষের শক্তির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়। জাতীয় সম্পদ নষ্ট করে।


বাংলাদেশকে সত্যিকারে একটি আধুনিক এবং আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের বিকল্প কিছু নেই। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে আশ্রয় করে কিছু সময় ক্ষমতায় থাকা যায়, ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিন্তু দেশের এবং জাতীয় সামগ্রিক ক্ষতি হয়। দেশ পিছিয়ে যায়। নব্বইয়ের পর দেশ এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় সাম্প্রদায়িকতা লালিতপালিত হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে অগ্রগতিতে বিলম্ব হয়। পাবলিক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের নৈরাজ্য অবস্থা জনমনে অস্থিরতা সৃষ্টি করে।


ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংসা হানাহানি কম হয়েছে। জমি জলার দখলদারিত্ব এবং ক্ষমতার লড়ায়ের দাঙ্গায় ধর্মীয় আবরণ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে ধর্মের মর্মবাণী এবং পবিত্রতা নষ্ট হয়েছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং ধর্ম ব্যবসায়ীরা এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশ এবং অসাম্প্রদায়িকতা প্রায় সমার্থক। অসাম্প্রদায়িকতার উপর ভিত্তি করেই বংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।


নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে মুসলিম হিন্দু খ্রিস্টান বৌদ্ধ আদিবাসী সবাই অংশ নিয়েছে। ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা। বাংলাদেশের আদর্শই হলো পাকিস্তানিজমের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানিজম হলো মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের বিপরীত। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি লড়েছে পাকিস্তানিজমের বিরুদ্ধে।


১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানিজমের চর্চা দেশে বৃদ্ধি পায়। কাজী নজরুল ইসলামকে দ্বিখণ্ডিত করে উপস্থাপন করা হয়। রেডিও টেলিভিশনে নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত এবং কীর্তন বন্ধ হয়ে যায়। নজরুলের ইসলামি গানের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। স্কুল কলেজের পাঠ্যবই থেকে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ কবি সাহিত্যিক অপসারিত হয় দ্রুত। হাসান হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে উঠা বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নেতৃত্বে গড়ে উঠে ফ্রিডম পার্টি। রাষ্ট্রীয় আর্শীবাদে ফ্রিডম পার্টির নেতা কর্মীরা ভারী অস্ত্র হাতে দেশের সব স্থানে সভা সমাবেশ করে।


একাত্তরের পরাজিত শক্তি এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দল ফ্রিডম পার্টির নেতা কর্মীরা বাঙালি চেতনার উপর আঘাত হানে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠা অসাম্প্রদায়িক চেতনা। বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপনের জন্যে বাঙালির মূলে ফিরে যাওয়ার বিকল্প কিছু নেই। পাকিস্তানিজমকে সঙ্গে নিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।


লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


সূত্র: নিউজবাংলা ২৪

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ