সাম্প্রদায়িক হামলা শতাধিক, তালিকায় আসেনি অনেক

সাম্প্রদায়িক হামলা শতাধিক, তালিকায় আসেনি অনেক
ছবি: সংগৃহীত
 


সমকাল প্রতিবেদক , প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০২:২৪


শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের পদধারী হিন্দু নেতাকর্মী ছাড়াও শতাধিক সংখ্যালঘু পরিবার আক্রমণের শিকার হয়েছে। রাজধানী, চট্টগ্রাম মহানগর ও বিভাগীয় শহরগুলোয় সাম্প্রদায়িক হামলা খুব একটা না হলেও গ্রামীণ এলাকায় বিশেষ করে যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্যাতন-নিপীড়ন হয়েছে। অধিকাংশ ঘটনায় মামলা হয়নি।


পুলিশ সদরদপ্তরের বরাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং গত মঙ্গলবার জানিয়েছে, দেশে গত ৫ আগস্ট থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে ৮৮টি মামলায় ৭০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা ও গ্রেপ্তারের সংখ্যা আরও বাড়বে। 


হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের পরিসংখ্যানে ২০১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করা হয়েছে। সমকালের অনুসন্ধানে ২৯৬টি অভিযোগের মধ্যে ১৩৫টির সত্যতা মিলেছে। তবে তালিকায় নাম আসেনি এমন অনেক হিন্দু পরিবার নির্যাতিত হয়েছে। হামলাকারীদের অধিকাংশ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে যুক্ত বলে পরিচিত। আবার ৫ আগস্ট বিজয় মিছিল থেকেও হামলা হয়। 


ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলায় ৪২টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অভিযোগ এসেছে ঐক্য পরিষদের পরিসংখ্যানে। সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫ আগস্ট ফুলপুর, তারাকান্দা উপজেলায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর বাড়িতে ঢালাও হামলা ও ভাঙচুর হয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক নেই– এমন হিন্দু পরিবারও আক্রান্ত হয়। 


বগুড়া ব্যুরো জানিয়েছে, ৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী দিনগুলোয় জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ২৯টি হামলা হয়েছে। গাবতলী উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নে ১৭টি হামলা হয়েছে। মধ্যপালপাড়া এলাকায় ৮টি বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। সেখানে পলাশ দাসের মুদি দোকানের মালপত্র লুট এবং ভাঙচুর করা হয়। ভজন কর্মকারের বাড়িঘর ভাঙচুর ও মন্দিরে প্রতিমা ভাঙা হয়। ৫ ভরি স্বর্ণালংকার লুট ও মারধর করা হয়। প্রশান্ত চন্দ্র দাসের চারটি গরু লুট করা হয়। অনীন্দ্র চন্দ্রের বাড়িঘর ভাঙচুর ও ১০ হাজার টাকার মালপত্র লুট হয়। স্থানীয় স্কুলশিক্ষক সাজেদুর রহমান সাজু বলেন, ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় পালপাড়া এলাকায় ৮টি বাড়িতে হামলা হয়েছিল। 


সোনারায় ইউনিয়নের জামিরবাড়িয়া এলাকায় ব্রত চৌধুরীর বাড়ি, তপন চন্দ্রের মিষ্টির দোকান ও গোপাল চন্দ্রের হোমিও দোকানে হামলা হয়। আর কর্মকারপাড়ায় ছয়টি বাড়িতে হামলা হয়। 


সোনারায় ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রাজা মণ্ডল বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে ১০-১২টি ঘটনার কথা জানি।’ 


বগুড়া সদরের পীরগাছা বধুয়াতলা এলাকায় কীর্তনিয়া পুষ্পরানীর বাড়িঘরে হামলা এবং তাঁর ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাস ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। উজ্জ্বল দাসের বাড়ির মন্দিরও ভাঙচুর করা হয়। কিন্তু ঐক্য পরিষদের তালিকায় তাঁর নাম নেই। 


চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের পাঁচ পরিবারের বাড়িতে হামলা ও লুটপাট হয়। সরেজমিনে গিয়ে এসব বাড়িতে এখনও ক্ষতচিহ্ন, ধ্বংসাবশেষ দেখা গেছে। সদরের গুপ্তি গ্রামের প্রয়াত প্রাক্তন স্কুলশিক্ষক জ্ঞান রঞ্জন দাসের বাড়ি নামে পরিচিত ওই বাড়িটিতে অধ্যক্ষ হরিপদ দাস ছাড়াও তাঁর ভাই সমিত রঞ্জন দাস, সুমন কান্তি দাস, সঞ্জিত রঞ্জন দাসসহ অন্যরা পাঁচটি একতলা পাকা বাড়িতে পৃথকভাবে থাকেন। 


সুমিতা দত্ত সমকালকে জানান, ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় ১৭-১৮ জনের একটি দল ঢুকে লুটপাট চালায়। আলমিরার তালা ভেঙে স্বর্ণালংকার নিয়ে যায়। টিভি, ফ্রিজ, আসবাব নিয়ে যায়। দুটি মোটরসাইকেলে আগুন দেয়। 


পরিস্থিতি ভয়াবহ ছিল যশোরের গ্রামে গ্রামে 


সমকালের অনুসন্ধানে জেলার বাঘারপাড়ায় ১৮ এবং অভয়নগরে ২৬ হিন্দু পরিবারের ওপর হামলার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। আক্রান্তদের কেউ রাজনীতিতে যুক্ত নন। ধর্মীয় পরিচয়ের কারণেই তারা হামলার শিকার হন। 


বাঘারপাড়া উপজেলার সুলতাননগর ঋষিপল্লিতে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি ও মন্দিরে এখনও ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। অসচ্ছল হিন্দুরা ভাঙাচোরা বাড়িতে দিন কাটাচ্ছেন। 

স্থানীয়রা জানান, শেখ হাসিনার পতনের পর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে হিন্দুপল্লিটিতে হামলা করে ৪০ থেকে ৫০ জনের দল। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল রামদা, হাঁসুয়া, লোহার রড, শাবল ও লাঠি। প্রথমে তারা হামলা করে শশধর বিশ্বাসের বাড়িতে। হামলা ও ভাঙচুরের শিকার হয় ঋষিপল্লির মন্দির-প্রতিমাও। এরপর পল্লির বিকাশ চন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে হামলা চালিয়ে দুটি ঘর ভাঙচুরের পাশাপাশি হাঁস, মুরগি এমনকি বাড়ির বাজার পর্যন্ত নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। রাজকুমার ও অপূর্বের বাড়ি ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। 


পল্লিটিতে কাছাকাছি অবস্থানে মোট চারটি মন্দির ও একটি মণ্ডপ। হরিচাঁদ মন্দিরের দুটি প্রতিমার একটির মাথা ভাঙা। পাশের বাসন্তী মন্দিরে ১১টি প্রতিমার মধ্যে সাতটির কোনোটির হাত, কোনোটির মুখ, আবার কোনোটির মাথা ভাঙা। মনিরামপুর থানার ওসি নূর মোহাম্মদ গাজী জানান, হামলার ঘটনায় মামলা হয়নি। 


যশোরের কেশবপুরেও ২৭টি পরিবার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার তথ্য এলেও, বাস্তবে এই সংখ্যা অনেক বেশি। তবে কিছু ঘটনায় রাজনৈতিক বিরোধ ও পূর্বশত্রুতা রয়েছে। হিন্দু অধ্যুষিত পাজিয়া ইউনিয়নে বেশ কিছু পরিবারে ও দোকানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট হলেও তালিকায় সব নাম আসেনি বলে জানান স্থানীয়রা। 


জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু জানান, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অভিযোগ সঠিক নয়। বরং বিএনপি দিনরাত পাহারা দিয়েছে। এখনও তা চলছে। এরপরও দু’এক জায়গায় নির্যাতিত-বিক্ষুব্ধরা বিগত সরকারের দোসরদের ওপর ক্ষোভ দেখিয়েছে। যারা এতে জড়িত ছিল তাদের বহিষ্কার করেছে বিএনপি। 


সাতক্ষীরার কলারোয়া ও শ্যামনগর উপজেলায় বহু হিন্দু আক্রান্ত হয়েছেন। কলোরোয়ার তুলসীডাঙ্গা গ্রামের উত্তম কুমার ঘোষ বলেন, ‘আমার দোকানে যারা হামলা করেছে, তাদের চিনি। তবে নাম বলা যাবে না। তাদের কোনো দল নেই।’ 


শ্যামনগরের পোড়াকাটলা গ্রামের ডালিম ঘরামীর বাড়িতে ৫ আগস্ট হামলা হয় জামায়াত নেতা হাজী নজরুল ইসলামের ছেলে আব্দুর রহমান ও জামায়াত কর্মী নুরুজ্জামান ডাক্তারের নেতৃত্বে। হামলায় জড়িত ছিল বনদস্যুরাও। 



সূত্র: সমকাল

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ