ভাই গিরিশচন্দ্র সেন : কোরআনের অনুবাদ নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক - সিরাজ উদ্দিন সাথী

ভাই গিরিশচন্দ্র সেন : কোরআনের অনুবাদ নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক - সিরাজ উদ্দিন সাথী

আগস্ট ১৫, ২০২৩

১৮৮১ সালে শুরু করে শেষ করেন ১৮৮৬ সালে। প্রথম খণ্ড শেরপুরের চারুচন্দ্র প্রেস থেকে ছাপেন। এর একটি কপি পাঠান কলকাতায়, পত্রিকায় প্রকাশের জন্যে। শর্ত দেন, প্রকাশকালে থাকবে না অনুবাদকের নাম। এভাবেই প্রথম প্রকাশ। পরে অনূদিত খণ্ডগুলো একে একে পাঠালেন কলকাতার বিধানযন্ত্র প্রেসে। এখানেই প্রথম অখণ্ড অনুবাদ প্রকাশিত হয় তাঁর নাম উহ্য রেখে। এক হাজার কপি বাঁধাই হয়ে বাজারে যায়। দ্রুতই তা নিঃশেষ হয়। ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রচ্ছদে অনুবাদকের নাম উল্লেখ করে। প্রকাশক ও মুদ্রক দেবযন্ত্রের মালিক গিরিশচন্দ্র চক্রবর্তী।


ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। জন্ম মহেশ্বরদী পরগণার পাঁচদোনায়। ১৮৩৪ সালে। একজন ক্ষণজন্মা মানুষ। অত্যন্ত মেধাবী, কিন্তু আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া করেননি খুব বেশি। বাড়িতে পারিবারিক শিক্ষাগুরুর কাছে বাংলা ও মৌলভীর কাছে ফারসি শেখা। তারপর ঢাকার পোগোজ স্কুলে কিছুকাল পড়েছিলেন। ভালো লাগেনি একটানা পাঁচ ঘণ্টা ক্লাশরুমে বসে থাকা। তাই স্কুল ছেড়েছিলেন। তারপর ভাইয়ের আশ্রয়ে ময়মনসিংহে সংস্কৃত পাঠশালায়, হার্ডিঞ্জ স্কুলে। অতঃপর হার্ডিঞ্জ থেকে শিক্ষক প্রশিক্ষণে পাশ করে ঐ-স্কুলেই শিক্ষকতা। লেখাপড়ার আনুষ্ঠানিক দৌড় এতোটুকুই। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক অধ্যয়নে পুরো জীবন কেটেছে তাঁর। আর তাতেই ব্যুৎপত্তি ঘটেছে বাংলা, ইংরেজি, ফারসি, সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু ও আরবি ভাষায়। সার্থকতা এসেছে লেখালেখি আর সাংবাদিকতায়।


আমাদের বাড়ির কাছের এই মানুষটি সম্পর্কে জানি সেই ছোটোকাল থেকেই। জানি কোরআনের বাংলা অনুবাদক হিসেবে। কোরআন সপ্তম শতাব্দীর প্রথম ভাগের আরব দেশের ঐশী ধর্মগ্রন্থ। আরবি ভাষায় লেখা। এর বাণী প্রচার করে ইসলাম ধর্ম ব্যাপ্তি পেয়েছে দেশে দেশে। এই বাংলা মুল্লুকেও। সেই থেকে এখানকার মুসলমানদের ঘরে ঘরে রয়েছে পবিত্র এই ধর্মগ্রন্থ, আরবি কোরআন। অধিকাংশই পড়তে জানেন। কিন্তু ক’জনে এর অর্থ বোঝেন?


আরবি থেকে বাংলায় সম্পূর্ণ কোরআন অনুবাদের মাধ্যমে এর অর্থ বোঝার মহতি কাজটি করলেন পাঁচদোনার এই মানুষটি। এখন থেকে ১৪২ বছর আগে। আর এই কাজটি করতে ৪২ বছর বয়সে তিনি আরবি শিখতে যান তখনকার ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার অন্যতম কেন্দ্র লখনৌ’তে। লখনৌর প্রবীণ আলেম মৌলভী এহসান আলীর কাছে আরবি ভাষা ও ব্যাকরণ শেখেন এক বছর। তাঁর কাছে ফারসি সাহিত্যও পড়াশোনা করেন তিনি। ফিরে এসে কলকাতা ও ঢাকার নলগোলায় আরো দুইজনের কাছে আরবিতে অধিকতর তালিম নেন। তারপর অনুবাদের কাজে হাত দেন।


অনুবাদের কাজ শুরু করেন ময়মনসিংহে। ১৮৮১ সালে শুরু করে শেষ করেন ১৮৮৬ সালে। প্রথম খণ্ড শেরপুরের চারুচন্দ্র প্রেস থেকে ছাপেন। এর একটি কপি পাঠান কলকাতায়, পত্রিকায় প্রকাশের জন্যে। শর্ত দেন, প্রকাশকালে থাকবে না অনুবাদকের নাম। এভাবেই প্রথম প্রকাশ। পরে অনূদিত খণ্ডগুলো একে একে পাঠালেন কলকাতার বিধানযন্ত্র প্রেসে। এখানেই প্রথম অখণ্ড অনুবাদ প্রকাশিত হয় তাঁর নাম উহ্য রেখে। এক হাজার কপি বাঁধাই হয়ে বাজারে যায়। দ্রুতই তা নিঃশেষ হয়। ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রচ্ছদে অনুবাদকের নাম উল্লেখ করে। প্রকাশক ও মুদ্রক দেবযন্ত্রের মালিক গিরিশচন্দ্র চক্রবর্তী। এই সংস্করণ শেষ হওয়ার পর সংশোধিত আকারে, টীকা যুক্ত হয়ে তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় কলকাতার মঙ্গলগঞ্জ মিশন প্রেস থেকে। তাঁর জীবদ্দশায় এটিই শেষ সংস্করণ। ১৯১০ সালে তিনি মারা যান। এরপর অনবরত এর নতুন নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়ে আসছে কলকাতা ও ঢাকায়, ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশনী থেকে।


প্রথমবার যখন তাঁর অনুবাদখণ্ড প্রকাশিত হয়, তখন এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। এমনটা হয়েছিলো মুসলমান সমাজে, তেমন বিশ্বাসবোধ থেকে যে, “আরবিই কোরানের একমাত্র ভাষা, এর কোনো ভাষান্তর হতে পারে না।” তবে বাঙালি মুসলমান সমাজের বিদগ্ধজন এই ভাষান্তরকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যথার্থ অনুবাদ হয়েছে। বলেছিলেন, আগেই এর ভাষান্তর হয়েছে ফারসি ও উর্দুতে। কাজেই বাংলায় হলো, তাতে দোষ কী? তখন অবশ্য অনুবাদকের নাম ছিলো না, প্রচ্ছদে। পরে যখন নামসহ প্রকাশ পেলো, তখন আরেক ধরনের প্রতিক্রিয়া হলো। একজন অমুসলমানের অনুবাদে কোরআন, এ যেন অকল্পনীয় কারো কারো কাছে। এক ক্রুদ্ধ মুসলমান বললেন, “কাফেরের হাতে হয়েছে এই পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ। তাকে পাইলে আমি শিরশ্ছেদ করবো।” কিন্তু লেখাপড়া জানা আলেম সমাজ, বিদ্বানেরা এই কাজের অকৃপণ প্রশংসা করেন। অনুবাদককে উদ্দেশ্য করে প্রশংসাপত্র আসতে থাকে। পত্রিকায় লেখেন বেশ অনেকে। কলকাতার তিন মৌলভী ইংরেজিতে লেখা এক চিঠিতে বলেন, “আমরা কয়জন অত্যন্ত সতর্কতা ও মনোযোগ দিয়ে আপনার অনুবাদ পড়েছি। মূল কোরআনের সাথে তা তুলনা করে দেখেছি। আমরা অবাক হয়েছি কিভাবে আপনি এমন যথার্থ অনুবাদ করতে সক্ষম হলেন।” এমন প্রশংসাসূচক পত্র ও মতামত পাওয়া গেলো তৎকালীন অনেকের কাছ থেকেই। ঢাকা থেকে মৌলভী আলিমুদ্দিন আহমদ ফারসিতে লেখা পত্রে তাঁর অনুবাদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। আবু আল মজফফর আবদুল্লা নামের আরেকজন লেখেন, “আপনি যে টীকা বর্ণনা করেছেন তা আমার ক্ষুদ্র বিদ্যা-বুদ্ধিতে পর্যন্ত বুঝতে পেরেছি।” যশোরের মৌলভী আফতাব উদ্দীন লেখেন, “বাংলা অনুবাদটি অতি উৎকৃষ্ট ও প্রাঞ্জল। এতে বাঙালি জাতির গৌরব বাড়বে।” এমন প্রশংসার বর্ণনা তাঁর জীবনকালকে ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৩৬ সালে প্রখ্যাত মুসলমান মনীষী মওলানা আকরম খাঁ লেখেন :


“তিন কোটি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা। তাদের মধ্যে কোনো মনীষী কোরানের অনুবাদ প্রকাশের কল্পনা করেনি ১৮৭৬ সাল অবধি। আরবি ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত মুসলমানের অভাব ছিল না তাদের মধ্যে। এই গুরুদায়িত্বভার সর্বপ্রথম বহন করলেন বাংলার এক হিন্দু (প্রকৃত পক্ষে তিনি ছিলেন নিরাকার একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম, হিন্দু নন) সন্তান ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। তাঁর এই অসাধারণ সাধনা ও অনুপম সিদ্ধি জগতের অষ্টম আশ্চর্য বলে উল্লেখ করা যেতে পারে।”


ভাই গিরিশচন্দ্র সেন বাঙালি মুসলমান সমাজ কর্তৃক তাঁর সকল প্রশংসার জবাব দিয়েছেন অতি বিনয়ের সাথে। লিখেছেন :


“এ তো ঈশ্বরের লীলা। সাধারণ মানুষের অগম্য এই নিগূঢ় জ্ঞান আমি তাদের জন্য প্রকাশ করতে পারবো, এমনটা আমি পূর্বে চিন্তা করতে পারিনি। অনেকটা মনের আবেগে আমি এই কাজের উদ্যোগী হয়ে লখনৌ যাই।”


    ফেসবুকের সেই ‘ফেসলেস’ কতিপয় মানুষ লিখছেন, “গিরিশচন্দ্র সেন কোরআনের অনুবাদক নন, প্রকাশক।” লিখছেন, “এতদিনে সত্যটা প্রকাশ পেল কোরআনের বাংলা অনুবাদক নিয়ে।” লিখছেন, “হিন্দু গিরিশচন্দ্র নয়, কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক মুসলমান…।” আমি অবাক হই। এমন যেসব লিংকের দেখা পাই, সবিনয়ে দুই কথা লিখি, সম্বিৎ ফেরাতে চাই। কিন্তু না, তাতে কি ফেরেন তারা?


প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে চাই, কোরআন অনুবাদে তাঁর নাম ছড়িয়েছে, এ-কথা সত্য। কিন্তু এটাই তাঁর একমাত্র সৃষ্টিকর্ম নয়। তিনি অনবরত লিখেছেন আজীবন। নিজের আত্মজীবনীসহ তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৭৭ টির মতো। তিনিই প্রথম হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী লিখেছেন বাংলায়। তিনি বই লিখেছেন ইসলামের মনীষীদের নিয়ে। অনুবাদ করেছেন বিখ্যাত আরবি গ্রন্থ ‘মেস্কাতোল মসাবিহ’। এর নাম দিয়েছেন ‘হাদিস পূর্ব্ব বিভাগ’। এরপর হাদিসের অপর খণ্ড ‘হাদিস উত্তর বিভাগ’। বিচিত্র তাঁর লেখার ভুবন। লিখেছেন ভ্রমণ কাহিনি, ইতিহাস ও ধর্মবিষয়ক বই ‘বর্ম্মাদেশ ও বর্ম্মাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম’।


ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের সকল কীর্তি এখন সুদূর অতীতের ঘটনা। কোরআন অনুবাদের বিষয়টিও তাই। কিন্তু সেই অতীত আবার সামনে এসেছে কিছু মানুষের অপলাপের ফলে। প্রায় দেড়শো বছর পর প্রতিষ্ঠিত সত্যকে ঘিরে নতুন তথ্য হাজির করছেন কিছু লোক। কোনো গবেষণায় নয়, কোনো প্রকাশনায় নয়, এমনকি কোনো বিতর্ক সভায়ও নয়। তারা এটা করছেন ‘সোস্যাল মিডিয়া’ বলে কথিত অবারিত এক মাধ্যমে, ফেসবুক-সহ অন্যত্র। এ এক বিচিত্র জগত। বিশাল এর পর্দা, নিমিষে তা ছড়িয়ে যায় আঙুলের এক চাপে। তারপর ‘লাইক’ আর ‘শেয়ার’-এর কসরত। কোনো বাছ-বিচারের বালাই নেই, সত্য-অসত্যের যাচাই নেই। হুমড়ি খেয়ে পড়ছে একদল মানুষ, ছুটছে বেদম, বলছে, বাহ্, চমৎকার তো, মারহাবা মারহাবা!


আমি দেখছি, ফেসবুকের সেই ‘ফেসলেস’ কতিপয় মানুষ লিখছেন, “গিরিশচন্দ্র সেন কোরআনের অনুবাদক নন, প্রকাশক।” লিখছেন, “এতদিনে সত্যটা প্রকাশ পেল কোরআনের বাংলা অনুবাদক নিয়ে।” লিখছেন, “হিন্দু গিরিশচন্দ্র নয়, কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক মুসলমান…।” আমি অবাক হই। এমন যেসব লিংকের দেখা পাই, সবিনয়ে দুই কথা লিখি, সম্বিৎ ফেরাতে চাই। কিন্তু না, তাতে কি ফেরেন তারা? ক’দিন পরপর একই পোস্ট দিতে থাকেন। সেই গোয়েবলসের কৌশলের মতো। একটা মিথ্যাকে বারবার প্রচার করলে অনেক মানুষ একেই সত্য বলে ভাববে। এমনটাই আমি এখন দেখছি। আমার পরিচিতজনদের মধ্যেও কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়ে আমাকে প্রশ্ন করেন, আসলেই কি তা?


ফেসবুকের তেমন একটি অপলাপ নমুনা হিসেবে তুলে ধরছি এখানে। শিরোনাম ‘একটি ভুলের নিরসন : গিরিশচন্দ্র সেন বাংলা ভাষায় কোরআন শরীফের অনুবাদক নন’। লেখাটি এখানে সংক্ষেপে উদ্ধৃত করছি :


“সর্বপ্রথম অনুবাদ করেন মাওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়া। তারপর মৌলভী নাইমুদ্দীন। গিরিশচন্দ্র হচ্ছেন প্রকাশক। সুতরাং কুরআন শরীফের প্রথম বাংলা অনুবাদক গিরিশ চন্দ্র নন। আরবি জানেন না, আরবি ব্যাকরণ জানেন না, এমন ব্যক্তি কুরআন অনুবাদ করেছেন— এমন প্রচার মূর্খতা।”


এই প্রচারে ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের কীর্তিকে শুধু অস্বীকারই করা হয়নি, তাঁকে তঞ্চকতার দায়ে অভিযুক্তও করা হয়েছে। আর এই পোস্টের নিচে বলা হচ্ছে, যতো পরিমাণে সম্ভব পোস্টটি শেয়ার করুন, অন্যকে জানার সুযোগ করে দিন। আহ্বানটি এমন যেন শেয়ার করে সাচ্চা মুসলমানিত্বের দায়িত্ব সারলেন।


অনুবাদ তো ভাষান্তর। এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায়। কোরআনের এমন ভাষান্তর বাংলায় সার্থকভাবে করেছেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। বহুকাল এই সত্য নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। এখন যাঁদের নাম উল্লেখ করে প্রচার শুরু, তাঁদের বিষয়ে একটু আলোকপাত করতে চাই।


আমীরুদ্দীন বসুনিয়া রংপুরের মানুষ। তিনি পুঁথি সাহিত্যের ভাষায় কোরআনের শেষ পারা ভাবানুবাদ করেছিলেন। কোরআনের শেষ পারাটি হচ্ছে ছোটো আকারের বেশ কয়েকটি সুরার সমষ্টি। এর অনেকগুলো নামাজি মুসলমানদের মুখস্থ থাকে। তিনি তেমন সুরাগুলোর তর্জমা পুঁথির ছন্দে লিখেছিলেন। ঐ-সময় এই অংশ নিয়ে তিনি ছাড়াও পুঁথির ভাষায় লেখেন জনৈক আকবর আলী। উল্লেখ্য যে, এই কাজে এই দুজনই প্রথম নন। তারও বহু আগে কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর কোরআনের একটি সুরায় বর্ণিত কাহিনি অবলম্বনে ‘ইউসুফ জুলেখা’ কাব্য লেখেন। পরবর্তীকালের কবি কাজী নজরুল ইসলামও কোরআনের প্রথম সুরা ‘ফাতিহা’ ও শেষদিকের সুরা ‘এখলাস’-এর অনুবাদ করেন কবিতার মতো করে। প্রশ্ন করা যেতে পারে, এসবকেই কোরআনের অনুবাদ বলা যাবে কি? পুঁথির ভাষায় কিংবা কবিতার ছন্দে সামান্য অংশবিশেষ লিখেই কি কোরআনের অনুবাদক হওয়া সম্ভব? তাঁদেরকে কি সম্পূর্ণ কোরআনের অনুবাদক বলা যায়?


জবাব হচ্ছে, না, তা বলা যায় না। হয়তো খণ্ডিতভাবে এমন অনুবাদ বা ভাবানুবাদ করে থাকবেন আরো অনেক ধর্মপ্রাণ। হয়তো-বা কোনো ইসলাম বিরোধীও। তাদের কেউ কোনোভাবেই সম্পূর্ণ কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক বলে বিবেচিত হতে পারেন না। যেটুকু কাজ তাঁরা করেছেন, সেটুকুর স্বীকৃতি ও মর্যাদা তাঁরা নিঃসন্দেহে পেতে পারেন। কিন্তু যা করেননি, তার কৃতিত্ব কী করে পাবেন?


টাঙ্গাইলের মানুষ মৌলভী নইমুদ্দীনকে এই কৃতিত্ব যারা দিতে চান, তারা সন তারিখের ভুল তথ্য দিচ্ছেন। এছাড়া তথ্য তল্লাশিতে বেরিয়ে এসেছে যে, তিনি কয়েক পারা মাত্র অনুবাদ করতে পেরেছিলেন, সম্পূর্ণটা নয়। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্রগণ আরো কয়েক পারা অনুবাদ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এর বেশি নয়। মৌলভী নইমুদ্দীন আর গিরিশচন্দ্র সেন সম-সাময়িক। অথচ প্রচারকেরা দাবি করছেন, গিরিশচন্দ্র সেনের জন্মের আগেই তিনি অনুবাদ সম্পন্ন করেছেন। টাঙ্গাইলের মানুষ হিসেবে ‘বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার, টাঙ্গাইল’-এ মৌলভী নইমুদ্দীন সম্পর্কে যে-বিবরণ ছাপা হয়েছে, তাতে তাঁর এই অনুবাদের সময়কাল ১৮৯২ থেকে ১৯০৮ সাল মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই হিসেবে তিনি ভাই গিরিশচন্দ্র সেন কর্তৃক প্রথম খণ্ডের অনুবাদ প্রকাশের অন্তত ১১ বছর পর এই কাজটি করেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া যায়।


কোরআনের বাংলা অনুবাদ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে অনেকেই গবেষণা করেছেন, অনেকেই বই লিখেছেন। এপার-ওপার উভয় বাংলায়। বই লিখেছেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়েও। আমি নিজেও একটি বই লিখেছি তাঁকে নিয়ে। আমার এই যৎকিঞ্চিত জ্ঞানের কথা বাদ দিলেও বহু জ্ঞানী-গুণীর উদাহরণ টানা যায় এক্ষেত্রে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক অমলেন্দু দে, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল অদুদ, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান, অধ্যাপক অমিত দে, মোফাখখার হুসেইন, ড. সফিউদ্দিন আহমদ ও কবি আবদুল কাদিরসহ বিশিষ্টজনের লেখায় ও গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ভাই গিরিশচন্দ্র সেনই বাংলা গদ্যে পবিত্র কোরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদক।


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মুজীবুর রহমানের পিএইচডি থিসিসের বিষয়বস্তু ছিলো ‘বাংলা ভাষায় কোরআন চর্চা’। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-কোরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল অদুদেরও পিইচডি থিসিস ‘বাংলা ভাষায় কোরআন চর্চা’। মোফাখখার হুসেইন রচিত গবেষণা গ্রন্থ ‘পবিত্র কুরআন প্রচারের ইতিহাস ও বঙ্গানুবাদের শতবর্ষ’। অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদের গবেষণা সমৃদ্ধ বইয়ের শিরোনামই হচ্ছে ‘কোরানের প্রথম অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন’। এর প্রতিটিতেই একই সত্য প্রতিষ্ঠিত যে, প্রথম সম্পূর্ণ কোরআনের বাংলা অনুবাদক আর কেউ নন, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন।


কোরআন এক মহাগ্রন্থ। ঐশ্বরিক গ্রন্থ। কোরআন বলছে, এর বাণী গোটা মানবজাতির উদ্দেশ্যে, মানবজাতির পথ প্রদর্শনের জন্যে। কোরআন যাঁর মাধ্যমে নাজিল হয়েছে, সেই রসুল মোহাম্মদ (সা.) বিদায় হজ্জের ভাষণে এর বাণী ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান রেখেছেন। স্বয়ং আল্লাহতায়ালা ও রসুল (সা.)-এর যখন এমন ঘোষণা, তখন কোরআনের অনুবাদক ব্রাহ্ম নাকি হিন্দু, এমন সংকীর্ণ চিন্তা আদৌ শোভা পায় কি? না, মোটেই নয়। ভিন্ন ভিন্ন ভাষার মানুষের বোঝার জন্যে অনুবাদ একটি অপরিহার্য বিষয়। বাংলাভাষীদের জন্যে ভাই গিরিশচন্দ্র সেন এই কাজটি করেছেন প্রথম। কিন্তু তাতেই কি শেষ? না, তা-ও নয়। পরবর্তীকালে আরো অনেকেই বাংলায় অনুবাদ করেছেন। এখনো অনেকে করছেন। ভবিষ্যতেও হয়তো করবেন। কিন্তু প্রথমে যিনি অনেক প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এই দুরূহ কাজটি করলেন, তাঁকে সেই স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা কেন কারো কারো, তা বোধগম্য নয়। অমুসলিমের দ্বারা এই মহৎকর্ম, সে-কারণেই কি? এমনটা হলে তা সত্যিই দুঃখজনক, মুসলমানদের জন্যেও লজ্জাজনক। যাঁদের নাম উল্লেখ করে, যাঁদেরকে এই কৃতিত্বের মুকুট পরাতে এই কসরত, তাঁরা নিজেরাও পরলোকে থেকে লজ্জায় কুণ্ঠিত হবেন নিশ্চয়ই। তাঁরা কেউ জীবদ্দশায় এমনটা কখনো দাবি করেননি। তাঁদের অনূদিত গ্রন্থ এ-দেশের কোনো প্রাচীন লাইব্রেরি বা আর্কাইভে আছে, তেমনটাও জানা নেই। অথচ ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের অনূদিত প্রথম খণ্ড সেই কালেই ক্যাটালগিং হয়ে আছে বেঙ্গল লাইব্রেরিতে। ক্যাটালগ নম্বর ৭৬৫৯-৬০। ১৮৮২ সালের ঐ-লাইব্রেরির ত্রৈমাসিক বিবরণীতে ইংরজিতে লেখা আছে, “এই বইটি আরবি থেকে বাংলায় অনূদিত কোরআনের প্রথম খণ্ড। অনুবাদক আশা করছেন ১২ খণ্ডে তিনি এর অনুবাদ শেষ করতে সক্ষম হবেন।”


আরো উল্লেখ করতে চাই, ভাই গিরিশচন্দ্র সেনই কোরআনের একমাত্র অমুসলিম অনুবাদক নন। আরো অনেক অমুসলিম এর অনুবাদ করেছেন গ্রিক, ল্যাটিন, চীনা, রুশ, চেক ও ইংরেজিসহ পৃথিবীর নানা ভাষায়। এতে করে ঐসব ভাষাভাষী মানুষ কোরানের বাণী পড়ার ও বোঝার সুযোগ পেয়েছে। আর বাংলায় ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদেই প্রথম কোরআন পাঠ হয়েছে বাংলা ভাষাভাষী অসংখ্য মানুষের। এ কি কম কথা! এজন্যে মুসলমানদের গর্বিত হওয়া উচিত।


কোরআন অনুবাদই নিঃসন্দেহে তাঁকে ব্যাপক পরিচিতি দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন এর চেয়ে ঢের বড়ো মাপের কিছু। সাদা মনের মানুষ। বাংলা গদ্যরীতিতে নিজস্ব স্টাইল তৈরি করা সুসাহিত্যিক, একান্ত নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক, সংবাদপত্রের সম্পাদক, নারী শিক্ষার অগ্রদূত। তাঁর দ্বারা পাঁচদোনায় প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়টি ছিলো এই অঞ্চলে নারী শিক্ষার প্রথম দীপশিখা। তাঁর জীবনকালব্যাপী চল্লিশ বছর আলো জ্বালিয়েছে এই বিদ্যালয়। ময়মনসিংহের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টিও তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ বিদ্যালয়ে তিনি বিনা বেতনে শিক্ষকতাও করেন। জীবন সায়াহ্নে তিনি তাঁর পৈতৃক সহায়-সম্পত্তি পাঁচদোনার মানুষের কল্যাণে ব্যয়ের জন্যে উইল করে দিয়ে যান।


আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ এই মহতী মানুষটির মৃত্যু দিবস। আমি তাঁকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। তাঁর অমর কীর্তি বিরোধী সকল অপলাপ, অপপ্রচার বন্ধ হোক। সত্য চিরভাস্বর হয়ে থাকুক। এমনটাই প্রত্যাশা আমার।


সিরাজ উদ্দিন সাথী

প্রাবন্ধিক, গবেষক ও ‘ভাই গিরিশচন্দ্র সেন : জীবন ও তৎকালীন সমাজ’ গ্রন্থের রচয়িতা



সূত্র: ব্রহ্মপুত্র নরসিংদী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ