কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ফেবু পরিসরে ২টা মিথ বাস্ট করবো আজকে:
১। কাজী নজরুল ইসলাম ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন।
না, কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যাদর্শ ছিল ইসলাম, একমাত্র ইসলাম। কাজীদা বাঙালি মুসলিম নবজাগরণের উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। অধিক বাকবিস্তার না করে দৈনিক নবযুগ পত্রিকায়, ১৯৪১ ঈসায়ীতে তিনি নিজেই কি লিখেছিলেন দেখি:
"আল্লাহ আমার প্রভু, রসূলের আমি উম্মত, আল-কোরান আমার পথ প্রদর্শক এছাড়া আমার কেউ প্রভু নাই, শাফায়েত দাতা নাই, মুর্শিদ নাই আমি মুসলিমকে সঙ্গবদ্ধ করার জন্য, তাদের জড়ত্ব, আলস্য, কর্মবিমুখতা, অবিশ্বাস দূর করার জন্য আজীবন চেষ্টা করেছি.... আমার কাব্য শক্তিকে খাটো করেও গ্রামোফোন রেকর্ডে শত শত ইসলামী গান রেকর্ড করে নিরক্ষর তিন কোটি মুসলমানদের ঈমান অটুট রাখারই চেষ্টা করেছি।"
১৯৩২ ঈসায়ীর ৫ ও ৬ নভেম্বর, সিরাজগঞ্জের নাট্যভবনে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলমানদের সম্মেলনে কাজীদা বলেন:
"আমরা চাই সিদ্দিকের সাচ্চাই, ওমরের শৌর্য ও মহানুভবতা, আলীর জুলফিকার, হাসান-হোসেনের ত্যাগ ও সহনশীলতা। আমার চাই বেলালের প্রেম।"
১৯৩৬ ঈসায়ীতে মাদ্রাসার মাওলানা সাহেবদের কাজীদা আরজ করেন:
"আমি আমার সাহিত্যে ইসলামের সেবা করিয়া আসিতেছি। আরবি-ফার্সি শব্দের প্রচলন বাংলা সাহিত্যে আজ বহুল পরিমানে ব্যবহৃত হইতেসে--তাহাও এই বান্দার চেষ্টায়। আমি 'মক্তব সাহিত্য' নাম দিয়া একখানি পুস্তিকা লিখিয়াছি। আপনারা যদি আমাকে মদদ দেন এবং আমার কেতাবখাননি আপনাদের মাদ্রাসার জন্য মনোনীত করিয়া এই খাদেমকে সাহায্য করেন তাহা হইলে ইনশাল্লাহ ভবিষ্যতে মক্তব-মাদ্রাসার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত বাঙলা পুস্তক রচনায় মন দিব এই রূপে কওমের সেবা করিতে থাকবো।"
তবে, কাজীদা জাতিবাদ ঘৃণা করেও, তামাম মুসলিমের সংহতি কামনা করেও, আমাদের গানের পাখি, আব্বাসউদ্দীনের জন্য ১৯৩৫ ঈসায়ীতে লিখলেন:
"ধর্মের পথে শহীদ যাহারা আমরা সেই সে জাতি সাম্য-মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্ব করেছি জ্ঞাতি। নারীরে প্রথম দিয়েছি মুক্তি, নর সম অধিকার মানুষের গড়া প্রাচীর ভাঙিয়া করিয়াছি একাকার আঁধার রাতির বোরখা উতারি এনেছি আশার ভাতি। আমরা সেই সে জাতি।"
এখনকার মতো তখনও হিন্দুস্তানের মুসলিমদের কোরবানি দেবার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলতো। তরিকুল আলম বলে, নাম ভাড়িয়ে, একজনকে দিয়ে বাঙ্গালা ১৩২৭- এর শ্রাবণ মাসে ঠিক, ঈদ উল আজহার পূর্বে, "আজ ঈদ" নাম দিয়ে কোরবানির বিরুদ্ধাচারণ
করে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্রে একটা প্রবন্ধ ছাপানো হয়; প্রবন্ধটি টেক্সট বহিতে পাঠ্যও হয়ে যায়। নজরুল এর প্রতিবাদে কোরবানি কবিতা লেখেন:
"ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন
দুর্বল ! ভীরু ! চুপ রহো, ওহো খামকা ক্ষুব্ধ মন।
আজ শোর ওঠে জোর, খুন দে জান দে,
শির দে বৎস শোন !"
যেই জওহরলাল নেহেরু সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি ভারতীয় সংবিধানে গ্রহণ করছেন তিনি এসময়, আসলে, কি আমল করছেন? কুলদীপ নায়ার, স্টেটসম্যান পত্রিকায় তার বিখ্যাত "বিটুইন দ্যা লাইন" উপসম্পাদকীয়তে বলছেন, নেহেরু প্রধান মন্ত্রী থাকা কালেই গোপন সার্কুলার জারি করা হয়েছিল, ভারতীয় মুসলমানদের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে দূরে রাখার জন্য। কমলেন্দু ধর "ভারতীয় রাজনীতির বিপণন" গ্রন্থের ১০৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, জওহরলাল নেহেরু প্রধানমন্ত্রী ও বল্লভভাই প্যাটেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন,ভারত সরকার একটা গোপন সার্কুলারে, "প্রশাসনের মূল ও নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রগুলিতে মুসলিমদের অনুপ্রবেশ রুখতে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।"
এখানে, সেকুরালিজমের নামে ভারতীয় একজাতিতত্ত্বর প্রচার, উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি নিয়ে অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
2. আরেকটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর মিথ হইতেসে,
রবিবাবু আর কাজীদার তুলনা করা যাবে না।
অথবা, তুলনা করলে কে এলিট আর কে দলিত তুলনা করতে হবে, সাহিত্যের নাকি তুলনা হয় না। ছোট কবি-বড় কবি বিতর্ক নাকি অসার, অপ্রয়োজনীয ও অপ্রায়োগিক। এক শ্রেণীর গান্ডুরা বলবে, কবি বা শিল্পীরা পাহাড়, নাকি নদী যে গজফিতা দিয়ে মেপে বলে দেয়া যাবে, কেওক্রাডংয়ের চাইতে এভারেস্ট বড়, কিংবা বুড়িগঙ্গা থেকে গঙ্গা! ওই মূর্খরা শুন, অতিঅবশ্যি, "গজফিতা" আছে, যা দিয়ে মেপে বলা যাবে, রবীন্দ্রনাথ বড়, নাকি, নজরুল। এই "গজফিতা"-র একটি বড় অংশ যদি হয় এস্থেটিক্স, রেটোরিক্সসহ
দর্শন ও রসশাস্ত্ৰ, এগুলোর ইতিহাস ও বিবর্তন; এই "গজফিতা"-র অন্ততঃ এক ভগ্নাংশ হইতেসে এই "গজফিতা" ও এর পশ্চিমা পরিমাপ জল্পনার বৈধতা নিয়ে বিতর্কের দীর্ঘ সিলসিলা। এই বেপারটিকেই, বোধহয়, সুকুমার রায় ব্যঙ্গ করে বলসিলেন,
ব্যাঙ কী জানে তার একটা ল্যাটিন নাম আছে? বিখ্যাত মার্কিন আর্টিস্ট, বার্নেট নিউম্যান, বলেছিলেন, শিল্পীদের এস্থেটিক্স পড়া আর পাখির অর্নিথোলজি পড়া একই রকম অপচয়ী। কবিশিল্পীদের এই অহংকার ও পান্ডিত্বের প্রতি অবিশ্বাস আমার খুব পছন্দের।
কিন্তু, মূর্খ মুঠঠি মাড়ুয়াদের দাপটের দেশে, সব কিছু সহজ করে ফেলা, সস্তা করে ফেলা সময়ে, বাজারি আর ভোগ-উপভোগ্য করে ফেলার পরিবেশে, এই ধরণের উচ্চারণের বিপদও যেন আমরা আমলে রাখি।
এই বিপদের একটা বড় কারণ "ক্রিটিকাল থিওরি" হিসাবে প্রচলিত একটা জগাখিচুড়ি, যা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, দুই প্রবংশের ছাত্রদের পোস্ট স্ট্রাকচারালিজম ও পোস্ট মডার্নিজম-এর নামে শিখিয়েছে,
"সত্য বলে কিছু নেই, স্ট্যান্ডার্ড বলে কিছু নেই, এসেন্স বলে কিছু নেই, --সব সোশ্যাল কনস্ট্রাকশন ; সব আপেক্ষিক!!"
না, সব আপেক্ষিক নয়। অবশ্যই, বিথোফেন ও বিটলস-এর তুল্য কইরা কে হন বেশি ভালো ও বড় তা বিচার সম্ভব। অবশ্যই, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের-এর তুল্য কইরা, কে বেশি ভালো ও বড় কবি তা বিচার সম্ভব। এই যে মাপার বাটখারা, এই যে "বিচার"--এই বিচার করার যে স্ট্যান্ডার্ড, তার মূল্যনীতি ও মেথডোলজি, এটাই আমাদের উচ্চ ও উন্নত শিক্ষা। অর্থাৎ শিক্ষিত লোক বিচার করেন ও করতে জানেন; এবং এই জানাটা আন্তর্জাতিক; এই জানাটা আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি ও আলোকপ্রাপ্তি বা রেনেসাঁর দান।
এখন, এই শিক্ষা বা এর স্ট্যান্ডার্ড বা আলোকপ্রাপ্তি নিয়ে যে সমালোচনা, সেটাও রেনেসাঁর আরেকটি দান। আমরা এটি কতটুকু গ্রহণ করবো, কীভাবে সমালোচনা করে গ্রহণ করবো এটি জাতি হিসাবে আমাদেরই ঠিক করতে হবে। কিন্তু, এটি গ্রহণ না করে গাজোয়ারী করতে গেলে, ওই কুৎসিত মূর্খতা কোথাও গৃহীত হবে না। আমরাও এগোতে পারবো না। এবং নজরুল আর রবিবাবুর তুলনার একটা ম্যাপ আমি এখানেই দিয়ে দিতেসি:
১৯২০-এর মার্চে সেনা বাহিনী থেকে প্রত্যাবর্তন করে কলিকাতার সাহিত্য অঙ্গনে নজরুলের মাত্র অনুপ্রবেশ যখন ঘটে, তাঁর বয়স তখন ২০ বছর ৮ মাস। নজরুল একদম অসুস্থ হয়ে পড়েন ১৯৪২, ৯ই অক্টবর। এর মধ্যে ১৯৩০ -এর পর নজরুল, মূলতঃ
তাঁর নিজের ভাষায়, তাঁর প্রতিভার অপচয় করেছেন, জীবিকার প্রয়োজনে, পুরোপুরি সংগীত জগতে কাজ করে। একজন কপর্দকশূন্য, মুসলমান বিপ্লবী, যিনি বার বার জেল খাটছেন, মুসালমান সমাজে অপদস্ত হচ্ছেন, হিন্দু প্রতিষ্ঠান ও পরিষেবা
যার জন্য উন্মুক্ত নয়--সেই মানুষটি সাকুল্যে লিখেছেন ২৩ বছর। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ৬৩ বছরের বেশি। তারপরও একুশ-একত্রিশ বয়ঃসীমার কবি কাজী নজরুল ইসলাম
ও
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত কাব্যসামগ্রীর নান্দনিক ও রস বিচার কোন আন্তর্জাতিকমানের তাত্ত্বিক/সমালোচক করুন, তারপর দেখবেন ফল কি দাঁড়ায়। আপাততঃ এতটুকুই আমার বলা। বাকিটুকু ভবিষৎ পন্ডিতরা বলবেন।
সেলাম
--------
খুব সামান্য মানুষের জীবনও অনেক দৈব ও নিয়ামতে ভরা। যেমন, আমার জন্মদিন ও কাজীদার জন্মদিন একই দিনে। আমার মাতুল, মোস্তফা সারওয়ার, কাজী নজরুল ইসলামকে শত বাঁধা অতিক্রম করে বাংলাদেশে আনতে সমর্থ হন, ১৯৭২ ঈসায়ীর, ২০মে।
ধানমন্ডি স্থিত কবিভবনে নজরুলের বাসের ব্যবস্থায়ও মোস্তফামামার কিছু হাত ছিল, ধারণা করি। ১৯৭২ ঈসায়ীর ২৮ নভেম্বর, কাজীদা প্রকৃতি দেখতে চাইলে, তাঁকে, মোস্তফামামা, রামপুরা বেড়াতে নিয়ে যান। মোস্তফা মামা ও নজরুলের নিচের ছবিটি সে সময় তোলা।
সুত্র: ফেসবুক পোস্ট
* লেখকের পরিচয়: সম্পূর্ণ নাম 'এবাদুর রহমান', ফেসবুকের নাম দিয়েছেন 'এবাদ রহমান', পূর্বে এই একাউন্টের নাম রেখেছিলেন 'এবাদ এবাদ'। তিনি 'গরিলা', 'মেহেরজান' এর মত বিখ্যাত সিনেমাগুলোর চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন। তিনি একজন সুখ্যাত উপন্যাসিক।
তাঁর বিস্তারিত পরিচয়ের জন্য নিচের সাইটদুটো দেখুন
- লিংকডইন: ebadur-rahman
- উইকিপিডিয়া: Ebadur_Rahman
0 মন্তব্যসমূহ