মীরসরাইয়ে হিজাব পরায় মারধর: বানোয়াট কাহিনি, মেলেনি প্রমাণ

 

জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়,  মীরসরাই, চট্টগ্রাম
হিজাব ইস্যুতে জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে ঢাকা ট্রিবিউন


মীরসরাইয়ে হিজাব পরায় মারধর: বানোয়াট কাহিনি, মেলেনি প্রমাণ


পুরো স্কুলজুড়ে থাকা ৭০টি সিসিটিভি ফুটেজের একটিতেও এমন অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। এদিকে, অভিযোগকারী ছাত্রীর মা বিষয়টি জানেনই না। প্রধান শিক্ষককে হেনস্তা করে ওই ছাত্রীর চাচা পরিচয় দেওয়া চার ব্যক্তি


পিম্পল বড়ুয়া, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ১১:০৫ দুপুর এপ্রিল ১০, ২০২২


গত মাসের শেষদিকে চট্টগ্রামের এক স্কুলছাত্রী অভিযোগ করে, হিজাব খুলতে রাজি না হওয়ায় প্রধান শিক্ষক তাকে গালমন্দ ও মারধর করেছেন। তবে ওই স্কুলছাত্রী এ দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। ঢাকা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানেও তার অভিযোগের সত্যতা মেলেনি।


ঘটনার দিন পিটি সেশনের পর তাকে মারধর করা হয় বলে ওই ছাত্রী অভিযোগ তুলেছিল। কিন্তু স্কুলের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ঘেঁটে দেখা গেছে, সেদিন সে পিটিতে অংশই নেয়নি। ওইদিন সে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরিতে স্কুলে আসে। অভিযোগকারী ছাত্রী তার দুই সহপাঠীকে ঘটনার সাক্ষী হিসেবে দাবি করেছিল। তারা জানায়, সেদিন পিটির পর প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে ওই ছাত্রীর দেখাই হয়নি।


সহপাঠীর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করে তারা আরও জানায়, কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই তাদের সাক্ষী করা হয়েছে।


গত ২৯ মার্চ চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়ার বিরুদ্ধে এক ছাত্রীকে হেনস্তা ও মারধরের কথিত অভিযোগ ওঠে। পরদিন (৩০ মার্চ) ওই ছাত্রী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এবং উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেয়।

অভিযোগের সত্যতা পায়নি জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি


মীরসরাইয়ের ইউএনও মিনহাজুর রহমান জানান, অভিযোগটি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, উপজেলা চেয়ারম্যান, জোড়ারগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।


অভিযোগে সাক্ষী হিসেবে যে দুই ছাত্রীকে হাজির করা হয় তাদের একজন ঢাকা ট্রিবিউনকে জানায়, 


“সেদিন পিটি শেষে আমিসহ ক্লাস সেভেনের আরও দুই ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলেন প্রধান শিক্ষক। কিন্তু তিনি আমাদের মারধর করেননি। জিজ্ঞেস না করেই আমাদের নাম সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পরিস্থিতির বিস্তারিত শুনে জানাই, স্যার আমাদের মারধর বা বকাঝকা করেননি।”


স্কুলের সিসিটিভি ফুটেজ যাচাই করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ঘটনার দিন পিটি শেষে বেলা ১০টা ৫৪ মিনিটে তিন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেন প্রধান শিক্ষক। কিন্তু তাদের মধ্যে অভিযোগকারী ছাত্রী ছিল না।


ইউএনও মিনহাজুর রহমান বলেন, 


“ওই ছাত্রীর অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তদন্ত কমিটি সিসিটিভি ফুটেজ যাচাই করেছে। সেখানে মারধরের মতো কোনো কিছুই চোখে পড়েনি।”


স্কুলে ঢুকে শিক্ষকদের হেনস্তা


মিথ্যা অভিযোগের শিকার জেবি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়া ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, 


“ঘটনার দিন আমি পিটিতে অংশ নেওয়া তিন ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু ৮ম শ্রেণির লামিয়া (অভিযোগকারী) নামের মেয়েটি তাদের মধ্যে ছিল না। সেদিন সে দেরিতে স্কুলে এসেছিল। স্কুলবাসের চালক এবং তার সহপাঠীরা পরে আমাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বিষয়টি এতদূর গড়াতে পারে তা আমি ধারণাও করিনি।”



ঘটনার দিন চার যুবক বিদ্যালয়ে এসে ওই ছাত্রীর চাচা পরিচয়ে প্রধান শিক্ষককে শাসায় ঢাকা ট্রিবিউন
ঘটনার দিন চার যুবক বিদ্যালয়ে এসে ওই ছাত্রীর চাচা পরিচয়ে প্রধান শিক্ষককে শাসায় ঢাকা ট্রিবিউন

তিনি আরও বলেন,


 “ঘটনার দিন মেয়েটির চাচা পরিচয়ে একজন আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে এসে আমাকে অপদস্থ করে। আমি তাদের শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানাই, কিন্তু তারা রুঢ় আচরণ চালিয়েই যেতে থাকে। একপর্যায়ে তারা আমার কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায় এবং স্কুলের ধর্ম শিক্ষককে মারধর করে। যা আমাদের জন্য যথেষ্ট অপমানের।”


অভিযোগকারী ছাত্রীর মা কিছুই জানেন না


স্কুল কমিটির সভাপতি মাকসুদ আহমেদ চৌধুরী জোড়ারগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি এ ঘটনায় একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। সেই কমিটিও ওই ছাত্রীর অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি।


তিনি আরও বলেন,


 “আমাদের স্কুলে ৭০টি সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। পুরো স্কুলের সব জায়গা সার্বক্ষণিক সেগুলোর মাধ্যমে নজরদারি করা হয়। কর্তৃপক্ষ সবগুলো ফুটেজই পুঙ্খানুপূঙ্খভাবে খতিয়ে দেখেছে, কিন্তু এমন কিছু পাওয়া যায়নি। ওই ছাত্রীর অভিযোগ সন্দেহজনক।”


স্কুল কমিটির সভাপতি দিয়েছেন আরও চমকপ্রদ তথ্য। মাকসুদ আহমেদ চৌধুরী জানান, ওই ছাত্রীর মায়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। অথচ এই অভিভাবক ঘটনার কিছুই জানেন না।


প্রধান শিক্ষককে অব্যাহতির নির্দেশনা


এদিকে, স্কুল কমিটির নির্দেশে সাময়িক অব্যাহতিপত্র দিয়েছেন বলে ঢাকা ট্রিবিউনকে জানান প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়া।


তিনি বলেন, 


“চট্টগ্রাম জেলায় এই স্কুলের একটা সুনাম আছে। আমার মনে হচ্ছে হিজাবকে ইস্যু করে একটি পক্ষ কোনো ফায়দা লুটতে চাইছে।”


তিনি আরও বলেন, 


“আমাদের স্কুলড্রেসের বিষয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ভর্তির সময় নির্দেশনা দেওয়া হয়। স্কুলের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে ড্রেস কোডের বিষয়টি ব্ল্যাকবোর্ডের পাশে লেখা থাকে। শিক্ষার্থীদের যথাযথ পোশাকে স্কুলে আসার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত নির্দেশনা দিয়ে থাকি। হিজাব ইস্যুকে সামনে আনার পেছনে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয়। এরপরেও এমন একটি ঘটনা আমাকে যথেষ্ট পীড়া দিয়েছে।”


কথিত অভিযোগ আনা শিক্ষার্থীর ভাষ্য


সব তথ্য-প্রমাণ যাচাইয়ের পর শিক্ষকের বিরুদ্ধে কথিত অভিযোগ আনা শিক্ষার্থী লামিয়ার সঙ্গেও কথা বলে ঢাকা ট্রিবিউন। তবে দাবির পক্ষে অনড় থেকে সে বলে, ওইদিন পিটির পর প্রধান শিক্ষক তাকে মাঠে ডেকে পাঠান এবং হিজাব পরার কারণে তাকে মারধর করেন।


লামিয়ার ভাষ্য, 


“ঘটনার পর স্কুলের শিক্ষক রবিউল স্যারের সহায়তায় আমি বাসায় বিষয়টি জানাই। খবর পেয়ে আমার চাচা মহিব বিল্লাহ তার তিন চাচাতো ভাই জাহিদুল হাসান তুষার, মেহেদি হাসান এবং আমজাদকে নিয়ে স্কুলে আসেন। তারা স্যারদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন।”


তাকে মারধরের কোনো ছবি সিসিটিভি ফুটেজে নেই কেন এমন প্রশ্নের জবাবে সে বলে, তা আমি জানি না।


সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ