শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল: সরকারের উদাসীনতা অনাকাঙ্ক্ষিত
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২২ । ০২:৪৭ ।
ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে আবারও শিক্ষক অবমাননা ও নির্যাতনের দুঃখজনক একটি ঘটনা ঘটেছে। এবারের ঘটনাটি ঘটেছে মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে, আর ঘটনার শিকার ওই স্কুলের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। শুক্রবার সমকালের এক প্রতিবেদনে যেমনটি বলা হয়েছে, হৃদয় মণ্ডল ২০ মার্চ ওই বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ক্লাসে বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনার সময় গোপনে তার বক্তব্যের অডিও ধারণ করে কয়েকজন ছাত্র। অডিওতে শিক্ষকের আলোচনার সময় বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কয়েক ছাত্রকে বারবার ধর্মের প্রসঙ্গ টেনে প্রশ্ন করতে শোনা যায়। ওই অডিও পরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। শুরু হয়ে যায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে মিছিল-সমাবেশ। এরপর পরিস্থিতি শান্ত করার কথা বলে পুলিশ হৃদয় মণ্ডলকে আটক করে। ওই রাতেই বিদ্যালয়ের এক অফিস সহকারী 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও কোরআন অবমাননা'র অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে সদর থানায় মামলা করেন। পরদিন ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে হৃদয় মণ্ডলকে কারাগারে পাঠানো হয়। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের একটি আলোচনাকে ধর্মীয় অবমাননার রং দিয়ে তারই ছাত্র কর্তৃক এভাবে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির প্রয়াস যে কোনো সচেতন মানুষের মনে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি না করে পারে না।
আমরা এর আগে ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জেও প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখেছি। সেখানেও এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তকে প্রথমে তার ছাত্ররা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে হেনস্তা করে, পরে স্থানীয় সাংসদ তাকে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করিয়ে আবারও চরমভাবে অপমানিত করেন। তা ছাড়া গত কয়েক বছরে দিনাজপুর, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়ও আমরা বেশ কয়েকজন শিক্ষককে একইভাবে লাঞ্ছিত হতে এবং কারাগারে যেতে দেখেছি। একজন সত্যিকার শিক্ষকের কাজই হলো শিক্ষার্থীদের মনে জগৎ ও জীবনসংশ্নিষ্ট নানা বিষয়ে কৌতূহল তৈরি করা এবং সেগুলোর সমাধান দেওয়া। তা করতে গিয়ে কোনো শিক্ষক যদি অতিরিক্ত কিছু করেন এবং তা যদি কোনো শিক্ষার্থীকে সংক্ষুব্ধ করে তোলে তাহলে সংশ্নিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরেই- অর্থাৎ প্রধান শিক্ষক এবং প্রয়োজনে ব্যবস্থাপনা কমিটিকে যুক্ত করে তার সমাধান খোঁজা উচিত। তা না হলে শিক্ষার পরিবেশ বলে কিছু আর থাকে না, শিক্ষকও মুক্তমনে তার কর্তব্য পালন করতে পারেন না। এ অবস্থায় শিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য তা মার খেতে বাধ্য। কিন্তু আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একদল শিক্ষার্থী কর্তৃক, বিশেষ করে অমুসলিম ও মুক্তমনা শিক্ষকদের ধর্ম অবমাননার ফাঁদে ফেলে হেনস্তা করার একটা প্যাটার্ন গড়ে উঠেছে; অথচ সরকারের দিকে থেকে এর প্রতিকারমূলক কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। বলাবাহুল্য, নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় দেশব্যাপী প্রবল প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই তদন্তে প্রমাণিত হয় শ্যামলকান্তি কোনো ধর্ম অবমাননা করেননি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ওই ঘটনাটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘটানো হয়েছিল তা প্রমাণিত হওয়ার পরও সরকার এমন ঘটনা বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি, এমনকি শ্যামলকান্তিও কোনো প্রতিকার পাননি।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সরকারের এ উদাসীনতা শুধু এ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া পোস্ট ও ছবি দিয়ে ধর্ম অবমাননার ধুয়া তুলে সংখ্যালঘু মন্দির ও পল্লিতে হামলা বন্ধেও তাদের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে ২০১৩ সালের রামুর ঘটনা, ২০১৬ সালে নাসিরনগর হামলা এবং সর্বশেষ গত বছর কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার কথা বলে সারাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলার মতো বহু ঘটনার কথা বলা যায়, যেগুলোর একটাতেও ভুক্তভোগীরা কোনো প্রতিকার পায়নি। আমরা মনে করি, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর অপতৎপরতা বন্ধে সরকারের এমন উদাসীনতা শুধু হৃদয় মণ্ডলের মতো শিক্ষকদেরই অনিরাপদ করছে না, হাজার বছর ধরে এদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মাঝে সম্প্রীতির যে বন্ধন গড়ে উঠেছে তাকেও হুমকির মুখে ফেলছে। অবিলম্বে সরকারকে এ উদাসীনতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, শক্ত হাতে দমন করতে হবে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে। এ সূচনা হতে পারে হৃদয় মণ্ডলের নিঃশর্ত মুক্তি এবং তার পরিবারের যথাযথ নিরাপত্তা বিধানের মাধ্যমে।
সূত্র: সমকাল
0 মন্তব্যসমূহ