![]() |
স্ত্রী রুমা চক্রবর্তী ও মেয়ে ঋতু চক্রবর্তীকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নারায়ণগঞ্জ শহরের ডালপট্টি এলাকার রামপ্রসাদ - মেহেদী হাসান সজীব |
নারায়ণগঞ্জে মা-মেয়ে খুন
স্বপ্নীলের বাবা-মা হিসাব মেলাতে পারছেন না
নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২২ । ০০:০০ | আপডেট: ০৩ মার্চ ২২ । ০১:৩০ । প্রিন্ট সংস্করণ
নগরের পাইকপাড়া পুল থেকে পশ্চিম দিকে একটু নামলেই হাতের ডানপাশে একটি ছোট লোহার গেট। গেট ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলেই সরু গলি। গলির শেষ মাথায় আবার একই ধরনের আরেকটি গেট। বাইরে থাকা কলিংবেল চাপলে মাথায় টুপি, মুখে মেহেদি রাঙানো দাড়িওয়ালা এক বয়স্ক লোক গেট খুলে দেন। নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে বাসার দোতলায় নিয়ে যান। এক রুমের ছোট্ট বাড়ি। নিচে ও দোতলায় একটি করেই কক্ষ। পৌনে এক শতাংশেরও কম জমির ওপর বাড়িটি তৈরি।
এটি মঙ্গলবার দুপুরে নগরের নিতাইগঞ্জে মা-মেয়েকে হত্যার ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে তিনটি ছোরাসহ গ্রেপ্তার আল জুবায়ের ওরফে স্বপ্নীলের (২৬) বাবার বাড়ি। আর যে বয়স্ক লোক গেট খুলে দেন, তিনিই স্বপ্নীলের বাবা মো. আলাউদ্দিন। স্বপ্নীল আলাউদ্দিনের একমাত্র ছেলে। নিজের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ারও চিন্তা করেননি। এক সময় একটি ফ্যানের কারখানায় কাজ করতেন। পরে লবণের ব্যবসা শুরু করেন। এর মধ্যে করোনায় গত দুই বছরে মার্কেটে মোটা অঙ্কের টাকা আটকে যায়। বিপাকে পড়েন আলাউদ্দিন। অর্থ সংকটে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র স্বপ্নীলের লেখাপড়া শেষ করাতে পারেননি বাবা। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার দুপুরে তার ছেলের হাতেই পাশের এলাকার একটি ভবনে মা ও মেয়ে খুন হন। এ ঘটনায় তাদের মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কী করবেন, কার কাছে যাবেন বুঝতে পারছেন না।
বাড়িটির দোতলায় একাই থাকত স্বপ্নীল। ঘরে একটি খাট, একটি সোফা ও টি-টেবিল ছাড়া আর কিছুই নেই। রুমের দক্ষিণে থাকা ছোট্ট একটু জায়গায় একটি জায়নামাজ বিছানো। পাশে কোরআন শরিফসহ কিছু ইসলামী বই।
ছেলে সম্পর্কে জানতে চাইলে আলাউদ্দিন বলেন, স্বপ্নীল বরাবরই শান্ত-ভদ্র। এলাকার কারও সঙ্গে মেশে না। ২০১১ সালে এসএসসি ও ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করেছে। দুটিতেই জিপিএ৫। এরপর ভর্তি হয় স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে। প্রথম দুই সেমিস্টারের টাকা দিতে পারলেও পরের সেমিস্টার শেষ করতে পারেনি টাকার অভাবে।
স্বপ্নীলের ঘরের সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও একটি ক্যালেন্ডারে চোখ আটকে যায় এই প্রতিবেদকের। একটি ক্যালেন্ডারের নিচে লেখা 'আহলে হাদিস'। তবে কি বাবা-মায়ের অগোচরে আহলে হাদিসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল স্বপ্নীল। এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি স্বপ্নীলের বাবা। পর্দানশীন হওয়ায় বাইরের কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ দেন না মা পলি বেগম।
বুধবার দুপুরে স্বপ্নীলের বাসার বিপরীতে একটি মনিহারি দোকানের মালিক জিতুর সঙ্গে কথা হয়। জিতু বলেন, স্বপ্নীলের স্থান ছিল তিনটি। একটি বাসা, অপরটি মসজিদ এবং আরেকটি হচ্ছে মুদি দোকান। এই বয়সেও সে ললিপপ খায়, কার্টুন দেখে। এলাকায় সে একাধারে ভদ্র এবং মেধাবী হিসেবে পরিচিত। কোনো বাজে আড্ডা নেই। কোনো বদনাম নেই। কিন্তু এই ছেলেই কিনা জলজ্যান্ত মা-মেয়েকে খুন করে ফেলল।
আলাউদ্দিন জানান, বাসা থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরই ছেলেকে খাবারের জন্য ফোন করেন তার মা। তখন স্বপ্নীল বলে আমি আসছি। কিন্তু ছেলে আর ফেরে না। তখন বিকেল ৩টা বাজে। ছেলেকে খুঁজতে বের হন আলাউদ্দিন। এলাকায় না পেয়ে ফোন দেন ছেলের ফোনে। তখন ফোন ধরেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। বলেন, তার ছেলে দুটি খুন করেছে। এ কথা শুনে হতভম্ব হয়ে পড়েন তিনি।
আলাউদ্দিন বলেন, তার ছেলে সুস্থ-স্বাভাবিক ছিল। তবে এক মাস ধরে একটু অন্যরকম আচরণ করত। কোনো কিছু বললে উল্টো রিয়েক্ট করত। তারা কিছু বুঝতেন না। তবে ছেলে কেন এমন কাজ করল সেটি কোনো হিসেবেই মেলাতে পারছেন না।
মামলা :৩ দিনের রিমান্ডে
এদিকে নগরের ডালপট্টি এলাকায় 'মাতৃভবন' ভবনের ষষ্ঠ তলার ফ্ল্যাটে মা-মেয়েকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। ঘটনার পর ধারালো ছুরিসহ আটক স্বপ্নীলকে একমাত্র আসামি করা হয়েছে। বুধবার দুপুরে নিহত রুমা চক্রবর্তীর স্বামী রামপ্রসাদ চক্রবর্তী বাদী হয়ে মামলাটি করেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে স্বপ্নীলকে আদালতে পাঠায়। আদালত শুনানি শেষে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিকে পুলিশ জানিয়েছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বপ্নীল স্বীকার করেছে, সে অবসাদগ্রস্ত ছিল। টাকা ও অলংকার লুট করতে গিয়ে বাধা পেয়েই এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটিয়েছে। তবে আমরা আরও খুঁটিনাটি বিষয় সামনে এনে তদন্ত চালাচ্ছি। তদন্তেই সব বেরিয়ে আসবে। সে আরও জানিয়েছে, নিহত মা-মেয়ে ও তার পরিবারের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি :নারায়ণগঞ্জে মা ও মেয়েকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। এ ঘটনায় জড়িতের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন সংগঠনের নেতারা। গতকাল এক বিবৃতিতে মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম ও সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু এ দাবি জানান।
তারা বলেছেন, এ ধরনের সহিংস ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ সবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
সূত্র: সমকাল
0 মন্তব্যসমূহ