অগ্নিবীরে যোগ দিলাম কেন? - উদয় কুমার উৎস

অগ্নিবীরে যোগ দিলাম কেন? কারণ ও ব্যাখ্যা - উদয় কুমার উৎস


"রাধা সে তো নয়তো কোনো নারী

যে করে কৃষ্ণের আরাধনা রাধা নামটি তারই।"


৫ বছর আগে ইত্যাদিখ্যাত জীবনমুখী শিল্পী অর্জুন বিশ্বাসের এই গানটি আমার জিজ্ঞাসু মনকে কড়া নাড়ে। আমি তখন রাখা-কৃষ্ণ যুগল মূর্তির অনুসারী ছিলাম। ইসকন এবং বিভিন্ন বৈষ্ণবীয় মতগুলোর সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে যুক্ত ছিলাম। এমনকি তথাকথিত মহামন্ত্র হরেকৃষ্ণ জপ করার জন্য এনালগ কাউন্টার কিনেছিলাম হরেকৃষ্ণ জপ কতবার করলাম তার হিসাব রাখার জন্য।


যাই হোক, রাধাকে নিয়ে অর্জুন বিশ্বাসের এমন গানে আমি কষ্ট পেয়ে তাকে কল করে বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করি, "দাদা, আপনার এই গানটার মানে বুঝতে পারলাম না। এত এত মানুষ রাধাকে কৃষ্ণের সাথে পূজা করছে আর আপনি রাধাকে নিয়ে এরকম গান লিখেছেন কেন?" উত্তরে তিনি তার স্বপক্ষে কিছু যুক্তি দেখান যা সত্যও হলে প্রথমত তেমন গ্রহণযোগ্য ছিল না আমার কাছে।


আমি ইসকনের প্রভুদের, গীতা পাঠকদের এবং বৈষ্ণবদের মধ্যে যারা একটু জানে তাদেরকে প্রশ্ন করেছিলাম রাধার অস্তিত্ব নিয়ে। উত্তরে কেউ রাধা কৃষ্ণের বাম অঙ্গ থেকে থেকে সৃষ্টি, কেউ অষ্টসাত্ত্বিক ভাবের কথা বলেছেন। আবার কেউ তো রাসমন্ডলের অনয়া রাধিতম শ্লোককে রাধার অস্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরেছিল। কিন্তু এই অনয়া রাধিতম শব্দের অর্থ হলো, "সে(কৃষ্ণ) কি অন্য কারও আরাধিত হয়ে কোথাও চলে গেছে?" মনে সন্দেহের বীজ বপন করাই রইল। সন্দেহ থেকে উত্তরিত হতে পারলাম না এসব ভ্রান্ত যুক্তিতে।


এরপর আসে নতুন সময়। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে আমার অধ্যয়নরত প্রতিষ্ঠান কারমাইকেল কলেজের মন্দির কর্তৃক নবীন বরণের আয়োজন করে একটি সংগঠন। সেখানে প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকেন একজন বক্তা। আমি সহ অনেকেই তাকে রাধা সম্পর্কে প্রশ্ন করে রাধার অস্তিত্ব কি সত্যিই আছে? রাধা না থাকলে কৃষ্ণের সাথে রাধা কেন পূজিত হয়। তখন তার প্রদত্ত যুক্তিগুলো আমার হৃদয়গ্রাহী হয়। তিনি বক্তব্যে বলেন যে রাধাকৃষ্ণ সম্পর্কে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কুরুচিপূর্ণ যেসব কথাবার্তা বলা আছে সেটি দেখলে আপনারা আঁতকে উঠবেন। এছাড়া মুসলিম শাসনামলে পুরাণে যে কাঁটাছেড়া করা হয়েছে সেটাও তিনি উল্লেখ করেন এবং রাজহাঁস যেমন দুধ এবং জল মিশিয়ে দিলে সেখান থেকে শুধুমাত্র দুধটুকু গ্রহণ করে সেভাবে পুরাণকে গ্রহণ করার কথা বলেন। পরবর্তীতে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতি খন্ড দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ! এই হলো আমার ধর্মের পথে আসার প্রথম পর্যায়।


এরপর কিছু সময় পর একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের সাথে আমার দহরম-মহরম সম্পর্ক হয়। তার প্রত্যেক আদেশ ও উপদেশ পালন করতে থাকি নিয়মিত। কখনো তার রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হলেও ভাবতাম যে, এসব গায়ে মেখে কাজ নেই, আমি যা করছি সব আমার জাতির মঙ্গল এবং কল্যাণের জন্যই। করোনাকালীন সময়ে আমাদের সমাজের মানুষদের ধর্মীয় জ্ঞান শেখানোর জন্য আমি আমার উদ্যোগে অনলাইন ধর্মীয় কর্মশালার আয়োজন করি এবং এই ক্লাসগুলো নিতেন সেই ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। ক্লাসগুলোতে দেখতাম প্রথম ৩০-৪০ মিনিট আর্যসমাজ এবং অগ্নিবীরের দুর্নাম করে শুরু করা হতো। আমি তখনো জানতাম না আর্যসমাজ কী আর অগ্নিবীরই বা কী। জানার চেষ্টাও করিনি। শুধু জেনেছিলাম আর্যসমাজ এবং অগ্নিবীর খারাপ কোনো সংগঠন হবে হয়তো।


এরপর হঠাৎ একদিন কল আসে প্রশান্ত শীল নামে দিনাজপুরের এক ছেলে আর্থিক সমস্যার কারণে হাবিপ্রবিতে চান্স পেয়েও ভর্তি হতে পারছে না। আমি যেসময় কলটি পাই তার পর হাতে ছিল মাত্র একদিন। একদিনের মধ্যে টাকা সংগ্রহ করতে না পারলে প্রশান্ত'র স্বপ্নের ইতি ঘটবে। তাই আমি আমার পরিচিত সবার সাথে জরুরীভাবে যোগাযোগ করি এবং তাদের মধ্যে অর্ণব ঘোষ দাদা ছিলেন অগ্নিবীরের একজন সদস্য (আমি তখনও জানিনা অগ্নিবীর কী, শুধুমাত্র জেনেছিলাম একেশ্বরবাদীতাই তাদের আদর্শ)। অর্ণব দাদার সাথে প্রশান্তের ব্যাপারে যোগাযোগ করলে উনি আমাকে জরুরিভাবে অমিয়তোষ রায় আকাশ এবং মিঠুন দেবনাথ দাদার নম্বর দিয়ে নক দিতে বলেন। তখন আমি ওনাদেরকে নক দিলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ৪০০০/- টাকা তারা প্রশান্তের বিকাশ নম্বরে পাঠিয়ে দেয়। উল্লেখ্য যে, প্রশান্ত'র ভর্তির জন্য টাকার দরকার ছিল ৮০০০ কিন্তু আমি সবার সাহায্যে ওকে প্রায় ১৫০০০ বা এর কাছাকাছি একটা অ্যামাউন্টের ব্যবস্থা করে দিই।


এরপর যাদের মাধ্যমে প্রশান্তের স্বপ্ন পূরণ হলো তাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে পোস্ট করি। সেই পোস্টে বাংলাদেশ অগ্নিবীরের নাম দেখে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন সেই ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি আমাকে অনেক ঝাড়ি দেন। এমনকি বলেন যে, তুই ওদের কাছে টাকা নিলি একটাবার আমাকে জানাতে পারলিনা? এখানে উল্লেখ্য যে ওনাকে যদি আমি কখনো দশবার কল দিই সেখানে কল রিসিভ হয় একবার এবং যেই সময়টাতে প্রশান্তের টাকার দরকার ছিল সেটা ছিল একদমই স্বল্প। তাই তাকে কল দেয়ার সময় হয়ে ওঠেনি আমার। শুধু উপরোক্ত কথাটি বলেন ক্ষান্ত হননি তিনি। তিনি আরও বলেছিলেন, "তুই অগ্নিবীরের ছেলেদের সাথে এক হইছিস। তোর পূর্বজন্মের কোনো সুকৃতি নাই। তুই কখনো বেদের অধিকারী হতে পারবি না ব্লা ব্লা।" কথাগুলো শুনে আমার মনে হয়েছিল ঈশ্বরের সাথে বোধয় তার আধ্যাত্মিক কোনো কানেকশন নিশ্চয়ই আছে😂। যাহোক, তার কথাগুলো আমার পরিপাকতন্ত্র হজম করতে পারেনি, হয়েছিল বদহজম। আর এই বদহজমের মাধ্যমেই আমার জীবনে আসে টার্নিং পয়েন্ট।


এরপর আমি অগ্নিবীর এবং আর্যসমাজ নিয়ে প্রচুর ঘাটাঘাটি করতে থাকি। সংগঠন করার সুবাদে জানতে পারি রংপুরের পুলক বসাক আঙ্কেল আর্যসমাজের অনুসারী। আমি ওনার কাছেই পরবর্তীতে আর্যসমাজ সম্পর্কে বিস্তর ধারণা লাভ করি। সত্যার্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি আমাকে বিভিন্ন বৈদিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ করেন।


আর অগ্নিবীর সম্পর্কে ধারণা লাভ করি অর্ণব, তুষার, অমিয়তোষ এবং মিঠুন দাদাদের কাছ থেকে।


তখনও আমি আর্যসমাজ বা অগ্নিবীরে যোগ দিইনি। হঠাৎ একদিন ফোনে কল আসে হিন্দু যুব পরিষদ, রংপুর বিভাগীয় শাখার আহ্বায়ক মানিক চৌধুরী জয় দাদার। সংগঠন করার সুবাদে ওনার সাথে আমার পরিচয় অনেক আগে থেকে। উনি আমাকে কল করে বলেন, "উদয়, যুব পরিষদের জেলা কমিটি দেয়া হবে ওখানে তোমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে রাখা হবে। তুমি থাকবে কি না বলো?" আমি কিছুটা না-বোধক কথা বললেও তার জোরাজুরিতে শেষে যোগ দিতেই হলো হিন্দু যুব পরিষদের জেলা শাখায়।


কমিটির অনুমোদন হবার পর আমি যখন আমার টাইমলাইনে নতুন সংগঠনের তথ্য যুক্ত করি তারপরেই বাঁধে বিপত্তি। ফোনে বিভিন্ন ব্যাক্তির কল আসা শুরু হয়। একজন কল দিয়ে বলেন, "উনি(ধর্মীয় ব্যক্তি) আপনার উপর বেজায় ক্ষেপে আছেন। ওনাকে কল দিয়ে সরি বলিয়েন।" আমি যখন বললাম, সরি কেন বলবো তখন উত্তরে তিনি জানালেন, "আপনি ওনার সংগঠনে থাকা অবস্থায় অন্য সংগঠনে যুক্ত হয়েছেন সেজন্য।" তার আগেই আমি লক্ষ্য করেছিলাম ঐ সংগঠনটির অনেক ছেলেপেলে জাগো হিন্দু পরিষদ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সহ একাধিক সংগঠনে যুক্ত ছিলো।


এরপর সেই ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যেই এলাকায় থাকেন সেখানকার জাগো হিন্দু পরিষদের এক দাদাকে কল দিয়ে বলি যে, দাদা আমাকে একজন কল দিয়ে এসব বললেন। এখন আমার কী করা উচিত। তখন দাদা সাফ সাফ বলেন যে, যার দরকার সে যদি তোকে কল দেয় তখন তুই কথা বলবি নইলে দরকার নেই।


এদিকে যুব পরিষদের যোগ দেয়ার জন্য আমার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান এর হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের এডমিন থেকে রিমুভ করে XX সাহা নামের একজন। এরপর আমি আরেকজন এডমিনের সাহায্যে এডমিন হয়ে সবাইকে এডমিন থেকে রিমুভ করি এবং পরবর্তীতে একজনের অনুরোধে সেই ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে পুনরায় এডমিন হিসেবে এড করি। এরপর আমাকে আবারো এডমিন তথা গ্রুপ থেকেই বের করে দেয়া হয় এবং তার সংগঠনের রংপুর শাখার কর্মীদের বলা হয় আমাকে মারতে এবং হুমকি দিতে।


এরপর আমার মায়ের ইচ্ছায় আমি সকল সংগঠন থেকে বের হই এবং অগ্নিবীর তথা আর্যসমাজের দর্শন নিয়ে বিস্তর ঘাটাঘাটি করি। ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে আমার কাছে ধরা দেয় আর্যসমাজ এবং আর্যসমাজের অগ্রপথিক, প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। কীভাবে সংকটের সময়ে তিনি স্বধর্মে রক্ষা করেছিলেন বিধর্মীদের আগ্রাসন থেকে। দিব্যজ্ঞান নয় কাণ্ডজ্ঞান চাই এবং মানব ধর্ম ও দানব ধর্ম বই দুটি পড়লেই আপনারা এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পেয়ে যাবেন।


অতঃপর দৃষ্টি ফেরাই অগ্নিবীরের দিকে। আমি যতই অগ্নিবীরের কর্মকান্ড দেখছিলাম ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। মনুসংহিতার সেই "যুক্তিহীন বিচারেণ ধর্মহানি প্রজায়তেঃ অর্থাৎ যুক্তিহীন বিচারে ধর্মের হানি ঘটে।" আদর্শকে আঁকড়ে ধরে আছে এই সংগঠন। যখন দেখলাম এই সংগঠনে যুক্ত হতে হলে আপনাকে তাদের স্বাধ্যায় কোর্স করতে হবে এবং ধর্ম সম্পর্কে প্রচুর পড়াশুনা করতে হবে তখন আমি আরও আকৃষ্ট হলাম অগ্নিবীরের প্রতি।


যখন গুরুবাদী বিভিন্ন সংগঠন তথা বৈষ্ণবরা বিভিন্ন মনগড়া বিষয়কে ধর্মের সাথে তুলনা করছেন সে সময়ে যুক্তির মাধ্যমে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করছে একঝাঁক ধর্মজ্ঞানী তরুণ-তরুণী তখন আর এই যুক্তিবাদী সংগঠনে যোগ দেবার সুবর্ণ সুযোগটা হাতছাড়া করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হলো না আমার। ফলস্বরূপ আমি অগ্নিবীরে যুক্ত হয়েছি। আমি চাই অগ্নিবীরের মাধ্যমে এবং পবিত্র বেদ তথা আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থের মাধ্যমে সমাজের সমস্ত কুসংস্কার, ধর্মীয় অপব্যাখা, অপপ্রচারকে দমন করে সনাতনী সমাজে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে।


কবিগুরুর ভাষায় 


"সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা।"


"ও৩ম্ কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্যম্" 🚩

জয়তু অগ্নিবীর

সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক


====+====

আরও জানতে ক্লিক করুন অগ্নিবীর ওয়েবসাইট

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ