মতবিনিময় সভায় বিশিষ্টজনেরা | দেশের সংখ্যালঘুরা সহিংসতার শিকার হওয়ার শঙ্কায় উদ্বিগ্ন

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা, প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৩, ০২: ৫৭


মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকলেও গত দেড় দশকে দেশ আরও বেশি সাম্প্রদায়িক হয়েছে। এই সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি বদলানোর কোনো চেষ্টা করেনি। ফলে অন্যান্য নির্বাচনের মতো এবারের জাতীয় নির্বাচনেও দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সহিংসতার শিকার হওয়ার শঙ্কায় উদ্বিগ্ন।

বুধবার বিকেলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। ‘জাতীয় নির্বাচন ২০২৪: ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের অধিকার’ শীর্ষক সেই সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ।

সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন, সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনসহ আওয়ামী তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার একটিও বাস্তবায়ন করেনি। আগামী নির্বাচনের আগের সাত মাসের মধ্যে এসব বাস্তবায়নের দাবি জানায় ঐক্য পরিষদ।

সভায় মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, 

আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের পর এসে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অস্তিত্বের লড়াই করতে হচ্ছে। এই শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতাকে কেটে ফেলার চেষ্টা করেনি আওয়ামী লীগ। তারা সমাজ বদলানোরও চেষ্টা করেনি। বরং আওয়ামী লীগ নিজেদের জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, 

দেড় দশক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ক্ষমতায় রাখার পর বাংলাদেশ এখন আরও বেশি সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার প্রায় সম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। চলতি মেয়াদে অল্প যে সময় বাকি আছে, তাতে এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে মিলে সামাজিক আন্দোলন করে দাবি পূরণ করাও সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।

গত ১৫ বছরে যে দেশে সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে—এ কথার সঙ্গে একমত উল্লেখ করে নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, দেশে সাম্প্রদায়িকতার একটা সামাজিকীকরণ হয়েছে। বর্তমান অবস্থায় রাষ্ট্রধর্ম তুলে দেওয়া বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না।

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে আর ফেরা যাবে কি না, তা জীবদ্দশায় দেখে যাওয়ার সম্ভাবনাও দেখছেন না তিনি। রামেন্দু মজুমদার বলেন, 

আগামী নির্বাচনে প্রার্থীরা সাম্প্রদায়িক কথা বললে তার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন যেন ব্যবস্থা নেয়, সেই দাবিও জানান।

অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত। তিনি বলেন, 

নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতিমধ্যে নানান মহল থেকে সংঘাত ও সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে আমরা উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। কারণ আমরা খেয়াল করেছি, নির্বাচনের পূর্বাপর ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে এক বিশেষ সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক মহল সহিংসতা চালায়। একদিকে শঙ্কা, অন্যদিকে আজও দাবি পূরণ না হওয়ায় সংখ্যালঘু জনমনে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। যা সামনের নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব দেখা দিতে পারে।

গত কয়েক দশকে সমাজে একটা বড় পরিবর্তন ঘটেছে বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী। তিনি বলেন, 

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি আক্রান্ত হলে প্রশাসনের পাশাপাশি প্রতিবেশীও নীরব থাকে। আর রাজনীতিবিদ হয় সমঝোতা করে, না হয় সামলে চলে। রাজনীতিবিদেরা যখন সমঝোতা বা সামনে চলেন তখন নীতির পরাজিত ঘটে।

সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে আন্তর্জাতিকভাবে দায়বদ্ধ উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, সংখ্যালঘু কমিশন গঠন সম্প্রীতি রক্ষার জন্য প্রয়োজন। তিনি বলেন, 

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে যেগুলো সম্ভব সেগুলো আগামী নির্বাচনের আগে সরকার বাস্তবায়ন করতে পারে।

আওয়ামী লীগের দায় বঙ্গবন্ধুর সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করা, সেখান থেকে তারা এখন অনেক দূরে সরে গেছে বলে মনে করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, 

এখন আওয়ামী লীগের বন্ধু হেফাজত। বিভিন্ন মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে কাছে টানার চেষ্টা করছে। এটা আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম থাকতে পারে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সবার একসঙ্গে দাঁড়ানো দরকার বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল। তিনি বলেন, 

১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের দাবি মেনে নেয়নি, ভবিষ্যতেও মেনে নেবে না। তবে সম্মিলিতভাবে আন্দোলন করতে পারলে যেকোনো সরকার তা মেনে নিতে বাধ্য হবে।


সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মেনে নিলে ভোট কমবে না, অপকর্ম করলে কমবে বলে মনে করেন নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির।

এই মতবিনিময় সভার সভাপতিত্ব করেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি অধ্যাপক নিমচন্দ্র ভৌমিক। এ সময় আরও বক্তব্য দেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, প্রথম আলোর যুগ্ম-সম্পাদক সোহরাব হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদিকা মাসুদা রেহানা বেগম, ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর প্রমুখ।


সূত্র: প্রথম আলো

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ