ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা জেএম সেনের বাড়ি |
প্রকাশিত: ২১:১৯, ৬ জানুয়ারি ২০২১
স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে প্রতিরোধের মুখে ভাঙ্গার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা যাত্রা মোহন সেনগুপ্তের (জেএম সেন নামে অধিক পরিচিত) দেড় শ’ বছরের পুরনো বাড়ি। প্রভাবশালী একটি মহল বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত এই সম্পদ বিক্রি হলো কীভাবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভূমিদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করে ওই জায়গায় বিপ্লবীদের স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছে চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস মিলেছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর রহমতগঞ্জ এলাকায় বাড়িটির অবস্থান, যার মালিক যাত্রা মোহন সেনগুপ্ত, যিনি জেএম সেন হিসেবে পরিচিত । তাঁর পুত্র ব্যারিস্টার দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তও ছিলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতা। তিনি কলকাতার মেয়রও হয়েছিলেন। ব্রিটিশ স্ত্রী নেলি সেনগুপ্তাকে নিয়ে তিনি এই ভবনেই থেকেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, শরৎ বসু, মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী এবং অসম বেঙ্গল রেলওয়ে আন্দোলনের নেতারা বিভিন্ন সময়ে এ বাড়িতে এসেছেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী সূর্য সেন, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তীর হয়ে মামলা লড়েছিলেন যতীন্দ্র মোহন সেন। এরপর ব্রিটিশ শাসকদের রোষানলে পড়া যতীন্দ্র মোহন সেন ১৯৩৩ সালে কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্ত্রী নেলি সেনগুপ্তা এরপর থেকে চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জের এই বাড়িতেই বসবাস করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন/সংগ্রামে নেলি সেনগুপ্তা সক্রিয় ছিলেন।
বিপ্লবী এ বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলতে গত সোমবার সকালে চালানো হয় বুলডোজার। খবর পেয়ে ছুটে আসেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত এবং স্থানীয়রা। তর্কবিতর্ক এবং প্রতিরোধের মুখে শেষ পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা এসে ভবন ভাঙ্গা বন্ধ করার আদেশ দেন। ভবনটি সিলগালা করে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত হবে বলে আশ্বাস প্রদান করেন। এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় নেলি সেনগুপ্তা অসুস্থ হয়ে পড়লে কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে ১৯৭০ সালে চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে তিনি আর সেই বাড়িতে প্রবেশ করতে পারেননি। বাড়িটি বেদখল হয়ে যায়। পরে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এই দম্পতি ছিলেন নিঃসন্তান। এ ধরনের সম্পত্তি দেখভাল করার দায়িত্বভার জেলা প্রশাসনের, যা বিক্রি করা যায় না। জাল দলিল সৃজন করে এ সম্পদ দখলের চেষ্টা করছে প্রভাবশালীরা। তিনি বলেন, যারা দখল নিতে গিয়েছিল তারাও মামলার আর্জি এবং আদালতের রায় দেখাতে পারেনি। নিজ চোখে যে কাগজপত্র দেখলাম তা জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে আদালতকেও ভুল বোঝানো হয়েছে। প্রয়োজনে আমরা এর জন্য উচ্চ আদালতে যাব। চট্টগ্রামে জেএম সেনের বাড়ি ও ভূসম্পত্তি পাবনার সুচিত্রা সেনের বাড়ির মতো সংরক্ষণের দাবি জানান তিনি।
চট্টগ্রাম মহানগরীর রহমতগঞ্জ এলাকায় যাত্রা মোহন সেনের বাড়িসহ জমির পরিমাণ ১৯ গণ্ডা এক কড়া, যা শত্রু সম্পত্তি হিসেবে জেলা প্রশাসনের তালিকাভুক্ত। স্বাধীনতার পর শামসুদ্দিন মোহাম্মদ ইসহাক নামের এক ব্যক্তি জমিটি ইজারা নিয়ে বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭০ সালে কলেজের নাম বদলে সেই ভবনে ‘শিশুবাগ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা এখন ইসহাকের সন্তানরা পরিচালনা করছেন। গত সোমবার সকাল ১০টার দিকে এম ফরিদ চৌধুরী নামের এক ব্যক্তি তার দুই পুত্র- ফরহাদ ও ফয়সালসহ শতাধিক লোক নিয়ে সেখানে যান। তখন স্কুলে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক প্রদান ও ভর্তির কার্যক্রম চলছিল। স্কুলের শিক্ষক এবং অভিভাবকদের তারা জানান, তারা ভবনটির দখল নিতে এসেছেন। তখন প্রায় ২৫ জনের মতো পুলিশ সদস্যও উপস্থিত ছিলেন। দখল পরোয়ানাসহ কাগজপত্র নিয়ে সেখানে যান চট্টগ্রাম যুগ্ম জেলা জজ আদালতের নাজির আমিনুল হক আকন্দ। যুবলীগ নেতা পরিচয় দানকারী গিয়াস উদ্দিন সুজন এবং মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে প্রায় অর্ধশত তরুণ ও শ্রমিক ঢুকে পড়ে সেই স্কুলে। তারা শিক্ষক এবং অভিভাবকদের বের করে দেন। প্রতিবাদ করতে গিয়ে কয়েকজন মারধরের শিকার হন বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। শুরু হয় বুলডোজার দিয়ে ভাংচুর কাজ।
প্রায় দেড় শ’ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক এ ভবন ভাঙ্গার খবর পেয়ে দুপুরের দিকে ছুটে যান এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। তার সঙ্গে ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের জামালখান ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার শৈবাল দাশ সুমন, চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান সাংবাদিক আলীউর রহমান, আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী, ছাত্র ইউনিয়ন জেলা কমিটি এবং চট্টগ্রাম বিপ্লব ও বিপ্লবী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা। বুলডোজারের সামনেই দাঁড়িয়ে যান তারা। ভবনের দখল নিতে আসা এম ফরিদ চৌধুরী জানান, যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের ওয়ারিশ মিলন সেনগুপ্তের কাছ থেকে তারা সম্পত্তি কিনে নিয়েছেন। আদালতের ডিক্রী নিয়েই তারা দখল নিতে এসেছেন। তবে এ সংক্রান্ত কাগজ জালিয়াতিপূর্ণ বলে জানিয়ে এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, শত্রু সম্পত্তি বিক্রি করা যায় না। এগুলো জেলা প্রশাসন থেকে লিজ নিয়ে ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া মিলন সেনগুপ্ত নামের যার কথা বলা হচ্ছে তিনিও মানসিকভাবে অসুস্থ। জেএম সেনগুপ্তের বাড়ি ও সম্পদ রক্ষা করে সেখানে জাদুঘর করা উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেন এই আইনজীবী।
এদিকে, মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত এই ভবন ভাঙ্গার অপচেষ্টা বন্ধ করে সেখানে বিপ্লবী স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছে চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আলীউর রহমান। এ দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন, কবি সাংবাদিক আবুল মোমেন এবং প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ও নেলি সেনগুপ্তের ওই জায়গার যেসব জাল দলিল সৃজন করা হয়েছে তা দেশের ঐতিহ্য ও কৃষ্টি রক্ষার স্বার্থে বাতিল ঘোষণা করতে হবে। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলা যুগ্ম জজ প্রথম আদালত থেকে প্রদত্ত আদেশ ও উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে ও জেলা প্রশাসন ও ভূমি অফিসকে না জানিয়ে সরকারী অর্পিত সম্পত্তি দখল করতে পুলিশী তৎপরতার যথাযথ তদন্ত, অর্পিত সম্পত্তিটি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করে ঐতিহাসিক এ ভবন অক্ষত রেখে পেছনে বহুতল ভবন তৈরি করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন স্মৃতি জাদুঘর ও গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের দাবি জানানো হয়। যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ও নেলি সেনগুপ্তার সম্পদ রক্ষায় মঙ্গলবার চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্তের নেতৃত্বে একটি টিম। ফলপ্রসূ এ বৈঠকে সন্তোষজনক আশ্বাস মিলেছে । এ ব্যাপারে খুব দ্রুতই সিদ্ধান্ত এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানা যায় ।
সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ
0 মন্তব্যসমূহ