দেখে এলাম #TheKeralaStory - অর্ণব সরকার

দেখে এলাম #TheKeralaStory  - অর্ণব সরকার

দেখে এলাম #TheKeralaStory । ৫ই মে ২০২৩ বুদ্ধ পূর্ণিমার ছুটির দিন। সকাল সকাল উঠে, স্নান সেরে, খেয়ে দেয়ে মুখ মুছে, বউকে বাইকে চাপিয়ে পৌঁছে গেলাম জয়া সিনেমা। টিকেট কালকেই কেটেছিলাম। মর্নিং শো লোক হাতে গুনে কটা হবে। বাঙ্গালী হিন্দু খুব চালাক আগেই যাবে না দেখতে, তার রক্তে মিশে আছে কম্যুনিস্টের বিষ, এই সিনেমায় হিন্দু মেয়েকে মুসলমান বানাচ্ছে - জিহাদী বানাচ্ছে - হিজাব কে গালি দিচ্ছে – মুসলিম জঙ্গিবাদের নারকীয়তা দেখাচ্ছে বাঙ্গালী ডাল-ভাত-মিষ্টিদই খাওয়া হিন্দু এসব দেখতে ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো যাবে! যদি কোনও দিদির ভাই দেখে ববির ভাই কে বলে দেয়, তখন কি হবে! যদি কম্যুনিস্ট বাচাল বন্ধু দেখে মগজ চেটে দেয়! সবচেয়ে বড় সমস্যা যদি তার প্রানের সিমুই বন্ধুটি শুধু জেনে যায় কি করে মুখ দেখাবে আমার বাঙ্গালী হিন্দু ভাইটি? তবে হ্যাঁ আমার মতন কজনের অপর ভরসা রাখে আমার বাঙ্গালী হিন্দু ভাইটি কারন সে জানে আমি বা আমরা যারা বুক ফুলিয়ে দেখতে যাচ্ছি তারা দেখে এসেই রক্ত গরম করা দু-চারটি কথা বলবো, সেই শুনে আশেপাশের আরও দু-চারজন বাঙ্গালী হিন্দুর সপ্তাহ দুয়েকের একটা হিন্দুত্বভাব জাগবে তখন সেই দোহাই দিয়ে আমার বাঙ্গালী হিন্দু ভাইটিও গিয়ে সিনেমাটি দেখে আসবে। সে যাক যেভাবেই যায় তবু যাক।


সিনেমা শুরু হলো। আসলে আমি নিজেও ভয়ে ছিলাম, এই ভয় আমি কাশ্মির ফাইলস দেখতে গিয়ে পাইনি। কারন জানতাম কাশ্মির ফাইলসে যা দেখানো উচিৎ তাই দেখাবে, কিন্তু এই সিনেমাটা নিয়ে ভয় ছিল তারও কারন একটাই, কাহিনীকার ও পরিচালক একজন বাঙ্গালী হিন্দু, ভয়ে ছিলাম সে লাভ জিহাদ দেখাতে গিয়ে যোধা-আখবরের প্রেম না দেখিয়ে বসে। কিন্তু আমার এই নিকৃষ্ট ধারনাকে বোম মেরে উড়িয়ে এই বাঙ্গালী হিন্দু পরিচালক দেখিয়ে দিল হিন্দুরা কি অসহায়। কিভাবে তিল তিল করে হিন্দু জাতি ধ্বংস হচ্ছে। কিভাবে আমরা হিন্দুরা টাকার লোভে - ক্ষমতার লোভে - নিজেকে অহেতুক অতিআধুনিক প্রমান করতে – ভ্রান্ত কম্যুনিস্ট নামক বিসাক্ত শয়তানকে সাধু সাজিয়ে নিজেরাই নেশাতুরের মত নিজেদের গলায় ব্লেড চালাচ্ছি। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে যখন জ্ঞান ফিরছে তখন শুধু মৃত্যুকে দেখতে পাচ্ছি ফেরার রাস্তা নাই। এই সব চরম সত্য চোখের সামনে তুলে ধরেছেন সুদীপ্ত সেন। তাকে নমস্কার।


সিনেমা দেখতে দেখতে খুব টের পাচ্ছিলাম ভীষণ ভাবে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ হচ্ছে চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর নিজেই নিজেকে শান্ত করলাম অনুভব হল আরে, এ তো আমারই মেয়ের গল্প, এই তো অপেক্ষা করছে তার জন্য আগামীতে। কারন আমি এক অসম লড়াইয়ে নেমেছি। আমি জানি না এই যুদ্ধে আমার মেয়েকে আমি রক্ষা করতে পারবো কিনা! আমি শত্রুকে চিনি যার বিরুদ্ধে আমার লড়াই কিন্তু আমার সাথে দাড়িয়ে থেকে আপনি আমাকে হারাতে ব্যাস্ত। আপনি হয়তো চাননা আমার শত্রুর জয় - কিন্তু আপনি চেষ্টায় থাকেন যেন আমি হেরে যাই। 

আমার মেয়েকে যখন আমি ধর্মীয় শিক্ষা দেব আপনি হাসবেন, প্রয়োজনে আপনার মেয়েকে সেখান থেকে দূরে রাখবে, পারলে আমার মেয়েকেও বলবেন – কিরে, এই সব এই বয়সে কেও শেখে, বাদ দে এসব করা, আয় বিকেলে ওরা যেমন রোজা রেখে ইফতার খায় আমরাও খাব ডালের বড়া মুড়ি খেজুর খুব মজা হবে। যদি কখনো দেখেন আমার মেয়ে জন্মদিনে কেক কাটে না, ওকে জোর করে দাড় করাবেন আপনার মেয়ের জন্মদিনে কেকের সামনে। বলবেন ছি ছি দেখো তো বাচ্চারা তো আনন্দ করবেই। আপনার স্মার্টনেস ও আধুনিকতা দুর্গা-পুজা কে মদ খাওয়ার অছিলায় পরিনত করেছে মাত্র। মেকি আধুনিকতা – কমিউনিসমের কুশিক্ষা – ভ্রান্ত একপেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতির অপছায়া এভাবেই আমার মেয়েকে হিন্দু ধর্ম থেকে দূরে সরিয়ে দেবে।


আপনার হয়ে গেলে হিন্দু ধর্ম থেকে দূরে সরাতে তখন এগিয়ে আসবো আমি ও আমার পরিবার। আমার মা-মাসি-পিসি যাদের কাছে যুগ যুগ ধরে বিশ্লেষণ না থাকায়, নিয়মিত চর্চা না থাকায়, শুধু ভ্রান্ত অনুসরন করতে গিয়ে তাঁরা কিছু ভ্রান্ত ধারনাকেই ধর্ম বলে ধরে নিয়েছে। কখন – কি কারনে – কোন জিনিস – কিভাবে – কোথায় নিষিদ্ধ ছিল এবং এখন আদৌ সেভাবেই তার দরকার আছে কিনা, সেটা বিশ্লেষণ না করেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করা আমার মেয়ের অপর তাঁরা তা চাপিয়ে দিতে চাইবেন। আর তখনি আমার মেয়ের যুক্তিবাদী মন সরে যাবে হিন্দু ধর্ম থেকে। তখন তাকে কে বোঝাবে হিন্দু মন্দিরের স্থাপত্য বিজ্ঞান, হিন্দুরীতির খাদ্যাভ্যাসের জীববিজ্ঞান, হিন্দু মূর্তির পদার্থবিজ্ঞান, হিন্দু জীবনচর্চার ব্যাবহারিক বিজ্ঞান, প্রকৃতির সমস্ত বিজ্ঞানের সাধনা করা একটি ধর্ম তখন নিমিষেই আমার মেয়ের কাছে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক হয়ে যাবে। কে সময় দিয়ে বোঝাবে তাকে? আমি হয়তো হিন্দুত্বের নব-জোয়ার আনতে ব্যাস্ত জননেতা, জানি অনেক কিছু - বাইরে বলি, মাইকে বলি, সবাই হাত্তালি দেয়, ঘরে এসব কে বলে! আমি সংঘের বাবু হলে ব্যাস্ত ঘোষ বা মজুমদার হতে ঘোষ বা মজুমদার হয়ে গিয়ে থাকলে ব্যাস্ত মোদী-শাহ হতে, আমি ঘরে সময় দেব? এভাবেই আমার মেয়ের হিন্দুত্ব একা-অসহায়-অর্থহীন।


এই সময় আমার মেয়েটির হাত ধরবে জিহাদ। জিহাদ তাকে দেখাবে তার বয়সি কিতাবিয়ারা ছোটো বেলা থেকেই ধর্মের মিষ্টতা-সখ্যতা-শিক্ষা পাচ্ছে তার বাবা-মা-প্রতিবেশী সবার কাছ থেকে। জেনে অবাক হবে তাঁরা তাঁদের একেশ্বর কে স্মরণ না করে কিছু খায় না। কারন আমি তো আমার মেয়েকে খাওয়ার আগে ভোজন-মন্ত্র শেখাইনি, কারন তাতে আমার নিজেরই হয়তো বিশ্বাস নাই। জিহাদ আমার মেয়েকে দেখাবে পবিত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানে জাকাত দানের আনন্দ। কারন আমি তো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিজে খেয়েছি ভিখারিকে উচ্ছিষ্ট দিয়েছি, হিন্দু ধর্মের দান অন্যতম অঙ্গ আমি তো আমার মেয়েকে দেখাইনি, কারন আমি নিজেও দাতা কর্ণ আর হরিশ চন্দ্র গল্প হিসেবেই জানি। মন্দিরে দান দিলে ১০ টাকা, চাঁদা চাইলে ভাগিয়ে দেই ভাবি চাঁদা তুলে যদি মদ খায়। জিহাদ আমার মেয়েকে শেখাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠান মানে পবিত্রতা। কারন আমি দেখিয়েছি পুজো মানে অহেতুক উচ্ছৃঙ্খলতার উৎসব, সরকারী অনুদানে উন্মত্ত হয়ে মদ্যপ হিন্দু ছেলেটি বাইক চালিয়ে আমার মেয়েকে বিরক্ত করে ছুটছে। জিহাদ দেখাচ্ছে জিহাদি ছেলেটি কি পবিত্রতা নিষ্ঠার সাথে তার ধর্মীয় আঁচার অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছে। জিহাদ আমার মেয়েকে দেখাবে হিজাবের সৌন্দর্য কারন আধুনিক আমার মেয়ের মাতৃকুলে সিথির সিঁদুর ধর্মীয় চিহ্ন নয়, শুধু ফর্মালিটি করে একফোঁটা, নইলে চুল খারাপ হবে, মাথায় ঘোমটা তো পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অত্যাচারের প্রতীক, শাখা পড়া সেকেলে আচরন। তখন জিহাদের হাত ধরে আমার মেয়ে মাথায় না ঠেকিয়ে পা তুলে দেবে তার মায়ের হাতের পুজার প্রসাদের দিকে। এই সুযোগে জিহাদ আমার মেয়ের হাতে তুলে দেবে জায়নামাজ আর হিজাব, যা চুমু খেয়ে কপালে ঠেকাবে আমার মেয়ে। ধর্ম আফিম শেখানো কমুনিসম যখন বিকাশকে দিয়ে গরু খাওয়াবে আর সেলিম কে দিয়ে শুয়োর খাওয়াবে না তখন সেই জিহাদপন্থী কমুনিসমের কপালেও থুতু ছিটিয়ে আমার মেয়ে জিহাদি হবে।


তারপর একদিন জিহাদ তাকে শরীরী ফাঁদে ফেলবে। সেখান থেকে মুক্তির উপায় নাই, কারন সে মেয়ে। সে এখন মেনে নেবে আফগানিস্তান – সিরিয়ার মত নরক, যার শেষ পরিনতি সারা গায়ে বোমা বেঁধে হাজার মানুষকে মেরে মৃত্যুবরণ। আর সে যদি না মেনে নেয় সেই জীবন, তাহলে তার শরীরের ছবি ছড়িয়ে পরবে সমাজ মাধ্যমে, তার কাছে তখন আত্মহনন ছাড়া উপায় নাই, মার্ক্স লেনিন এঙ্গেলস এর সামনে ঝুলবে তার নিথর দেহ। আর যদি আমার পূর্বজন্মের সুফল তাকে ফাঁদে পরতে না দেয় তাহলে ধর্ষণ-খুন-অপহরণ এসব তো থাকবেই। শুধু এই সব কিছুর সাথে শেষ মুহূর্তে আমার মেয়ের একটা উপলব্ধি হবে যে সে ভুল করেছে। কিন্তু তখন আর উপায় নাই। জীবনের চিত্রনাট্যের যবনিকা পতন হবে পর্দার আলো নিভে যাবে।


সিনেমাটি ভালো নয় অসাধারণ। প্রত্যেকটি অভিব্যাক্তি স্পষ্ট, ধরি মাছ না ছুই জল নয়। সোজা সাপটা। আমার প্রিয় মুহূর্ত যখন গিতাঞ্জলি মেনন হিজাব পড়ে তার কমিউনিস্ট কাফের বাবার কপালে থুতু ছিটায়। প্রতিটি মুহূর্তে খুব স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করতে কত বৃহৎ ষড়যন্ত্র হাজার বছর ধরে চলছে তাও আমরা এখনো ঠিকে আছি, জিহাদিদের মুখে ঔরঙ্গজেবের নাম নিয়ে সেটাই স্পষ্ট করেছে পরিচালক। আরেকটি অনুরোধ সিনেমাটি পাইরেটেড কপি দেখাবেন না। এই ধরনের সিনেমা কে ব্যাবসা করতে দিন, হলে গিয়ে দেখুন, মনে করুন লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে ঐ টাকাটাই আপনার যোগদান। যদি পুরো লেখাটা পড়ে থাকেন তাহলে নিজেদের অভিজ্ঞতাও জানান।


যা লিখলাম সেটা সিনেমা নয় সেটা অনুভুতি। যা একান্ত আমার, তাই আমার ভাবনার মতই হয়তো এলমেলো লাগতে পারে। ভুল ভাবছি – ঠিক ভাবছি, জানি না, শুধু এইটুকু বুঝি সবশেষে দোষ কাকে দেব, দোষ সবার, আমার আপনার সবার। মেয়েটি হয়তো আজকে আমার, কালকে বা পরশু কিন্তু মেয়েটি আপনারই। উপায় যদি সন্ধান করতে চান নিজেকে দিয়ে শুরু করুন নিজের ঘরে নিজের সন্তানকে শিক্ষা দিন। চেষ্টা করুন, আমিও চেষ্টা করছি জানি না জিতবো না হারবো। কিন্তু চেষ্টা করে যাচ্ছি, দয়া করে আপনিও চেষ্টা করুন।


✍️ Arnab Sarkar

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ