কমিউনিস্টদের ভারতে ‘মুসলিম শাসন’ নিয়ে কিছু জনপ্রিয় ফ্যালাসির উত্তর:
"মুসলমানরা যদি হিন্দুদের জোর করে মুসলমান বানাতো তাহলে ভারতে মুসলিম শাসনে কোন হিন্দু অবশিষ্ট থাকত না"
-অষ্টম শতাব্দীতে মুসলমানরা (মুহাম্মদ বিন কাশিম) যখন সিন্ধু জয় করে নিলো তখন বড় প্রশ্ন দেখা দিলো হিন্দুদের বাঁচিয়ে রাখা হবে কিনা? নাকি জিজিয়া কর নিয়ে তাদের নতমস্তকে বাস করতে দেওয়া হবে। মুসলিম শাসকদের প্রয়োজন ছিল বিজিতদের সম্পদ ও অধিকৃত জমি থেকে নির্ধারিত হারে খাজনা (জিজিয়া) আদায় করা। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল ইসলামী বিধি। ইসলাম মতে কেবল আহলে কিতাবীদের (ইহুদী-খ্রিস্টান) জিজিয়া কর দিয়ে মুসলিমদের বশ্যতা স্বীকার করে বাঁচার অধিকার আছে। কিন্তু যারা হিন্দু পৌত্তলিক তাদের বেলায় জিজিয়া কর দিয়ে বাঁচার কোনো সুযোগ নেই। তাদের একমাত্র পথ হচ্ছে ইসলাম গ্রহণ করা নয়ত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হওয়া। শেষতক সিদ্ধান্ত হলো এদের জিজিয়া করের বিনিময়ে, মুসলিম শাসনে বশ্যতা স্বীকারপূর্বক বসবাসের অধিকার দেওয়া যেতে পারে। কারণ প্রফেট মুহাম্মদ মদিনার একটি পৌত্তলিক গোত্রকে জিজিয়ার বিনিময়ে বসবাস করতে অনুমতি দিয়েছিলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে সেন বংশের শাসনামলে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা সামাজিকভাবে নিপীড়িত থাকলেও মুসলিম শাসনের তাদের ভাগ্যের কোনো হেরফের ঘটেনি। তাহলে দলে দলে বাংলার বৌদ্ধ আর হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণের কাহিনির কি হবে? কীসের টানে তারা ইসলামে আকর্ষিত হয়েছিল?
ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমনের প্রেক্ষাপট লিখতে গিয়ে অনেকেই দাবি করেন পাল রাজাদের হটিয়ে দক্ষিণ ভারতের সেনদের বাংলা রাজত্বের সময় যে দমনমূলক শাসন চালানো হয়েছিল তাতে অতিষ্ঠ জনগণ মুসলমানদের আগমনকে দুহাত তুলে স্বাগত জানিয়েছিল। জাতিভেদ প্রথার নিস্পেষণে অতিষ্ঠ স্থানীয়রা মুসলিম শাসকদের সঙ্গে আসা সুফিদের উদার ধর্মমতে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছিল…। এই দাবি সঠিক নয় নানা কারণেই মনে হয়। দ্বাদশ শতাব্দীতে মুসলমানদের সমস্ত ক্রোধ ছিল বৌদ্ধদের উপর। কেননা এই সময়কালে বৌদ্ধ সম্রাটদের হাতে মুসলিম সাম্রাজ্য আক্রান্তের ঘটনা ঘটতে থাকে। এসব কারণে মুসলিমদের কাছে বৌদ্ধরা হয়ে উঠেছিল ইসলামের শত্রু। তাই বখতিয়ার খিলজি মগধ দখল করার পর বৌদ্ধদের কচু কাটা করেছিলেন। বৌদ্ধরা জীবন বাঁচাতে পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজ্যে গিয়ে আশ্রয় লাভ করেছিল। বখতিয়ারের মগধ জয়ের অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে বৌদ্ধ শাসক হালাকু খার হাতে বাগদাদ নগরীর পতন ঘটেছিল। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে মঙ্গলরা হালাকু খানের নেতৃত্বে বাগদাদ নগরীর ইসলামিক খিলাফতে হানা দিয়ে দখল করে নেয়। এর ফলে মুসলিমদের সেসময় সমস্ত রাগ ছিলো বৌদ্ধদের উপর। কাজেই স্থানীয় বৌদ্ধ জনসাধারণ সেনদের দমনমূলক শাসন থেকে রক্ষা পেতে মুসলমানদের স্বাগত জানিয়েছিল এরকম দাবি মনে হয় ঠিক নয়। মুসলিম ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ বখতিয়ারের বৌদ্ধ বিহারগুলোর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া, শিক্ষার্থী ও জ্ঞান তাপসদের নির্বিচারে হত্যার গর্বিত বর্ণনা করেছেন। অপরদিকে বাংলায় হিন্দু সেন বংশের শাসনকালে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা নিপীড়িত হচ্ছিল। বর্ণবাদী ব্রাহ্মণদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছিল। কিন্তু এতেই মুসলিম শাসকদের দেখে তাদের উৎফুল্লিত হবার কি আসলেই কোনো কারণ ছিল?
"মুসলিম শাসনে হিন্দুদের বড় পদে বসানো হতো"
-মুসলিম শাসনকালে রাজদরবারে বেশ সম্মানিত পদে হিন্দুদের নিয়োগ পেতে আমরা দেখি। মুসলিম সম্রাটের সেনাপতি একজন হিন্দু-এরকমটা ভারতবর্ষের মুসলিম শাসন সময়ে বিরল কোনো ঘটনা নয়। বিষয়টি আবহমান কালজুড়ে হিন্দু-মুসলমানের সৌহার্যময় সম্পর্কের প্রমাণ হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই থলের বিড়াল লাফ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মুসলিম শাসনে হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগের ইতিহাস বর্ণনা করার আগে শুরুতেই বলা উচিত, সুলতানী আমলের প্রথম দুইশত বছরে কোনো হিন্দুকে রাজকাজে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগ দেওয়ার কারণটিও রাজনৈতিক। সিংহাসনের শরিক শক্তিগুলোকে দুর্বল করতে, তাদের পদ বঞ্চিত করে স্থানীয় বিশ্বস্ত হিন্দুদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৯০-১৪১০ খ্রি:) সর্বপ্রথম তার শাসনকার্যে স্থানীয় হিন্দুদের নিয়োগ দান করেছিলেন। কিন্তু শুরুতেই প্রবল বিরোধের শিকার হতে হলো সুলতানকে। সুফি দরবেশ মাওলানা মুজফর শামস বলখি সুলতানকে চিঠি লিখে জানালেন, সুলতান এই নিয়োগ দ্বারা সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ ও বিভিন্ন শাস্ত্রীয় আইনকে অমান্য করেছেন। কাফেরদের ছোটখাটো কাজে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু শাসনকার্যে তাদের নিয়োগ ঘোরতোর ইসলাম বিরোধী কাজ। ইসলাম কোনো কাফেরকে রাষ্ট্রীয় কাজে যোগ্য বা সমান মনে করে না।…
সুলতান বা সম্রাটদের উপর সুফি দরবেশদের প্রচণ্ড প্রভাব ছিল। যদি কোনো সুলতান সুফিদের মতামতকে উপেক্ষার সাহস করতেন, তবে সুফিরা পাশ্ববর্তী কোনো মুসলিম শাসককে চিঠি লিখে আক্রমণের অনুরোধ জানাতেন সুলতানের বিরুদ্ধে। এছাড়া শাসকদের কেউ সে অর্থে ধর্মকর্ম পালন না করলেও প্রবল ধর্মানুরাগী ছিলেন। নিজে ধর্মকর্ম পালন না করার অপরাধবোধেই সম্ভবত মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা, সুফি দরবেশদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। বলখির চিঠিতে সুলতান বিচলিত হয়েছিল বুঝা যায়। কেননা সেসময় চীনা দূতেরা বাংলায় এসে যে বিবরণ লিখেছিলেন তাতে উল্লেখ করেছিলেন, সুলতানের ছোটবড় সব অমাত্যেরা সকলেই মুসলমান। প্রসঙ্গত বলা অসঙ্গত হবে না, পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানের মন্ত্রিসভায় একজন হিন্দু ও আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ছিলেন। এতে কি সে সময়ের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রাষ্ট্রীয় অবস্থাকে ভালো বলে প্রমাণ করে? বাস্তবতা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা হিন্দুদের পাকিস্তানের নাগরিকই মনে করত না। মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর তাদের অত্যাচার আর নির্মমতা দেখে বুঝা যায় সেসময় পাকিস্তানে ধর্মীয় পরিচয়ে কতখানি বিদ্বেষ জারি ছিল।
এই যে কোন রকম ধর্মান্তর ঘটেনি বলে ইতিহাস চালু করা, হিন্দুদের নিয়ে শাসনকার্য চালানো হয়েছিলো সেক্যুলার স্টাইলে- এগুলোই ইতিহাসের ফ্যালাসি। কমিউনিস্টদের এই ইতিহাসের ফ্যালাসির সঙ্গে মুসলিম ইতিহাসের ফ্যালাসি ও হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসের ফ্যালাসির কোন তফাত নেই।
0 মন্তব্যসমূহ