৪৭এ দেশভাগে ভারত বিভক্ত হল। ভারত পেল স্বাধীনতা কিন্তু পূর্ব-বঙ্গের হিন্দুরা কি পেল? পেল পরাধিনতা। সেই পরাধিনতা দেশ হারানোর বেদনা ভিটেমাটি ছেড়ে আসার যন্ত্রণা, শৈশবের স্মৃতি দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু সমস্যা রাস্তার পাশে রেলস্টেশনে একটু ঠাই পাওয়ার জন্য প্রানান্ত চেষ্টা, বাস্তচ্যুতির বেদনাবিধুর স্মৃতিকাতরতা ভয়ার্ত আর্তনাদ অস্তিত্ব সংকটের ইতিবৃত্ত এসবের ফলে যে মানুষিক বৈকল্যের সৃষ্টি হয়েছিল আজও এত বছর পর বুকের মধ্যে বেজে উঠে পূর্বপুরুষদের দেশ হারানোর যন্ত্রণা মাতৃ বিয়োগের কষ্টের মতোই।
দেশভাগে দেশ ছেড়েছেন অনেক নামি-দামি মানুষ। তাদের মধ্যে শিল্পী সাহিত্যিক নাট্যকার চিত্র পরিচালক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তারা প:বঙ্গে এসে নিজনিজ ক্ষেত্রে সবাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তারা কেউ দেশত্যাগের বিভীষিকাময় বিস্মৃতি নিয়ে কোন কাজ করেননি। নোয়াখালীর গণহত্যা নিয়ে কেউ কোন কথা বলেননি। একটা প্রবন্ধ একটি কবিতা একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেনি। ইতিহাসের ঘৃন্যতম ধর্ষণ গণহত্যা যে একটি সম্প্রদায়কে অবচেতনে শেষ করে দিয়েছে সে নিয়ে কারও ভ্রুক্ষেপ ছিল না আজও নেই। আমরা ভুলে গিয়েছি খুলনা যশোর বরিশাল ঢাকার লোমহর্ষক হিন্দু গণহত্যার কথা।
ঢাকা ও কলকাতার সাহিত্য একই ভাষার উত্তরসূরী হলেও তার সাংস্কৃতিক পার্থক্য এখনো স্পষ্ট। দেশভাগের পর দুই দেশের কবি সাহিত্যিকদের যোগাযোগ ছিল কিন্তু দূরত্ব বজায় রেখে। দুই দেশেই সাহিত্য সংস্কৃতির আসর বসেছে যারা দেশত্যাগী তাদের অংশগ্রহণও ছিল কিন্তু ছিল না মনের মধ্যে বাসা বাধা দেশত্যাগের বিস্ময়কর বিস্মৃতির কথা। যদি হিন্দু মুসলিম ভাইভাই সম্পর্কের অবনতি হয়! দেশভাগ বাংলা সাহিত্যেও প্রভাব পড়েছিল তবে এক তরফা। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাহিত্যে দেশভাগের নির্মম অত্যাচারের কাহিনি ফুটে উঠেছে। অথচ প:বঙ্গের সাহিত্যে সেভাবে দেশভাগের অকথ্য অমানবিক অকল্পনীয় অত্যাচার নিয়ে কোন ইতিহাস গল্পকাহিনী নির্মিত হয়নি। প:বঙ্গে যারা প্রোতিথযশা কবি শিল্পী সাহিত্যিক গায়ক চিত্রপরিচালক নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে বেশির ভাগেরই পূর্ব পুরুষ দেশভাগের সময় পূর্ববঙ্গ থেকে আসা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো অনেকে জন্মভূমি ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। আবার হাসান হাফিজুল হকের মতো অনেককে ভারত ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল বাংলাদেশে পার্থক্য ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রা এসেছিলেন বাধ্য হয়ে কিন্তু হাসান আজিজুলরা চলে এসেছিলেন জাতিগত টানে।
জন্মভূমি ছেড়ে আসার এই যে রক্তক্ষরণ নির্মমতার কালো দাগ তা পূর্ব বঙ্গের মানুষের শয়নে স্বপনে জাগরনে তাড়িয়ে বেড়ায়। সাংস্কৃতিক শূন্যতার এই বিষয়টি প:বঙ্গের কোন মাধ্যমে পাওয়া না গেলেও দুই দেশের ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজনই মনে করিয়ে দেয় কেন এই দেশভাগ পূর্ববঙ্গের ছিন্নমূল হিন্দুদের অস্তিমজ্জায় কাপন ধরিয়ে ছিল।
সূত্র: ফেসবুক
0 মন্তব্যসমূহ