দনুজমর্দনদেবের মুদ্রায় বঙ্গলিপিতে উৎকীর্ণ থাকত তার নাম ও উপাস্য দেবতার নাম |
জাতি হিসেবে বাঙ্গালীরা এযাবৎ চার সহস্র বছর ধরে পূর্ব ভারতে নিজেদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব বজায় রেখে আসছে। জাতি পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্যতার জন্য ধর্ম-সংস্কৃতির সাথে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যে শর্তটি অবস্থান করে তা হলো ভাষা। বিশেষত বাঙ্গালী জাতির মাতৃভাষা বা বাঙ্গলা ভাষা (Bengali language), বিশ্বের সর্বাধিক সাহিত্যসমৃদ্ধ ভাষাগুলোর তালিকায় যার জ্যোতিষ্কসুলভ উজ্জ্বল অবস্থান দৃশ্যমান, সেই বাঙ্গলা ভাষা (Bengali language) ও সাহিত্যের ক্রমবিবর্তন ও তার রাজকীয় পৃষ্ঠপোষনার বিষয়ে আলোকপাত করা প্রয়োজন।
প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এলেই বাঙ্গলা ভাষার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে নানারকম বিভ্রান্তি ও মিথ্যাচার ছড়ানো হয় কিছু বঙ্গবিদ্বেষী গোষ্ঠীর দ্বারা। একটি ভ্রান্ত ধারণা কয়েক দশক ধরেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছড়ানো হচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী ‘বাঙ্গালীর বধ্যভূমি’ বাংলাদেশই নাকি আধুনিক যুগে প্রথম বাঙ্গলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে, এবং মধ্যযুগে ইলিয়াস শাহ নামক ইরানের সিজিস্তানের অধিবাসী এক ‘বহিরাগত’ বিহারের নবাব নাকি প্রথম বাঙ্গলাকে ‘শাহী-জুবান’ করে এবং হোসেন শাহ নামক এক বহিরাগত আরবিভাষী সুলতান প্রথম এই ভাষায় সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে। এই নির্বোধ মিথ্যাচারীদের ন্যূনতম ধারণাও নেই একটি সুসংবদ্ধ জাতিস্বত্ত্বা হিসেবে এই ৩৬ কুলবিশিষ্ট ‘বাঙ্গালী’ জাতির মাতৃভাষা হিসেবে বাঙ্গলা ভাষার অস্তিত্ব কত সুপ্রাচীন যার শেকড়ের সাথে সনাতনধর্মীয় ধর্মসংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সুপ্রাচীন বৈদিক যুগ থেকেই পক্ষীমাতৃকা উপাসক আর্য বঙ্গ জনগোষ্ঠীর ‘পক্ষীভাষা’ থেকে গঙ্গাঋদ্ধি, গৌড়ীয় সভ্যতার ধারাপথ বেয়ে মধ্যযুগে স্বতন্ত্র সনাতনী বাঙ্গালী নৃপতিগণের রাজসভা ও নবদ্বীপ, নবহট্ট, বিষ্ণুপুর, শান্তিপুর, মঙ্গলকোট ইত্যাদি বঙ্গীয় সাংস্কৃতিক রাজধানীর পন্ডিতগণের ভাষাচর্চার একাগ্র নিষ্ঠায় তার আধুনিক রূপ প্রাপ্তি – বাঙ্গলা ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস অত্যন্ত সুপ্রাচীন । এই ঐতিহ্যের কৃতিত্ব কোনো মধ্যযুগীয় বহিরাগত হানাদারগোষ্ঠী কিংবা বহিরাগত ধর্মসংস্কৃতির আদর্শধারী রাষ্ট্রযন্ত্রটিকে অনায়াসে চুরি করতে দেওয়া যায়না । তাই সুপ্রাচীনকাল থেকেই বাঙ্গালায় উদ্ভূত বিভিন্ন সভ্যতার সাথে বাঙ্গলা ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস আলোচনায় এই নিবন্ধের অবতারণ করা হলো।
আদি যুগ
ঐতিহাসিকভাবে প্রথম একটি পৃথক ট্রাইব বা জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বঙ্গজাতির উল্লেখ পাওয়া যায় ‘ঋগ্বেদ’-এর ঐতরেয় আরণ্যকে। এখানেই বঙ্গজাতিকে ‘বয়াংসি’ বা পক্ষীভাষী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ জাতি হিসেবে বাঙ্গালীদের একটি স্বতন্ত্র ভাষা বৈদিক যুগ থেকেই বর্তমান তার স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। ঐতরেয় আরণ্যকের সেই শ্লোকটি হলো,
প্রজাহি তিস্র অত্যায়মীযুরিতি যা বৈ তা ইমাঃ প্রজাস্তিস্রো অত্যায়মায়ংস্তানীমানি বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চের-পাদান্যন্যা অর্কমভিতো বিবিশ্র ইতি। (ঐতরেয় আরণ্যক ২।১।১)
পক্ষীভাষী হিসেবে চিহ্নিত এই ‘বঙ্গ’, ‘বগধ’ ও ‘চেরপাদ’ জাতি ছিল সিন্ধু-সরস্বতী তীরবর্তী ভূমিতে বসবাসকারী আর্য গোত্রসমূহেরই তিন গোষ্ঠী, যারা পশুমেধ-যজ্ঞধর্মে অংশগ্রহণ না করে পূর্ব ভারতের দিকে অগ্রসর হয় এবং তাদের মধ্যে ‘বঙ্গ’ জাতি গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে একটি স্বতন্ত্র রাজ্য স্থাপন করে। আজকের বাঙ্গালী জাতির আদি পূর্বপুরুষ সেই সিন্ধু-সরস্বতী তীর থেকে আগত আর্যসভ্যতার ধারক ‘বঙ্গ’ জনগোষ্ঠী। ঋগ্বেদের অষ্টম মন্ডলের একটি মন্ত্র থেকে জানা যায়,
প্রজাহি তিস্রো অত্যায়মীযুর্ণান্যা অর্কমভিতো বিবিশ্রে
বৃহদ্ধ তস্থৌ ভুবনেষ্বেন্তঃ পবমানো হরিত অ বিবেশ। (ঋগ্বেদ ৮।১০১।১৪)
অর্থাৎ, সরস্বতী সভ্যতার বৈদিক আর্য জনগোষ্ঠীর তিন প্রজা অতিক্রমণ করে গমন করেছিল, অন্য প্রজাগণ অর্চনীয় অগ্নির চতুর্দিকে আশ্রয় করেছিল। ভুবন মধ্যে আদিত্য মহান হয়ে অবস্থান করেছিল।
বঙ্গ জাতিগোষ্ঠী প্রতীক বা টোটেম হিসেবে ‘পক্ষী’ ব্যবহার করতো। বাঙ্গালার সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্র পাণ্ডু রাজার ঢিবি (আনুমানিক ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) থেকে গঙ্গারিডি বা ‘গঙ্গাঋদ্ধি’ সভ্যতার চন্দ্রকেতুগড় পর্যন্ত একাধিক পক্ষীমাতৃকার মূর্তি ও পক্ষীমাতৃকা উপাসনার একাধিক নিদর্শন দেখা যায়। পক্ষীভাষী চিহ্নিত এই ‘বঙ্গ’ জাতি থেকেই যে পক্ষীমাতৃকা উপাসনার ধারা চলে আসছে তা সহজেই অনুমেয়। বঙ্গভাষার নির্দিষ্ট লিপি ছিল, ললিতবিস্তারে যাকে ‘অনামা লিপি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘বুদ্ধচরিত’ রচয়িতা অশ্বঘোষ উল্লেখ করেছেন,- গৌতম বুদ্ধ কপিলাবাস্তুর গুরুগৃহে বঙ্গলিপি অধ্যয়ন করতেন। বৈদিক সমাজে একে পক্ষীভাষা বলা হতো কারণ লিপির অক্ষরগুলো ব্রাত্য সংস্কৃতির পক্ষীমাতৃকার বিভিন্ন রূপ থেকে নির্মিত; এক একটি বাঙ্গলা বর্ণ বিভিন্ন তান্ত্রিক প্রতীক থেকে উদ্ভূত। সেজন্যই আজও তন্ত্রধর্মে বর্ণমালার উপাসনা করা হয়।
বাঙ্গালীর প্রাচীন গৌরবময় ‘গঙ্গাঋদ্ধি’ সভ্যতাতেও বাঙ্গলা ভাষার আদিরূপের উল্লেখ পাওয়া যায়। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতকের গঙ্গাঋদ্ধি সভ্যতার চন্দ্রকেতুগড় থেকে প্রাপ্ত একটি সীল/নামমুদ্রায় ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী উভয় লিপিতেই লিপিবদ্ধ ‘কোড়িহালিক করছুগমা’ নামক এক ধনাঢ্য কৃষকের উল্লেখ পাওয়া যায় যিনি এক কোটি হালের অধিপতি ও ব্রাহ্মণদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছেন। হালিক শব্দের অবস্থানে বাঙ্গালীজাতির বৃহত্তম কাস্ট ও প্রধান স্তম্ভ হালিক কৈবর্ত্যদের উপস্থিতি অনুমেয়। এঁর নাম করছুগমা সম্ভবত করসুগমার অপভ্রংশ, অর্থাৎ যাঁর হস্ত বা কর সর্বত্র সুগম।
প্রসঙ্গত, সিংহলিদের মধ্যেও এধরনের নামের প্রচলন দেখা যায়। গঙ্গাঋদ্ধি সভ্যতার সময়েই বাঙ্গালার সিংহপুরের যুবরাজ বিজয় সিংহ নিজ অনুচরবর্গসহ ৭০০ নৌকা নিয়ে লঙ্কাদ্বীপ জয় করেছিলেন । অধুনা সিংহলিরা যে বাঙ্গালী অভিবাসীদেরই বংশধর, তা বাঙ্গালীও সিংহলিদের মধ্যে ৭২% জেনেটিক মিল থেকেই প্রমাণিত। ভারতীয় উপমহাদেশের একেবারে দক্ষিণে থেকেও সিংহলি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অংশ, কারণ এর উৎস পূর্ব ভারতের বাঙ্গালা। বিজয় সিংহ যেদিন সিংহলে পদার্পন করেন সেদিনই গৌতম বুদ্ধ ইহলোক ত্যাগ করেন। গঙ্গাঋদ্ধি বঙ্গলিপির পাঠোদ্ধার করেছিলেন ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
প্রাচীন যুগ
সপ্তম শতাব্দীতে গৌড়ীয় সভ্যতার উত্থানের সাথেই বাঙ্গালার কথ্যভাষা হিসেবে উদ্ভূত হয় ’গৌড়ীয় প্রাকৃত’; শশাঙ্কযুগ (৫৯৩-৬৩৮ খ্রি:), চন্দ্র সাম্রাজ্যের সময়কালে এর বিস্তারের সময়। এরপর পালযুগে বজ্রযানী সিদ্ধাচার্য ও নাথপন্থী শৈবসাধকদের দ্বারা রচিত হয় ‘চর্যাপদ’, যা বাঙ্গলাভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে গৃহীত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর সম্পাদিত হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গলা বৌদ্ধ গান ও দোহা গ্রন্থের ভূমিকায় চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদ ও কৃষ্ণাচার্যের দোহা এবং ডাকার্ণব-কে সম্পূর্ণ প্রাচীন বাঙ্গলার নিদর্শন বলে দাবি করেছেন।
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘The Origin and Development of the Bengali Language’ গ্রন্থে চর্যাগান ও দোহাগুলির ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ ও ছন্দ বিশ্লেষণ করে শুধুমাত্র এইগুলিকেই প্রাচীন বাঙ্গলার নিদর্শন হিসাবে গ্রহণ করেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্যারিস থেকে প্রকাশিত ‘Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha’ গ্রন্থে সুনীতিকুমারের মত গ্রহণ করেন। পালবংশীয় সম্রাট গৌড়েশ্বর মহীপাল, মাহমুদ গজনভিকে পরাজিত করে বারাণসী ধাম রক্ষা করে ১০০টি ঈশান-চিত্রঘন্টা মন্দির নির্মাণ করে সারনাথে যে শিলালিপি স্থাপন করেন, তাতে আধুনিক বঙ্গলিপির বিকাশের আদিরূপ লক্ষ্য করেছেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ‘The Origin of Bengali Script’ গ্রন্থে তিনি সম্রাট মহীপালের সারনাথ শিলালিপিতে ‘অ, শ, হ, ল, ণ, ন’ প্রভৃতি অক্ষরকে সম্পূর্ণ বিকশিত বঙ্গীয়রূপ বলে উল্লিখিত করেছেন।
বাঙ্গলাভাষা রাজভাষা হিসেবে প্রকৃত মর্যাদা পায় সেন রাজবংশের শাসনকালে। সেনযুগেই প্রথম রাজকার্যে সিদ্ধমাতৃকালিপির পরিবর্তে গৌড়ীয় নাগরী বা বঙ্গলিপির ব্যবহার শুরু হয়। মহারাজ বিজয়সেনের দেওপাড়া প্রশস্তির লিপিকে আধুনিক বাঙ্গলা লিপি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, We come to Dē’ōpāṛā inscription of Vijayasena, where we find the modern Bengali alphabet…”। তিনি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন, এ সময়ে বাঙ্গলাবর্ণমালার ২২টির ক্ষেত্রেই আকৃতিগত উন্নয়ন সম্পূর্ণ হয়েছিল। এই কারণে, দেওপাড়া প্রশস্তিলিপিটিকে আধুনিক বাঙ্গলা বর্ণমালার পূর্বসূরি বলা হয়।
গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণসেনের রাজসভায় ধর্মনিষ্ঠ বৌদ্ধ শ্রমণ পুরুষোত্তম রচনা করেন গৌড়ীয় প্রাকৃত ভাষার ব্যাকরণ ‘লঘুবৃত্তি’ বা ‘ভাষা বৃত্তি’ । তাঁর রাজসভায় নারায়ন দত্ত রচনা করেন ‘ত্রিকান্ড শেষ’ নামক গৌড়ীয় অভিধান। গৌড়েশ্বর বিশ্বরূপ সেনের শাসনকালে প্রদত্ত ইদিলপুর তাম্রশাসনে আধুনিক বঙ্গলিপির প্রকৃত পরিপূর্ণ রূপ ফুটে ওঠে । এই তাম্রশাসন হইতে জানা যায় যে তাহার পিতা মহারাজ লক্ষ্মণ সেন দক্ষিণ সমুদ্রের কুলে শ্ৰীক্ষেত্রে, বারাণসীতে, বিশ্বেশ্বর ক্ষেত্রে এবং গঙ্গা-যমুনার সঙ্গম ত্রিবেণীতে ‘সমর জয় স্তম্ভ মালা’ স্থাপন করিয়াছিলেন । এটিই প্রথম সম্পুর্ন বিশুদ্ধ বঙ্গলিপিতে উৎকীর্ণ তাম্রশাসন।
সেনযুগের অবসান ও দেবযুগের সূচনার পূর্ব থেকেই দেববংশীয় রাজাদের বাঙ্গলাভাষা পৃষ্ঠপোষণার একাধিক নিদর্শন দেখা যায়। পাকামোড়া তাম্রশাসনে দেববংশীয় চতুর্থ নৃপতি রাজা দামোদর দেবের উল্লেখ রয়েছে যিনি তুর্কিদের পরাজিত করে গৌড়নগরী পুনরুদ্ধার করেন ও গৌড়ে মহোৎসব সম্পন্ন করেন। এই তাম্রশাসন সম্পূর্ন বঙ্গলিপিতে খোদিত। দেববংশীয় পঞ্চম নৃপতি বঙ্গাধিপতি দনুজমাধব দশরথদেব বা রাজা দনুজ রায়ের আদাবাড়ী তাম্রশাসনও বঙ্গলিপিতে উৎকীর্ণ। পাকামোড়া তাম্রশাসনের ভাগবত বিষ্ণুচক্রের নিম্নলিখিত বঙ্গাক্ষরীয় উল্লেখ রয়েছে, তিনিই সুদর্শনধারী বিষ্ণুপদধন্য দেবান্বয় কুলকমল নৃপতি দামোদর, যিনি গৌড়দেশের নষ্টশ্রী উদ্ধার করে গৌড়ে মহোৎসব সম্পন্ন করেছিলেন।
“খ্যাতো গৌড়মহীমহোৎসবময়ং চক্রে পুনশ্চ শ্রিয়া”
মহারাজাধিরাজ রামনাথ দনুজমর্দনদেব এর নেতৃত্বে অখণ্ড বাঙ্গালা সাম্রাজ্য স্থাপনের ফলে বাঙ্গালী জাতিস্বত্ত্বা ও ভাষা-সংস্কৃতি জগতে নব্য জোয়ার আসে। মহারাজ দনুজমর্দনদেব ও তাঁর পুত্র মহেন্দ্রদেব উভয়েরই পাণ্ডুয়া থেকে প্রাপ্ত দুইখানি মুদ্রা পাওয়া গেছে, যাতে স্পষ্ট বঙ্গলিপিতে উল্লিখিত এক পৃষ্ঠে ‘শ্রীচণ্ডীচরণপরায়ণ’ ও অন্য পৃষ্ঠে রাজার নাম’শ্রীশ্রীদনুজমর্দনদেব’/’শ্রীমন্মহেন্দ্রদেবস্যঃ’ । দেবশাসনাধীন নবহট্ট (অধুনা নৈহাটি) অঞ্চলে বিভিন্ন স্থান ব্রাহ্মণগণ এসে বসতি স্থাপন করতে থাকে। নবদ্বীপ অঞ্চলে বিভিন্ন টোল ও গুরুকূলে ব্রাহ্মণগণের শাস্ত্রচর্চায় বাঙ্গালী সংস্কৃতি নবউদ্যমে বিকশিত হতে থাকে। শিখরভূম রাজ্যের কুলগুরু আচার্য পদ্মনাভ, ‘পদচণ্ডিকা’ খ্যাত পন্ডিত বৃহস্পতি মিশ্র, কবি কৃত্তিবাস ওঝা প্রমুখ দিকপালগণ নবহট্টে রাজা দনুজমর্দনদেবের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। পরমভাগবত বৈষ্ণব দেববংশজাত রাজা রামনাথের পৃষ্ঠপোষণায় এখানে কৃত্তিবাস ওঝা রচনা করেন অষ্টকাণ্ডবিশিষ্ট ‘শ্রীরাম পাঁচালি’ বা বাঙ্গলারামায়ণ।
মল্লভূম
মল্লভূম রাজ্যের বাঙ্গলা ভাষা ও বাঙ্গালীরধর্ম-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষণা বিশেষ কৃতিত্বের দাবি রাখে। মল্লভূমের মাটিতেই বৈষ্ণব পদাবলী কীর্তন প্রভাবে উৎপন্ন হয় বাঙ্গালার নিজস্ব ধ্রুপদী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতরীতি বিষ্ণুপুরী ঘরানা। ১৩৭০ খ্রিস্টাব্দে মল্লভূমের মহারাজা শিবসিংহ মল্লর রাজত্বকালে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাসের সময়কাল থেকে বিষ্ণুপুর ঘরানার আদি পর্বের সূচনা হয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন গীতগোবিন্দের আদর্শে বাঙ্গলাভাষায় রচিত, রাগ-তালে নিবদ্ধ প্রথম কাহিনি কাব্য যা একই সাথে কাব্য ও গীতির সংমিশ্রণে সৃষ্ট। মল্লরাজ বীর হাম্বীরের শাসনকালে (১৫৮৬ – ১৬২০) শ্রীনিবাস আচার্য (জন্ম – ১৫১৬) শাস্ত্রীয় কীর্তন ও শাস্ত্রীয় কথকতায় মল্লরাজসভা বিজয় করলে রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের পুনরুত্থান ঘটে। অনেকে মনে করেন খেতুরির মহোৎসবে নরোত্তম দাস উদ্ভাবিত শাস্ত্রীয় কীর্ত্তন থেকেই বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রবর্তন ঘটে।
রাঢ়বঙ্গের প্রসিদ্ধ কবি কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী। মধ্যযুগে বিষ্ণুপুরের রাজা রঘুনাথ সিংহমল্লর পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের ভাবানুবাদ পালাগান রূপে রচনা করেছেন বিষ্ণুপুরী রামায়ণ, যা বাঙ্গলা সাহিত্যের অমূল্য নিদর্শন । বিষ্ণুপুরী রামায়ণের ‘হনুমানের অঙ্গীকার’ পালাতে রয়েছে,
শুনিয়া হনুর কথা সুখী রঘুমণি।
কহেন বানরে তোমা বীরেতে বাখানি।
তোমায় দুঃখিত আমি কদাচিৎ নই।
তোমার সাহস দেখ্যা ধন্য ধন্য কই।।
সপ্তদশ শতকের শিবায়ন কাব্যধারায় স্মরণীয় হয়ে আছেন শঙ্কর কবিচন্দ্র। মল্লভূমরাজ গোপাল সিংহ মল্লর (১৭১৮-৪৮ খ্রীঃ) রাজসভায় তিনি ছিলেন সভাকবি। তাঁর লিখিত ‘মচ্ছধরা পালা’ এবং মাখনলাল মুখোপাধ্যায় উল্লিখিত ‘শঙ্খপরা পালা’-টি তার রচনা বলে জানা যায়। ‘মচ্ছধরা’ বা মৎসধরা পালাটি শিবায়নের লোকপ্রচলিত কাহিনীর প্রথম লিখিত রূপ বলা যায়। কৃষাণ ও জালিক শিবের প্রথম পূর্ণাঙ্গ চরিত্রাঙ্কনের কৃতিত্ব শঙ্কর কবিচন্দ্রের প্রাপ্য। তিনি বাগ্দিনীবেশিনী দেবীর বর্ণনা করেছেন,
বাগ্দিনী বেশ করি উভ করি খোঁপা।
পুষ্পমালা তাতে শোভে সুবর্ণের ঝাপা।
কান্ধেতে ঘুনসি জাল ইসাদের কড়ি।
পরিপাটি কান্ধে সাজে মরে চুপড়ি।
ভূরিশ্রেষ্ঠ
মধ্যযুগে বাঙ্গালার সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণে ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষণায় ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের রাজণ্যবর্গের ভূমিকা অপরিসীম । ভূরিশ্রেষ্ঠরাজ দেবনারায়ণ রায়মুখুটির শাসনকালে ১৪০৬ শকাব্দের ২১ শ্রাবণ (১৪৮৪ খ্রিস্টাব্দে) রাজ্যের মণিনাথ শিবমন্দির থেকে বঙ্গলিপিতে খোদিত রাজার নাম উল্লিখিত এক শিলালিপি স্থাপিত হয়।
শ্রীভগবতঃ বামদেব মণিনাথস্য
দেবনারায়ণ-স্থাপিতমিদং হৈবতম্ ।।
১৪০৬ শকে। ২১ শ্রাবণ (দিনে)
মণিনাথ-শিবলিঙ্গটি সুপ্রাচীন এবং মন্দিরটি সংস্কৃত হোক বা পরবর্তী কালে পুনর্গঠিত হোক, এই মন্দিরে প্রাপ্ত শিলালিপিতে মহারাজা দেবনারায়ণের নাম সুস্পষ্ট লিখিত আছে, লিপি অনুসারে রাজা দেবনারায়ণ মণিনাথশিববিগ্রহ ও মন্দিরের আদি ও প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।
মহারাজ দেবনারায়ণের শাসনের স্বর্ণময় দিনগুলির বর্ণনায় ভূরিশ্ৰেষ্ঠ প্রজাবর্গ বাঙ্গলা ভাষায় বেশ কিছু ধুয়া ধরনের গান রচনা করে। গতশতকের শেষভাগে ও বর্তমান শতকের প্রথম পাদেও বাঙ্গালার পল্লীগ্রামের মাঠেঘাটে পথচারী বাউল ও ভিথারী-গায়কের মুখে এইরূপ পদ শোনা যেত।
দেবানন্দ দক্ষিণ রায়!
দেবদেব নারায়ণ দোঁহা একে ভায়।
(মরি রে ভবানীপুরের রায়গুণমণি)॥ ধুয়া।।
এমত রে আচরিত রসমিত কথা!
ঊরে দেবী অম্বিকা বাঁয় ভোগবতী সতা |
চৌদিশে বেঢ়নে রমা ভুঞ্জে সুখ মনে,
দেব বৃহস্পতি শুক্র দোসর দেবনারায়ণে।
সুতহিবুক ভাগ্যের ফল মেলায় মেলানি,
বরগলে সাজে মণিহার গাঁথা পঞ্চরাণী।
(মরি রে রায়গুণমণি)॥
এ বটে পীরিতি রীত, তবু বলে সুনাসীর,
অবরেসবরে ধরে রে করে বজরতীর।
দীনদুখীজন পিতামাতা পাইল রে রাজায়,
ভাবে দক্ষিণে দক্ষিণা সগুণ বাখানি নে যায়।
(মরি রে রায়গুণমণি) ॥
ভূরিশ্রেষ্ঠরাজ উদয়নারায়ণ রায়মুখুটি ছিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি স্ত্রী বিন্দুরতিসহ সস্ত্রীক মহাপ্রভুর নিকট গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করেন ও পৃষ্ঠপোষণা করেন। উড়িষ্যা ও আসামের মন্দির ধ্বংসের প্রতিশোধরূপে তিনি গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহকে পরপর তিনটি যুদ্ধে পরাজিত করে বাঙ্গালীসমাজের রক্ষাকর্তা হয়ে ওঠেন। সারা বাঙ্গালারঅসংখ্য ধার্মিক বৈষ্ণব, ব্রাহ্মণ, সাধক, সাহিত্যিক ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যে আশ্রয় নিয়ে তাঁর পৃষ্ঠপোষণা লাভ করেন। তাঁর রাজসভায় কবি শ্রীধর বিদ্যাসুন্দরের ছন্দোবদ্ধ প্রেম-গাথা রচনা করেন । তাঁর রাজসভায় বাঙ্গলা সাহিত্য উৎকর্ষতার মহৎ নিদর্শন বৈষ্ণব কীর্ত্তনগীতি পৃষ্ঠপোষনা হয় । রাজা উদয়নারায়ণ বিভিন্ন প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথি সংগ্রহ এবং তন্ত্র ও ধর্ম বিষয়ক একদিন পুঁথি বাঙ্গলাভাষায় অনুবাদ করতে ভূরিশ্রেষ্ঠের পণ্ডিতগণকে উৎসাহ প্রদান করেন।
রায়বাঘিনীপুত্র ভূরিশ্রেষ্ঠরাজ প্রতাপনারায়ণের শাসনকাল রীতিমতো বাঙ্গলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত সাহিত্যিক ভরত মল্লিক তাঁর রাজসভায় ‘রত্নপ্রভা’ ও ‘চন্দ্রপ্রভা’ নামে দুই অসাধারণ সাহিত্যকর্ম রচনা করেন। এখানেই কবি রামদাস আদক ‘অনাদিমঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন। প্রতাপনারায়ণ কৃষ্ণনগরের খানাকুলের কাছে একটি সংস্কৃত গুরুকুল প্রতিষ্ঠা করেন যা তৎকালীন ‘ন্যায়শাস্ত্র’ অধ্যয়নের আদর্শ পীঠস্থান হয়ে ওঠে।
কোচবিহার
উত্তরবঙ্গে কোচবিহার রাজ্যের রাজন্যবর্গ বাঙ্গলা ভাষার উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষক। কোচবিহারের রাজকীয় নারায়ণী মুদ্রাসকল চিরকাল বঙ্গলিপিতে খোদিত হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কোচবিহারের নারায়ণী মুদ্রায় রাজাদের নামে সর্বদাই বাঙ্গলা ‘র’-অক্ষর ব্যবহার হয়েছে, অসমীয়া ‘ৰ’ নয়, কারণ কোচবিহারের রাজারা বাঙ্গালী ছিলেন, কোচবিহারের রাজভাষা ছিল বাঙ্গলাএবং আজকের কোচবিহার প্রাচীন বাঙ্গালার পুন্ড্রবর্ধন জনপদের অংশ। কোচবিহার রাজসভাতেই শ্রী রাধাকৃষ্ণ দাস বৈরাগী রচনা করেন বাঙ্গলাভাষার মঙ্গলকাব্য ‘গোসানীমঙ্গল’।
১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে কোচ নৃপতি নরনারায়ণ আহোম রাজা চুকামফাকে সম্পুর্ন বাঙ্গলাভাষায় একটি পত্র প্রেরণ করেছিলেন, যা বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। বাঙ্গলা গদ্য সাহিত্যের আদি নিদর্শন এই পত্রটির কিছু অংশ,
“…লেখনং কার্যাঞ্চ। এথা আমার কুশল। তোমার কুশল নিরন্তরে বাঞ্ছা করি। অখন তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রাপত্রি গতায়ত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে। তোমার আমার কর্ত্তব্যে বার্দ্ধতাক পাই পুষ্পিত ফলিত হইবেক। আমরা সেই উদ্যোগত আছি…”
আসামের তেজপুর থেকে প্রকাশিত ‘আসামবন্তি’ পত্রিকার ২৭ জুন ১৯০১ সংখ্যায় এই চিঠির পুরোটা ছাপা হবার পর হইচই পড়ে যায়। বাঙ্গলা গদ্য সাহিত্যের আলোচনায় আজও অনিবার্যভাবে এসে যায় কোচ রাজার লেখা এই চিঠিটি।
কাছাড়
অধুনা আসামের কাছাড় জেলা ছিল ডিমাসা রাজার শাসনাধীন। ডিমাসা রাজদরবারের ভাষা ছিল বাঙ্গলা। ডিমাসা বা কাছাড়ি রাজত্বে ঋণদান ও দণ্ডদান বিধি বাঙ্গলায়লেখা হত। সপ্তদশ শতকে কাছাড়ি রাজসভার কবি ভুবনেশ্বর বাচস্পতি পয়ার ছন্দে নারদীয় রসামৃত বাঙ্গলায়অনুবাদ করেন। পরের শতকে রাজা সুরদর্প নারায়ণ সম্পর্কে কবি চন্দ্রমোহন বর্মণ লেখেন,
হেথায় হেড়ম্ব দেশে সুরদর্প রাজা
আশ্বিনে প্রতিমা গড়ি করে দুর্গাপূজা।
বর্তমান বরাক উপত্যকায় বাঙ্গলাপ্রচলন ও প্রসারের ইতিহাসের সূত্র মধ্যযুগেও পাওয়া যায়। অপর দিকে ডিমাসা রাজা সুরদর্প নারায়ণের (১৭০৮-১৭২০) আমলে রচিত ‘কাছাড়ি আইন’ প্রাচীন বাঙ্গলা গদ্যের একটি নমুনা।
জাতি ও গুণেতে সমান ব্যাক্তিতে ক্রোধ করিয়া যদি ভষ্ম ও অঙ্গার ক্ষেপ করে ও কিংবা কর তাড়না করে তবে রাজাতে দুই রত্তি সুবর্ণ দণ্ড দিতে হয়। পরস্ত্রীতে যদি ক্রোধত এমত করে তবে ৪ চাইর রত্তি দণ্ড দিতে হয়।
প্রায় ৩২০ বছর আগে ডিমাসা রাজবংশের শেষ রাজা গোবিন্দ চন্দ্র নারায়ণের উদ্যোগে নির্মিত হয় দশভূজা দুর্গামন্দির, যেখানে আজও বাঙালি ব্রাহ্মণ পুরোহিত দিয়ে পুজো সম্পন্ন হয়।
ত্রিপুরা
ত্রিপুরা রাজ্যের মুদ্রা ও অধিকাংশ তাম্রশাসনই বাঙ্গলাভাষা ও বঙ্গলিপিতে লেখা হতো। শুধু তাই নয়, বাঙ্গলাসাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় ত্রিপুরার মানিক্য রাজবংশের অবদান অনস্বীকার্য।ত্রিপুরার রাজদরবারে বাঙ্গলাভাষার চর্চা আরম্ভ হয় মহারাজ রত্ন মাণিক্যের সময় থেকে। এ সম্পর্কে রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস লেখক শ্রী কৈলাস চন্দ্র সিংহ তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন, মহারাজ রত্ন মাণিক্যের সেনবংশ শাসনাধীন বঙ্গদেশের সাথে তাঁদের সংশ্রব ঘটতে থাকে। এজন্য ত্রিপুরা রাজ্যে বাঙ্গালা ভাষায় রাজকার্য- নির্বাহ আবশ্যক হইয়াছিল। রাজা রত্ন মানিক্য তৎকালীন সেনশাসনাধীন লক্ষণাবতী অর্থাৎ বাঙ্গালার রাজধানী গৌড় থেকে তিনজন বাঙ্গালীকর্মচারী আনয়ন করে সম্মানে ত্রিপুরায় পুনর্বাসন করে সকল-সুযোগ সুবিধা দিয়ে রাজকার্যে নিয়োজিত করেন। বলা যায় এরপর থেকে ত্রিপুরার রাজসভায় বাঙ্গলাভাষা চর্চার ক্রমবিকাশের শুরু। ত্রিপুরার মাণিক্যবংশীয় রাজাদের মুদ্রা চিরকালই বঙ্গলিপিতে খোদিত করা হয়েছে ।
মহারাজ ধর্মমাণিক্যের শাসনামলে ১৪০৭ খ্রিস্টাব্দে রাজপতি শুক্রেশ্বর ও রানেশ্বর মহারাজের নির্দেশে ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস ‘রাজমালা’ রচনা করেন। পরবর্তীতে মহারাজ অমর মাণিক্যের (১৫৯৭ খৃঃ) শাসনামলে পরিবর্তিত আকারে রাজমালা পয়ারাদি ছন্দে পুনঃপ্রকাশ করেন। যা প্রাচীন রাজমালা হিসেবে খ্যাত। এটি বাঙ্গলা সাহিত্যের প্রাচীনতম গ্রন্থসমূহের অন্যতম। ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে ধর্মমাণিক্য (২য়) ত্রিপুরার শাসনভার গ্রহণ করেন, তিনি মহাভারতের বাঙ্গলাঅনুবাদ করান। হারুন হাবিব তার ‘রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ধন মাণিক্যের (১৪৯০ খৃঃ) আমলে রচিত হয় ‘উৎকল কণ্ঠ’ ‘পাচারী যাত্রা’ ‘রত্নকর নিধি’ গ্রন্থসমূহ। প্রজাগণকে সঙ্গীত শিক্ষা দানের জন্য তিনি সুদূর মিথিলা থেকে সঙ্গীতজ্ঞদের ত্রিপুরায় আনিয়াছিলেন। মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্যের শাসনামলে (১৬৫৯, ১৬৬৬-১৬৬৯ খৃঃ) বাঙ্গলায়অনূদিত হয় ‘বৃহন্নারদীয় পুরাণ’, জগৎমাণিক্যের শাসনামলে (১৭৩২ খৃঃ) হয় ‘ক্রিয়া যোগসার’ এর বঙ্গানুবাদ এবং কৃষ্ণ মাণিক্যের (১৭৬০ খৃঃ) আমলে রচিত হয়েছিল কৃষ্ণ বিজয় ও চম্পক বিজয় কাব্য। মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের শাসনামলে (১৮৩০ খৃঃ) বৈষ্ণব পদাবলী বাঙ্গলায়’গীত চন্দ্রোদয়’ পুঁথি রচিত হয়। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে রাজ কর্মচারী নারীদের জন্য সংকলিত হয় ‘ভার্যা উপদেশ’।
ত্রিপুরার রাজসভায় বাঙ্গলাভাষা চর্চার উৎকর্ষ সাধিত হয় মূলত উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের শাসনামল থেকে। আধুনিক ত্রিপুরার রূপকার বীরচন্দ্র ছিলেন কাব্যরসিক কলাবিদ সুগায়ক এবং বাঙ্গলাসাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। তিনি রচনা করেন ‘হোরী ঝুলন’, ‘অকাল কুসুম’, ‘উচ্ছ্বাস’, ‘সোহাগ’, ‘প্রেম মরীচিকা’ প্রভৃতি গীতিকাব্য। ১৮৮২ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘ভগ্নহৃদয়’ কাব্য পাঠ করে তার ভেতর প্রতিভার বিচ্ছুরণ দেখতে পেয়েই জোড়া সাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রাজদূত পাঠিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে রবীন্দ্রনাথকে কবিরূপে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, যা রবীন্দ্রনাথ তা সারা জীবন মনে রেখে ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরা মহারাজ প্রদত্ত ‘ভারত ভাস্কর’ সম্মাননা প্রাপ্তির পর রবীন্দ্রনাথ তার ভাষণে, বীরচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছিলেন । ত্রিপুরা রাজাদের বাঙ্গলাভাষার প্রতি মমত্ববোধের আর ও পরিচয় পাই ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লা শহরে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের দ্বাবিংশ অধিবেশন উদ্বোধন উপলক্ষে ত্রিপুরার সর্বশেষ মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুরের ভাষণ থেকে। তিনি বলেন, ত্রিপুরা রাজ্যের রাষ্ট্রভাষা যে বাঙ্গলাআপনারা অবগত আছেন। তথাকার যাবতীয় সরকারি কার্য একান্তভাবে বাঙ্গলা ভাষায় পরিচালিত হইয়া থাকে। তথাকার শিলালিপি, তাম্রলিপি, অনুশাসন, মুদ্রা, মোহর প্রভৃতিতে বাঙ্গলাভাষা ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে।
অতএব নিজস্ব মাতৃভাষা একটি সুসংবদ্ধ জাতিস্বত্ত্বা হিসেবে বাঙ্গালী জাতির অস্তিত্ব বৈদিকযুগ থেকেই বিদ্যমান। তার সাথে এও প্রমাণিত এই বঙ্গভাষার সাহিত্য সংস্কৃতিতে অধিকার কেবল তাদেরই যারা এই ভাষার সাথে সম্পৃক্ত দেশজ ধর্ম-সংস্কৃতি অনুসরণ করে । বাঙ্গলা ভাষা ও বাঙ্গালার মাটিতে অধিকার কেবল তাদেরই যারা গঙ্গাঋদ্ধি সভ্যতার মাতৃকার উপাসনা করে, যারা গৌড়ীয় সভ্যতার শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। চর্যাপদজাত এই বঙ্গভাষায় অধিকার কেবল তাদের যারা চর্যাপদ রচিয়তা নাথ শৈব সাধক ও বজ্রযানী সিদ্ধাচার্যদের সংস্কৃতির বংশধর । তারা এই ভাষার উত্তরাধিকার কখনোই পেতে পারে না যারা নালন্দা বৌদ্ধবিহার ধ্বংসকারী ও নালন্দার বৌদ্ধ শ্রমণদের গণহত্যা চালানো বখতিয়ার খিলজির ‘ইবাদত’ করে। তেমনই বিহারসংলগ্ন বাঙ্গলার কয়েকটা জেলাতে ফার্সি খোদিত মুদ্রা চালানো আর আরবি ভাষায় ‘কিতাব’ লেখানো এই ইলিয়াস শাহ বা হোসেন শাহরা বাঙ্গলা ভাষার পৃষ্ঠপোষক নামক মিথ্যাচারের অংশ হতে পারেন না। তাদের মুদ্রা শিলালিপি কোথাও বাঙ্গলা ভাষা বা বঙ্গলিপি ব্যবহার হয়নি। কোনো বাঙ্গালী সভাকবি রাখেননি, কোনো গ্রন্থ রচনায় উৎসাহ দেননি।
মধ্যযুগে যা কিছু বাঙ্গলা সাহিত্য রচিত হয়েছে সেগুলো চন্দ্রদ্বীপ, ভূরিশ্রেষ্ঠ, মল্লভূম, ত্রিপুরা, কাছাড়, কোচবিহারের মতো বাঙ্গালার স্বাধীন রাজ্যগুলোর সনাতনধর্মীয় নৃপতিদের রাজসভায় বাঙ্গালী পণ্ডিত, সাধক, সিদ্ধাচার্য, কীর্তনিয়া, কবি-সাহিত্যিকরা বঙ্গীয় রাজপৃষ্ঠপোষণায় রচনা করেছেন। বাঙ্গালী সনাতনী শাসকরাই মুদ্রা, শিলালিপি, তাম্রশাসন, শাসনবিধি, ইতিহাস, সাহিত্য ইত্যাদিতে বাঙ্গলা ব্যবহার করেছেন। তাই সর্বতোভাবেই প্রমাণিত হয় বাঙ্গলা ভাষা ও বাঙ্গালী জাতিপরিচয়ে অধিকার শুধুই তাদের যারা বাঙ্গালার এই চার সহস্র বছরের প্রাচীন ধর্মসংস্কৃতি অনুসরণ করে ও বাঙ্গলা ভাষার পৃষ্ঠপোষণাকারী রাজন্যবর্গদের আদর্শ মনে করে।
প্রথম প্রকাশ: বঙ্গদর্শন
0 মন্তব্যসমূহ