একটি দৃশ্যে আশীষ খন্দকার (মাঝে) |
শেরিফ আল সায়ার
২৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১৫:৪৪
এক সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। আর তাই ইতিহাসের পরতে পরতে রয়েছে যুদ্ধের নানা গল্প। যার অধিকাংশই আমাদের অজানা। কারণ, ইতিহাসের পাতায় যেসব গল্প বারবার উঠে আসে তার অধিকাংশই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ দেশের আপামর জনতার ওপর যুদ্ধ কীভাবে নেমে এলো তার গল্পগুলো দীর্ঘদিন থাকে আড়ালে। যুদ্ধের ভয়াবহতা যে শুধু অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ কিংবা একজন নারীর সম্ভ্রম হারানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ওপর যেভাবে এসেছিল যুদ্ধ– সেসব গল্প সময়ের আবর্তে ফিরে আসছে এখন। আফসান চৌধুরীর তেমনই একটি গল্প ‘ধড়’।
বাঙালির ওপর নেমে আসা ভয়াবহ যুদ্ধ কীভাবে তাদের জীবনটাকে তছনছ করে দিলো, একই সঙ্গে কীভাবে তারা যুদ্ধের পরিণতি মেনে নিলো সেসব রয়েছে এই গল্পে। তার চাইতে বড় বিষয় পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞের অন্যতম টার্গেট ছিল দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর পরিবারগুলোর দুর্দশার গল্প যেন ইতিহাস থেকেই হারিয়ে গেছে। নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটি পরিবারকে তুলে আনা হয়েছে ‘ধড়’ গল্পে। আর সেই গল্প অবলম্বনে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তি পেলো নির্মাতা আকা রেজা গালিবের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ধড়’।
সরকারি অনুদানে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি দেওয়া হয়েছে অন্তর্জাল মাধ্যমে।
আকা রেজা গালিব দীর্ঘদিন ধরে বিকল্প ধারা চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তার প্রথম নির্মাণ ছিল পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘কালের পুতুল’। আলোচনায় যাওয়ার আগে বলে নেওয়া ভালো, আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশে বিকল্প ধারা চলচ্চিত্রের সুবাতাস বইতে থাকে। এর গোড়াপত্তন ঘটে মোরশেদুল ইসলাম নির্মিত ‘আগামী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৮৪ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সমাজ, মুক্তিযোদ্ধাদের তৎকালীন পরিণতি ও স্বাধীনতা বিরোধীদের ক্ষমতার গদির স্বাদ গ্রহণের বিষয়গুলো উঠে এসেছিল। ‘আগামী’ ছিল বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।
তবে সাহিত্যনির্ভর প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ছিল তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত ‘হুলিয়া’। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে একজন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীর জীবন-আখ্যান কবি নির্মলেন্দু গুণের দীর্ঘ কবিতা ‘হুলিয়া’ অবলম্বনে তানভীর মোকাম্মেল নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৮৫ সালে।
এবার আসা যাক সাহিত্য থেকে উঠে আসা আকা রেজা গালিবের চলচ্চিত্র ‘ধড়’ কেমন হলো সেই প্রসঙ্গে। মাত্র ২৫ মিনিটের এই চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে যুদ্ধকালীন হিন্দু একটি পরিবারের বেদনার আখ্যান। নিতান্ত নিম্নবিত্ত পরিবারে স্বামী-স্ত্রী ও দুই সন্তানের গল্প। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মমতাকে আরও ভয়ানক রূপ দেয় এ দেশের কিছু রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস। এ দেশের জনগোষ্ঠীগুলোর অবস্থান চিহ্নিত করতে এরাই ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মূল অস্ত্র। সেই সূত্রেই পর্দায় আমরা দেখি একটি গ্রামের হিন্দু নিধনে কীভাবে এই রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করেছে। আমরা চলচ্চিত্রে দেখি যখন হিন্দু নিধনে বের হয় পাকিস্তানি সেনা সদস্য তখন এক রাজাকার আলাদা করে একটি দা সঙ্গে করে নেয়। আমরা বুঝে নিতে পারি, সেনাবাহিনী গুলি চালাবে আর এই রাজাকাররা লাশগুলোর মাথা থেকে আলাদা করে ফেলবে ধড়। এটা করার জন্য তার কোনও নির্দেশনার প্রয়োজন হয়নি। স্বেচ্ছায়, নিজ আগ্রহে নিজ দেশের একটি জনগোষ্ঠীর ওপর এরা হত্যাযজ্ঞ ও নৃশংসতা চালায় এভাবেই।
ধর্মীয় পরিচয় ছিল হত্যাযজ্ঞের টার্গেট
আমরা যুগ যুগ ধরে বলে এসেছিলাম এই ভূমিতে হিন্দু-মুসলমান বন্ধুর মতো জীবনযাপন করে এসেছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ইতিহাসের পাতায় নজর দিলে দেখা যায় এই দুই জনগোষ্ঠীর কম-বেশি বিরোধ অত্যন্ত পুরনো। এক্ষেত্রে বদরুদ্দীন উমরের একটি প্রবন্ধের কয়েকটি লাইন তুলে ধরা যেতে পারে। ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় এবং সামাজিক চিন্তার ব্যবধান অনেক। এই ব্যবধানের ফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক পর্যায়ে যে পরিমাণ লেনদেন হওয়ার কথা ছিল, তা কোনও দিনই হয়নি। সামাজিক লেনদেন এবং বিবেচনাই ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্য প্রীতি এবং মিলন সংস্থাপনের অন্যতম পথ। সে পথে বিভিন্ন কারণে সন্তোষজনকভাবে উন্মুক্ত না থাকাই অন্যতম কারণ। যার জন্য ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান শত শত বছর পাশাপাশি থাকা সত্ত্বেও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি আজও।’
সুতরাং ১৯৪৭ সাল এই ভূমি ধর্মীয় ভিত্তিতে ভাগ হলে হিন্দু জনগোষ্ঠী পরিণত হয় সংখ্যালঘুতে। সদ্য ক্ষমতাবান মুসলিমদের একটা শ্রেণি তাদের ওপর নিপীড়ন চালাতে থাকে। আর তাদের জন্য সুযোগটা আরও বৃহৎ করে দেয় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম। গোটা কয়েক মুসলিমের টার্গেটে পরিণত হয় হিন্দু জনগোষ্ঠী।
আর ‘ধড়’ চলচ্চিত্রটি সেই জনগোষ্ঠীর গ্রামের একটি পরিবারের গল্পকে নিপুণভাবে তুলে আনা হয়েছে। যেখানে আমরা দেখতে পাই স্ত্রী মালতী যখন জানতে পারেন তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে, তখন তিনি নির্বাক থাকেন। দর্শক ভাববে এই বুঝি কান্নায় ভেঙে পড়বেন মালতী। কিন্তু না, তিনি স্বামীর মৃত্যু মেনে নেন। এই যে বাঙালির ওপর চাপানো যুদ্ধ সেটাই যেন মেনে নেন মালতী।
মুণ্ডু ও ধড় নিয়ে যখন মা তার দুই সন্তানসহ রওনা দেন লাশটিকে চিতায় দেওয়ার উদ্দেশে, ঠিক তখন রাজাকাররা তাদের প্রতিরোধ করে। ধর্মীয় পরিচয় জানার জন্য লাশের খৎনা হয়েছে কিনা সেটাও নিশ্চিত হতে চায়। এই যে একজন মৃত ব্যক্তির খৎনা হওয়ার বিষয়কেও টার্গেট করা হয়েছে এর চাইতে ভয়ংকর নির্মমতা আর কী হতে পারে?
ধর্মীয় পরিচয় প্রভাব ফেলে মনোজগতে
ধর্মীয় আতঙ্ক যে শুধু হত্যাযজ্ঞের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল বিষয়টা তেমনও নয়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল এই জনগোষ্ঠী। নিজের ধর্মীয় পরিচয় নিয়েও ছিলেন আতঙ্কে। একজন শিশুর মধ্যেও সেটা ছিল প্রবাহিত। যেমন, চলচ্চিত্রে আমরা দেখতে পাই পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠ পুত্রের নাম কমল। বাবা তাকে শিখিয়েছে, তার নাম কামাল এবং সে ভালো ছেলে। আর এই যে নিজের আত্মপরিচয়কে ভুলে নতুন পরিচয় ধারণ করা- এই ঘটনা তার মনের গহিনে এক তীব্র ক্ষত তৈরি করেছিল। তাই ঘুম থেকেও সে লাফ দিয়ে জেগে ওঠে বলতে থাকে, ‘আমার নাম কামাল, আমি ভালো ছেলে’।
এমন একটি ঘটনা আমরা মোরশেদুল ইসলাম নির্মিত ‘অনিল বাগচীর একদিন’ চলচ্চিত্রেও দেখতে পাই। যেখানে অনিল বাগচী সারাক্ষণ তার ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে আতঙ্কে বসবাস করতে থাকে। সারাক্ষণ ভাবতে থাকে এই বুঝি তাকে ধরে ফেললো পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।
সবার ওপরই নেমে এসেছিল যুদ্ধ
‘ধড়’ চলচ্চিত্রে পরিবারের দুই সন্তান বিমলা ও কমলকে যখন তাদের পিতা হত্যার খবর মালতী দেয়- তখনও দুই সন্তান থাকে নির্বাক। যেন এই পরিণতি তারাও মেনে নিয়েছে। এরপর যখন সরকারি এক দফতরের বাইরে পিতার লাশ আনতে যায় তখন মুণ্ডু আর ধড় আলাদাভাবে দেখে যেন বীভৎস পরিস্থিতির শিকার হয়। সরকারি এক দফতরিকে সেনাবাহিনী দায়িত্ব দেয় লাশ বুঝিয়ে দেওয়ার। সেই দফতরিরও মানসিক বীভৎসতা আমরা দেখতে পাই। সেও এই বীভৎসতা মেনে নিতে পারেনি, তবু এ কাজটা তাকে করতে হচ্ছে- কুকুর তাড়ানোর মধ্য দিয়ে। এছাড়াও মালতীর স্বামীর কাজের সঙ্গী কানাই কোনোমতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে বেঁচে গেলেও দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। এটাই যুদ্ধ! যে যুদ্ধ নানানভাবে নেমে এসেছিল এ দেশের প্রতিটি জনতার মাঝে।
অসাম্প্রদায়িক বাংলার রূপ
অসাম্প্রদায়িক বাংলার রূপটি কেমন হবে? এই চলচ্চিত্রে তার কিছু ঝলক নিপুণভাবে রেখে দেন নির্মাতা। সরকারি দফতরি মুসলমান। তবু হিন্দু লাশের প্রতি তার দরদ, পরিবারের প্রতি দরদ। হিন্দু পরিবারটি যখন জানতে পারে যে ধড়টি বহন করে নিয়ে চলেছে সেটা আসলে একজন মুসলমানের লাশ, তখন তারা সিদ্ধান্ত নেয় লাশটি ফিরিয়ে দিতে। এই পারস্পরিক দরদ, মায়া, সম্মান- এর জন্যই ছিল আমাদের যুদ্ধ। এটাই হলো অসাম্প্রদায়িক বাঙালির পরিচয়।
উপসংহার
এই চলচ্চিত্রের সবয়ে বড় দিক হলো, এখানে কোনও তারকা নেই। কিন্তু আছেন কয়েকজন দুর্দান্ত অভিনয়শিল্পী। তারা হলেন, লুসি তৃপ্তি গোমেজ, দীপক সুমন, তাসমিম জামান স্বর্ণা, অর্ণব রায় অংকন, আল-মামুন রুপান্ত, তন্ময় ঘোষ, দুখু সুমন, জাকির হোসেন রাসেল ও আশীষ খন্দকার। তাদের অভিনয় মুন্সিয়ানায় একাত্তরের এক নির্মম অধ্যায় পর্দায় উঠে এসেছে। এছাড়াও সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ মোটেও সহজ কাজ নয়। পরিচালক আকা রেজা গালিব সে জায়গাতেও মাত্র ২৫ মিনিটে পুরো নির্মমতা তুলে ধরেছেন।
চলচ্চিত্রের শুরুতে বিচ্ছিন্ন কিছু গ্রামের প্রকৃতির দৃশ্য দেখানো হয়। যেন নির্মাতা বলতে চান, এই বাংলার সবুজ কোলাহল প্রকৃতিও নির্মমতার সাক্ষী হয়ে যেন নিশ্চুপ হয়ে আছে। যে বাংলার প্রতিটি মানুষ এই ভয়াবহ যুদ্ধের শিকার হয়েছেন, সে বাংলার প্রকৃতিও তো রক্ষা পায়নি। যেন কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে এ দেশের শহর, গ্রাম, নদী, আকাশ, বাতাস, গাছ, পাখি। তারাও আর্তনাদে কেঁদেছিল, শুনতে পায়নি হয়তো কেউ।
লেখক: চলচ্চিত্র সমালোচক ও গবেষক
0 মন্তব্যসমূহ