ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপাসনা যে খ্রিস্টপূর্ব বহু প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত, এর অন্যতম পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ হল ভারতের মধ্যপ্রদেশের বেসনগরের হোলিওডোরাস গরুড়স্তম্ভ। এ স্তম্ভ এবং স্তম্ভলিপিটি হোলিওডোরাস নামক একজন গ্রীক রাষ্ট্রদূত ভগবান বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে স্থাপন করেছেন ১১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। শুঙ্গবংশের পঞ্চম রাজা কৌৎসীপুত্র ভাগভদ্রের রাজত্বকালে গ্রীক রাজা আন্টিয়ালসিডাসের ভারতে প্রেরিত রাষ্ট্রদূত হয়ে এসেছিলেন হোলিওডোরাস।
ব্রাহ্মী অক্ষরে লিখিত স্তম্ভলিপিটিতে ভগবান বাসুদেবের মাহাত্ম্যের সাথে সাথে হোলিওডোরাস নিজেকে ভগবানের ভক্ত 'পরমভাগবত' বলে পরিচয় দিয়েছেন। ব্রাহ্মীলিপিতে পালি ভাষায় লিখিত সম্পূর্ণ অভিলেখটি হল:
देव देवस वासुदेवस गरुड़ध्वजे अयंकारिते इष्य हेलियो दरेण भागवतेन दियस पुत्रेण नखसिला केनयोन दूतेन आगतेन महाराज सअंतलिकितस उपता सकारु रजोकासी पु (त्र)(भा) ग (भ) द्रस त्रातारसवसेन (चतु) दसेन राजेन वधमानस।
দেব দেবস বাসুদেবস গরুড়ধ্বজে অয়ংকারিতে ইষ্য হেলিয়ো দরেণ ভাগবতেন দিউস পুত্রেণ নখসিলা কেনয়োন দুতেন আগতেন মহারাজ সঅংতলিকিতস উপতা সকারু রজোকাসী পু (ত্র) (ভা) গ (ভ) দ্রস ত্রাতারসবসেন (চতু) দসেন রাজেন বধমানস।
"দেবাধিদেব বাসুদেবের উদ্দেশ্যে এই গরুড়ধ্বজ (স্তম্ভ) তক্ষশীলা নিবাসী দিউসের পুত্র ভাগবত হেলিওডোরাস স্থাপন করেছে। যে যবন মহারাজ অন্তিলিকিতের পক্ষ থেকে রাজদূত হয়ে বিদিশাতে কাশী ( মাতা) পুত্র( প্রজা) পালক ভাগভদ্রের কাছে তাঁর রাজত্বের চৌদ্দতম বর্ষে এসেছিলেন।"
ভাবতে অবাক লাগে প্রায় ২২০০ বছর আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে, স্তম্ভলিপি খোদিত করে একটি গরুড়স্তম্ভ স্থাপন করেছেন তৎকালীন একজন গ্রীক রাষ্ট্রদূত। কিন্তু এ তথ্যটি আমরা অধিকাংশই জানি না। এরকম অসংখ্য সনাতন ধর্ম বিষয়ক পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ সারা পৃথিবী জুড়ে রয়েছে শুধুই আবিষ্কারের অপেক্ষায়। যে পুরাতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো পুনরুদ্ধার হলে বৃহত্তর ভারতবর্ষের ইতিহাসের বর্তমান গতিপথ অনেকটাই পরিবর্তিত হতে বাধ্য। এ সমৃদ্ধ পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণগুলো পুনরুদ্ধার হলে বিদেশীদের প্রচারিত এদেশীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংক্রান্ত সকল মিথ্যাচারের দ্বার চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের মাঝে এসেছেন, লীলা করেছেন আজ থেকে ৫২০০ বছর পূর্বে।কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা অনেকেই তাঁর এই পরম্পরাগত সময়কালটি পর্যন্ত জানিনা। তিনি কত বছর আগে আমাদের মাঝে এসেছেন; এ তথটি না জানার কারণে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা তো বটেই সনাতন ধর্মাবলম্বী অনেকেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অস্তিত্ব মধ্যযুগে নিয়ে আসে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় অসংখ্য পদাবলি, সাহিত্য লিখিত হয়েছে। সংস্কৃত ভাষায় লেখা শ্রীজয়দেব গোস্বামীর 'গীতগোবিন্দ' এবং বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য যা বর্তমান বাংলায় 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' নামে খ্যাত; বঙ্গের কবিদের রচিত এ সকল রচনার দিকে দৃষ্টি দিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রকে কালিমা লেপনের অনেকেই প্রয়াস করে। অথচ একজন বিদেশি গ্রিক ১১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে 'দেবাধিদেব' উল্লেখ করে এবং নিজেকে 'পরমভাগবত' পরিচয় দিয়ে একটি বৃহৎ গরুড়স্তম্ভ স্থাপন করেছেন মধ্যপ্রদেশে। স্তম্ভটি 'হেলিওডোরাস পিলার' নামেই জগদ্বিখ্যাত। যা ভারতের মধ্য প্রদেশের বিদিশা জেলার আধুনিক বেসনগরের নিকটে নির্মিত। এটি সাঁচিস্তূপ থেকে মাত্র পাঁচমাইল দূরে অবস্থিত।স্তম্ভের পাশে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একটি প্রাচীন মন্দির ছিল। কিন্তু বর্তমানে মন্দিরটির অস্তিত্ব নেই। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণগুলি দেখে নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, প্রাচীনকালে এখানে একটি বৃত্তাকার মন্দির ছিল। যার ভিত্তি ২২ সেন্টিমিটার প্রশস্ত এবং ১৫ থেকে ২০ সেমি গভীর ছিল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে পূর্বেই সেই স্থানে একটি বৃহৎ মন্দির ছিল।পরবর্তীতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে পূর্বের মন্দিরের ভগ্নাবশেষে পুনরায় একটি নতুন মন্দির নির্মিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে ভয়াবহ বন্যায় মন্দিরটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সহ হিন্দু দেবদেবতার পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ সমগ্র পৃথিবীব্যাপী রয়েছে। এরপরেও অনেকে বলে থাকেন; শ্রীকৃষ্ণ অলৌকিক পৌরাণিক ব্যক্তিত্ব। যার বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যদি শুধুই পৌরাণিক ব্যক্তিত্বই হতেন, তবে তাঁর সাথে সম্পর্কযুক্ত মথুরা, বৃন্দাবন, যমুনা নদী, কুরুক্ষেত্রের সেই বিখ্যাত ধর্মযুদ্ধের স্থান এ প্রত্যেকটি ভৌগোলিক স্থানের সাথে মিল থাকত না। কিন্ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে সম্পর্কিত প্রত্যেকটি ভৌগোলিক স্থান এখনো ঠিক তেমনিই আছে যেমনটা মহাভারত সহ বিভিন্ন পুরাণে বর্ণিত আছে। বিষয়গুলো কিন্তু আমাদের নতুন করে ভাবা উচিত। নতুন করে গবেষণা করা উচিত। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই ভূখণ্ডের মানুষ। আমি সনাতন ধর্মাবলম্বী হই বা নাই হই একটি বিষয় সর্বদা স্মরণীয় যে; তিনি এই ভূখণ্ডের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাই এই ভূখণ্ডের ঐতিহ্য হিসেবে বিষয়গুলো নতুনভাবে পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
https://www.facebook.com/KushalBaranBD/posts/pfbid02j4Cx9kyupyaFvVEomrjH5UzKfPXBrSsFkw4XrqBbDdpao6NyXyM4bsTQ5buRpSPDl
0 মন্তব্যসমূহ